আমাদের শিশু ওয়ার্ডে দেড় মাসের একটি বাচ্চা ভর্তি হয়েছিল। পাতলা পায়খানা আর বমি ছিল মূল সমস্যা। আমরা ইতিহাস নিয়ে জানলাম জন্মের পর থেকে ওকে কৌটার দুধ খাওয়ানো হচ্ছিল। ওর মা’র সাথে কথা হল। বাচ্চাটির জন্য বুকের দুধ খুবই জরুরী, এ কথা তাকে বোঝানো হল। তিনি সারাদিন মনমরা হয়ে থাকেন। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করেন না। তিনি নিজেও বুকের দুধ খাওয়াতে চান। কিন্তু সব সময় তার মধ্যে ভয় কাজ করে। আমি মনে হয় পারব না, বুকের দুধে ঠিকমতো পেট ভরবে না, এই সব দুশ্চিন্তার পাশাপাশি তিনি আরও কিছু কারণে সব সময় বিষন্নতায় ভোগেন। ‘আরও কিছু কারণ’গুলো তিনি নিজেও জানেন না, কাওকে বোঝাতেও পারেন না।
আরেকজন মা এসেছিলেন তার নবজাতক বাচ্চা কে নিয়ে। তার বাচ্চার নাকি খুব বড় ধরনের সমস্যা, সারাক্ষণ জ্বর থাকে গায়ে, ঠিকমত বাড়ছে না এসব নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। তার বাচ্চাকে ভর্তি করে ‘যা যা পরীক্ষা লাগে’ না করিয়ে তার স্বস্তি নেই। তিনি কয়েকদিন পরপর আসেন আর আমরা বাচ্চাকে ঠিকমত দেখে জানাই, আপনার বাচ্চা ভালো আছে, ভর্তি লাগবে না। উনি বিশ্বাস করতে চান না। কথা বলে জানতে পারি, বাচ্চার ঠিকমত যতœ হচ্ছে না, এটা নিয়ে উনি সারাক্ষণ হীনমন্যতায় থাকেন।
গর্ভধারণ এবং প্রসবকাল একজন মহিলার জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, কারও ক্ষেত্রে সবচেয়ে সংকটময় একটি সময়। এই অবস্থায় তার শরীর, স্বাস্থ্য আর মনের উপর দিয়ে ‘ঝড়’ই বয়ে যায়। আমরা শরীরের পরিবর্তন দেখি, চিকিৎসা করাই, ওষুধ দিই। মনের খবর কি রাখি? প্রসবের পরে একজন মা বিষন্নতায় ভুগতে পারেন। এই বিষণ্ণতা তার মৃত্যুর কারণও হতে পারে। আমি এই লেখা শুরু করেছি একজন শিশু চিকিৎসকের দৃষ্টি কোন থেকে। মায়ের বিষন্নতা শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশ মারাত্মকভাবে বিঘিœত করে। শিশুর ভালোথাকার অনেকটাই নির্ভও করে তার মায়ের ভালোথাকার উপর।
প্রসবের প্রথম সপ্তাহ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা নির্ধারণের জন্য কিছু পদ্ধতি রয়েছে। মনোবিদগণ কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিষন্নতার মাত্রা বের করার চেষ্টা করেন। ‘এডিনবার্গ প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা স্কেল’ নামে প্রচলিত এই পদ্ধতির প্রশ্নগুলো আসুন দেখে নিই। (উত্তরগুলো বিগত এক সপ্তাহের অভিজ্ঞতার আলোকে দিতে হবে)
১। আমি হাসতে পেরেছি এবং কোন জিনিসের মজার দিকগুলো আমার চোখে পড়েছে-
- বরাবরের মতই পেরেছি
- ঠিক আগের মত ততোটা না
- এখন ঠিক পারছিই না
- মোটেও পারছি না
২। কোন জিনিস উপভোগ করার জন্য সামনে তাকিয়েছি-
- আগের মতই উপভোগ করেছি
- না, আগের চেয়ে একটু কমই হবে
- অবশ্যই আগের চেয়ে অনেক কম
- মনে হয় না, উপভোগ করেছি
*৩। কোথাও কোন ভুলভাল হলে অযথাই নিজেকে দায়ী করেছি-
- হ্যাঁ, সব সময়
- প্রায়ই করেছি
- খুব একটা না
- না, করিনি
৪। কোন কারণ ছাড়াই উদ্বেগ কিংবা দুশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করে-
- মোটেও করে না
- কদাচিৎ করে
- মাঝে মাঝে করে
- হ্যাঁ, প্রায়ই করে
*৫। শুধু শুধুই আমি ভয় পাই কিংবা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি-
- হ্যাঁ, খুব বেশিই হচ্ছে এমন
- হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এমন হয়
- তেমন একটা হয় না
- একেবারেই না
*৬। সব ঝামেলা যেন আমার মাথার উপরই পড়ে-
- হ্যাঁ, আমার উপরই পড়ে, আর আমি সামলাতেও পারি না
- হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমি ঘাবড়ে যাই
- না, হলেও আমি সামলে উঠি
- আমি তো সব ঠিকমতই গুছিয়ে উঠি
*৭। আমার এত খারাপ লাগে যে ঠিকমত ঘুমাতেও পারছি না-
- হ্যাঁ, বেশিরভাগ সময়ই পারছি না
- মাঝে মাঝে সমস্যা হয়
- খুব একটা সমস্যা হয় না
- না, একেবারেই না
*৮। মনমরা হয়ে থাকি কিংবা নিজেকে খুব ছোট মনে হয়-
- সবসময় এমন মনে হয়
- প্রায়ই এমন হয়
- খুব একটা না
- কখনোই নিজেকে ছোট, অসহায় মনে হয় না
*৯। মন এত খারাপ থাকে যে কান্না করি-
- হ্যাঁ, বেশিরভাগ সময় কান্না পায়
- মাঝে মাঝেই কান্না পায়
- দুএকবার এমন হয়েছিল
- না, এমন কখনোই হয়নি
*১০। ইচ্ছে করে, নিজেকে শাস্তি দিই (নিজের ক্ষতি করি)-
- হ্যাঁ, প্রায়ই এমন ইচ্ছে করে
- মাঝে মাঝে এমন হয়
- কদাচিৎ মনে হয়েছিল
- কখনই এমন ভাবিনি
এবার উত্তরগুলোর জন্য নম্বর দিতে হবে। যেসব প্রশ্নের আগে * চিহ্ন নেই সেগুলোতে, ১ম, ২য়, ৩য়, ৪থ উত্তরের জন্য যথাক্রমে ০, ১, ২, ৩ নম্বর দিতে হবে। আর * চিহ্নিত প্রশ্নের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৩, ২, ১, ০ নম্বর দিতে হবে। এবার নম্বরগুলো যোগ করে যদি দশের বেশি হয় তাহলে বিষণ্ণতার আশঙ্কা করা যায়। আর নম্বর তেরোর বেশি হলে বিষন্নতার জন্য অবশ্যই মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কিছু ক্ষেত্রে সন্দেহ হলে দুই সপ্তাহ পরে এই প্রশ্নোত্তরের পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে।
আর ১০ নম্বর প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের আত্মহত্যার প্রবণতা এই প্রশ্নের উত্তর থেকে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
-ডাঃ আহাদ আদনান
রেজিস্ট্রার (শিশু বিভাগ),
আই সি এম এইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা।
১৯১২২৪২১৬৮।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন