শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ট্যানারি স্থানান্তরে গড়িমসি

কঠোর অবস্থানে সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে নিয়মিত মনিটর করার দাবি পরিবেশবাদীদের

প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:২৬ পিএম, ১১ এপ্রিল, ২০১৬

রফিক মুহাম্মদ : বুড়িগঙ্গার দুঃখ হাজারিবাগের ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করার ব্যাপারে চলছে গড়িমসি। শিল্পমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের পরও বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। স্থানান্তরের জন্য আবারও সময় বৃদ্ধির জন্য মালিকরা নানা তালবাহানা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু সর্বশেষ ১০ এপ্রিলের মধ্যে হাজারীবাগের সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরের আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। তাতেও ট্যানারি সাভারে স্থানান্তরিত হয়নি। ট্যানারি মালিকদের সাভারে জমির প্লট দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার ২০০ কোটি টাকাও দিয়েছে, যার ৬০ ভাগ পর্যন্ত ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা নানা অজুহাতে এখনও তাদের শিল্প স্থানান্তরে উল্লেখযোগ্য সাড়া দিচ্ছেন না। ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে সরকার ও চামড়া শিল্পের মালিকরা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে যে যার অবস্থানে রয়েছে। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সাভারে চামড়া শিল্প নগরীর অবকাঠামো নির্মাণকাজ এখনো শেষ হয়নি। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ট্যানারি স্থানান্তরের লক্ষ্যে সভারের চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত। তারপরও ট্যানারি মালিকরা ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন না। অভিযোগ উঠেছে, মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে শিল্প মালিকরা এবারও সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের সময় বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন। পরিবেশবাদীরা ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরে সময় না বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে অবকাঠামো ও কারখানা তৈরির কাজ নিয়মিত মনিটর করারও আহ্বান জানান তারা।
ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কারখানা সরানো সম্ভব হয়নি। তাই আবারও শিল্প মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে সময় বাড়ানোর দাবি জানাবে মালিকদের দুটি সংগঠন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) ও বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ)।
ঢাকার ক্ষত বা বুড়িগঙ্গার দুঃখ হাজারিবাগ ট্যানারি। দীর্ঘ ৬৫ বছর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ করে যাচ্ছে। ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে যাচ্ছে। এতে বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা এখন ময়লা আবর্জনাপূর্ণ এক মরা নদী। ট্যানারির বর্জ্য শুধু পানি নয়, ঢাকার বায়ু, মাটিদূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে চলছে। ট্যানারি স্থানান্তর না করার ফলে বুড়িগঙ্গাসহ রাজধানী ঢাকায় দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। এছাড়া ট্যানারিগুলো পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় রফতানি নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাও রয়েছে।
ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত হয় প্রায় দুই দশক আগে, কিন্তু বিভিন্ন সময় স্থানান্তরের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। একপর্যায়ে সাভারে স্থানান্তরের জন্য ১৪২টি ট্যানারিকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়। এর পরে হাজারীবাগ থেকে স্থানান্তরের সময়সীমা ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ সরকার এই সময়সীমা ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বেঁধে দেয়। ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরিত না হওয়ার অন্যতম কারণ মালিকদের অনীহা এবং সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন। এ ছাড়া সরকারের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার সাথে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমেও ট্যানারি মালিকরা বারবার নানা অজুহাত সৃষ্টি করে হাজারিবাগে বহাল তবিয়তে আছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে।
হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। শিল্পমন্ত্রী আমুর হোসেন আমু ইতোমধ্যে হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ সিদ্ধান্তে অটল আছেন। শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য আর সময় বাড়ানো হবে না। আগেই নির্দেশ দিয়েছি, ৩১ মার্চের পর হাজারীবাগে কোনো কাঁচা চামড়া প্রবেশ করবে না। যে কাঁচা চামড়া সাধারণত বায়ুদূষণ করে, পরিবেশ নষ্ট করে, নদীর পানি নষ্ট করে, সেই কাঁচা চামড়া অপসারণ করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান হাজারীবাগের ট্যানারি সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তরে সরকারের কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জায়গায় পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট একনেকে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়ছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে গ্রহণ করা হয় তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি। এরপর কেটে যায় পুরো একটি যুগ। এর মধ্যে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাত বার। এই শিল্পনগরে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। পরিবেশবাদীরা সম্প্রতি সাভারে নতুন চামড়া শিল্প নগরী পরিদর্শন শেষে বলেন, নতুন ট্যানারি এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ অত্যন্ত মন্থর গতিতে চলছে, প্রকল্পের কাজ শতকরা ৫০ ভাগও শেষ হয়নি। বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ অন্যান্য অবকাঠামোর কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ট্যানারি স্থানান্তর হওয়ার পর স্থানীয় পরিবেশ ও পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখার বিষয়েও তারা দাবি জানান। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বর্জ্য শোধানাগার চালু করার জন্য অন্ততপক্ষে ৪০টি কারখানা চালু করা দরকার, কিন্তু উৎপাদন শুরু করতে পারে এরকম কারখানা ৫টিও এখনো প্রস্তুত হয়নি। বাপা’র পক্ষ থেকে তিনি দাবি করেন, দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে অবকাঠামো ও কারখানা তৈরির কাজ নিয়মিত মনিটর করতে হবে এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে পূর্ণ স্থানান্তর সম্পন্ন করতে হবে। স্থানান্তরের সময়সীমা বিভিন্ন সময়ে বেঁধে দিলেও তা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণ হলো, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কঠোরভাবে মনিটর না করা।
অন্যদিকে সাভার চামড়া শিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক আবদুল কাইয়ুম এ বিষয়ে বলেন, ট্যানারি স্থানান্তরের শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলা যায়। তবুও ট্যানারি মালিকরা ইতিবাচক সাড়া দেননি। সেন্ট্রাল ইফলেন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (সিইটিপি) অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের দুটি মডিউলের কাজ ১০০ ভাগ শেষ হয়েছে। এখন বর্জ্য পেলেই তা শোধন করা সম্ভব। এর একটি মডিউল চালু করতে সাড়ে পাঁচ হাজার বর্জ্য দরকার হয়। কিন্তু ট্যানারি না আসায় এটি চালু করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে সরকারের এ মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বংশী নদীর পাড়ে প্রায় ২০০ একর জমির ওপরে এ প্রকল্পের প্রায় সব কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আমাদের দিক থেকে যে সামান্য কাজ আছে তা অল্প দিনেই শেষ হবে। তাই বলে এখন এখানে ট্যানারির কাজ শুরু করা যাবে না। তা একেবারেই অবাস্তব এবং অযৌক্তিক। প্রকল্প পরিচালক বলেন, ট্যানারি স্থাপনে গ্যাস বিদ্যুৎ কোনো সমস্যা নয়। যারাই আবেদন করছেন তাদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ২০ দিন আগে রিলায়েন্স ট্যানারি এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে। তারা চামড়া প্রক্রিয়ার কাজও শুরু করতে যাচ্ছে। তবে অন্যরা এখনও কেন আসতে পারছে না তারাই জানে। আবদুল কাইয়ুম বলেন, ৬২টি ট্যানারি মালিক গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করেছে। তিতাসের পক্ষ থেকে তাদের ১২/১৩টি শর্ত পূরণ করতে বলা হয়েছে। অথচ এখনও তারা তা করেনি। বিদ্যুতের জন্য ১৩৮টি কোম্পানি আবেদন করেছে। এর ৮৭ জন ডিমান্ড নোট পেয়েছে। এদের ৮ জন টাকা জমা দিয়েছে। প্রকল্প পরিচালক প্রশ্ন করে বলেন, শতভাগ রেডি থাকার পরেও যদি ট্যানারি মালিকরা না আসে তাহলে আমরা কী করব? এখন এখানে কাজ শুরুর পরিবেশ হয়নি, একথা কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়। তিনি বলেন, অনেকে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েও জমির প্লট খালি ফেলে রেখেছেন। তারা কাজ শুরু না করলে অচিরেই তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হবে।
ট্যানারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, সাভারে ৬০টি ট্যানারি তাদের অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এসব ভবনে ৪তলা পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে। তবে এখনও অনেক কাজ বাকি। এছাড়া সেখানে চামড়া ডাম্পিংয়ের স্থান এখনও ব্যবহার উপযোগী হয়নি। কেবলমাত্র পাইলিং হয়েছে। এসব কাজ শেষ করে জুন-জুলাইয়ের আগে হাজারিবাগের ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর সম্ভব হবে না। তবে সরকারের এ মহৎ উদ্যোগে সাড়া দিতে আগামী কোরবানি ঈদের আগেই সাভারে ট্যানারি স্থানান্তরের লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন