এক
ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বারবার ফিরে আসে। এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও বারবার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রমাদানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। ছদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানির গোশত ইত্যাদি নিয়ামাত তিনি বারবার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নিয়ামাত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।
ইসলামে ঈদের প্রচলন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি নিয়ামাত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনাতে আগমন করলেন তখন মদিনাবাসীদের দুটো দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। আনাস রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু’দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন : আমরা জাহেলী যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন : ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনান আবূ দাউদ: ১১৩৪) শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দু’টো দিন ছিল আল্লাহ তায়ালা তা পরিবর্তন করে এমন দু’টো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর জিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে। আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ গ্রন্থে ইবনে জারীর রা. বর্ণনা মতে, দ্বিতীয় হিজরিতে রাসূল স. প্রথম ঈদ পালন করেছেন।
ঈদে করণীয়
ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামাত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামাত হিসাবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদাতে পরিণত হতে পারে। নীচে করণীয়গুলো আলোচনা করা হল :
ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করা : আমাদের দেশের অনেকেই ফজরের নামাজ আদায় করে না। ঈদের জন্য ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়ার গুরুত্বও দেয় না। অথচ ফজরের নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল স. বলেছেন, ‘যদি তারা এশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারতো তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুটি নামাজের জামায়াতে শামিল হত।’ (সহীহ বুখারি: ৬১৫)
ঈদের সালাত আদায় করা : ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের সালাত আদায় করা। প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার বান্দাহ সালাত আদায়ের মাধ্যমে বেশি আনন্দিত হয়ে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘নবী কারীম স. ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামাজ আদায় করেননি।’ (সহীহ বুখারি : ৯৮৯) ঈদের সালাতে মহিলাদেরকে শামিল করানোর বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, উম্মে আতিয়া রাদি আল্লাহু আনহা বলেন, ‘আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ স. আদেশ করেছেন আমরা যেন মহিলাদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাতে সালাতের জন্য বের করে দেই; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবর্তী ও গৃহবাসিনীসহ সকলকেই। কিন্তু ঋতুবর্তী (ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়া প্রত্যক্ষ করতে অংশ নিবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না নেই (যা পরিধান করে আমরা ঈদের সালাতে যেতে পারি)। রাসূলুল্লাহ স. বললেন, ‘সে তার অন্য বোন থেকে ওড়না নিয়ে পরিধান করবে।’ (সহীহ মুসলিম : ২০৯৩)
ঈদের দিন গোসল করা : ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমার রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ (সুনান বায়হাকী : ৫৯২০)
পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া : আর ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া হল সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘সুন্নাত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।’ (সুনান আততিরমিযী : ৫৩৩) উভয় পথের লোকদেরকে সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা। হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নবী কারীম স. ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ (সহীহ বুখারী : ৯৮৬)
ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ : ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া সুন্নাত। বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সা. ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না।’ (সুনান আততিরমীযি : ৫৪৫)
ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন : (ক) হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেছেন, সাহাবায়ে কিরামগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন : ‘তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভাল কাজগুলো কবুল করুন। (খ) ‘ঈদ মুবারক’ ইনশাআল্লাহ। (গ) ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
দুই ঈদে তাকবীর পাঠ করা : তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো : ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। ওয়া লিল্লাহিল হামদ’।
আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ স. ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।’ (মুসতাদরাক : ১১০৬) যখন সালাত শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ করতেন না। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যখন বের হবে ও ঈদগাহে সালাতের অপেক্ষায় যখন থাকবে তখন গুরুত্ব সহকারে তাকবীর পাঠ করতে হবে। আর সুন্নত হল মসজিদ, বাজার, রাস্তা-ঘাট সহ সর্বত্র উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, মানুষ এ সুন্নত এর প্রতি খুবই উদাসীন। আমাদের সকলের কর্তব্য হবে এ সুন্নতটি সমাজে চালু করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো।
আর ঈদুল আযহার তাকবীর শুরু হবে নবম যিলহজ্জের ফযর থেকে আর শেষ হবে তেরো যিলহজ্জের আসর নামাজের ফরযের সালাম ফেরানোর পর পর্যন্ত। যারা হজ্জ পালনে রত নয় তারা এ নিয়মে তাকবীর পাঠ করবেন। আর যারা হজ্জ পালনে আছেন তারা ঈদের দিনে যোহরের নামাজ থেকে তাকবীর শুরু করবেন। কেননা, এর পূর্বে তারা তালবিয়া পাঠে ব্যস্ত থাকবেন। ( ফাতহুল বারী ২য় খন্ড)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন