দীন ইসলামে প্রবেশ করার জন্য সর্ব প্রথম যা অবলম্বন করা একান্ত অপরিহার্য তা হলো ঈমান। ঈমান আরবী শব্দ, অভিধানগত অর্থ নিরাপত্তা দান করা, আস্থা স্থাপন করা, কাওকে অভয় দান করা, কাওকে সত্যবাদী জ্ঞান করত: তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা। ঈমানের পরিভাষা বা ব্যবহারিক অর্থ হলো, দীনের যে সকল বিষয় রাসূলুল্লাহ সা. হতে অকাট্যরূপে বর্ণিত ও প্রমাণিত তা মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করত: মান্য করা। (আকায়েদ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত: পৃ: ৪৫)
আরবী ঈমান শব্দটির বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে যে, ঈমান শব্দটি ইফআলের মাসদার বা শব্দ মূল। এটা হতে আরবী আমানা, ইউমিনু, ঈমানান, ফাহুয়া মু’মিনুন শব্দাবলী গঠিত। সকল অভিধান বিশারদের মতে ঈমান অর্থ সত্যায়ন করা, সত্য বলে মেনে নেওয়া, সত্য বিশ্বাস করা। (লিসানুল আরব: ১৩/২৭) ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহ. বলেন, ঈমান অর্থ মুখাতিবের উক্তি, তার দীনদারী ও আমানতদারীর ভিত্তিতে শ্রোতা কর্তৃক সত্যায়ন করা ও আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন করা। (ফয়জুল বারী, শরহে বুখারী: ১/৪৬)। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী বয়দবী রহ. বলেন, শরীআতের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক আনিত বিষয় যা জরুরীভাবে (স্বত:সিদ্ধ প্রমাণিত রূপে) পরিজ্ঞাত, বিস্তারিত বিষয় বিস্তারিতভাবে এবং ইজমালীভাবে পরিজ্ঞাত বিষয় ইজমালীভাবে আন্তরিক বিশ্বাস করাকে ঈমান বলে। (আকায়েদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত: পৃষ্ট-৪৬; রুহুল মায়ানী: ১/২০১, বৈরুত)। বস্তুত: যে সকল বিষয় রাসূলুল্লাহ সা. হতে অকাট্যরূপে, সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত সেগুলোকে জরুরিয়াতে দীন বা দীনের অত্যাবশ্যকীয় চির পরিচিত বিষয় বলা হয়। কোনো ব্যক্তির মুমিন হওয়ার জন্য সকল জরুরিয়াতে দীনের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন অপরিহার্য। তার মধ্য হতে কোনো একটি বিষয়কে অস্বীকার করলেও সে ইসলামের গÐি হতে খারিজ হয়ে যাবে। (হেকায়া শরহে হেদায়া: ১/১০৩)
জেনে রাখা ভালো যে, জরুরিয়াতে দীন বা দীনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়াবলী অনেক। যেমন আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ ও তার গুণাবলীর প্রতি, ফেরেশতামÐলীর প্রতি, আসমানী কিতাব সমূহের প্রতি, আল্লাহর প্রেরীত রাসূরগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা, কিয়ামত, তাকদীর ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা, সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ ও জিহাদ ইত্যাদি বিষয় ফরজ হওয়ার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সূদ, ব্যভিচার, মিথ্যা ও ইসলামের ফরজ কাজের প্রতি আলস্য প্রভৃতি হারাম হওয়ার প্রতি ঈমান আনয়ন করা। এ বিষয়টিকে খোলাসা করে দু’ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথমত: শরীয়তের ব্যবহারিক অর্থে, আল্লাহর নিকট হতে রাসূলুল্লাহ সা. যে সকল বিষয় আনয়ন করেছেন তা সত্য বলে মেনে নেওয়ার নামই হলো ঈমান। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা. এর মাধ্যমে জরুরীভাবে উপস্থাপিত বিষয় সমূহে তাকে অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা। দলিল-প্রমাণ ও চিন্তা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত বিষয়কে ইস্তিদলালী বলে। আল দলিল-প্রমাণ, চিন্তা-গবেষণা ছাড়া পরিজ্ঞাত বিষয়কে জরুরী বলে। যেমন সরাসরি রাসূলুল্লাহ সা. এর জবান মোবারক হতে শ্রæত বিষয়, তার নিকট থেকে তাওয়াতুর ও অবিচ্ছিন্ন পদ্ধতিতে বর্ণিত বিষয়, যথা কোরআন মাজীদ, নৈতিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রমজান মাসের সাওম পালন ইত্যাদি এবং মদ-যিনা হারাম হওয়া ইত্যদি। (নিবরাস: ২৪৯; আকায়েদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত: পৃ. ৪৬)
দ্বিতয়ত: দলিল-প্রমাণের গভীর তথ্য ছাড়াই যে সকল বিষয় রাসূলুল্লাহ স. এর প্রচারিত দীনের অঙ্গ হিসেবে পরিচিত এমন কি দলিল-প্রমাণের গভীরতা সম্পর্কে অজ্ঞ জনসাধারণও তা জানে তাকেও জরুরী বলা হয়। এর অর্থ এই নয় যে, সকল ব্যক্তিই তা জনে, যদিও দীনি শিক্ষার সাথে তার দূরতম সম্পর্কও না থাকে। সুতরাং দীনি শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীন কেউ যদি উক্ত বিষয় না জানে, অথচ সাধারণ জনগণের তা জানা আছে তাহলে তাও জরুরী বলে গণ্য হবে। উদাহরণ স্বরূপ আল্লাহর একত্ববাদ, রিসালাত, খতমে নবুওয়্যাত, হিসাব-নিকাশ, পুনরুত্থান ইত্যাদি। (ফয়জুল বারী শরহে বুখারী: ১/৬৯)। ঈমান মূলত আন্তরিক বিশ্বাসের নাম। এই পৃথিবীতে কারও ওপর ইসলামী বিধান কার্যকরী করার জন্য মৌলিক স্বীকারোক্তি শর্ত। কারণ, মানুষ অন্তরের খবর জানে না, তাই মৌলিক স্বীকৃতির দ্বারাই তার মুসলমান হওয়ার বিষয় অবগত হওয়া যায়। তবে শর্ত হলো, তার মৌলিক উক্তি বা স্বীকৃতি অন্তরের ভাব বিশ্বাসের অনুরূপ হতে হবে। কাজেই যে ব্যক্তি অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু তা স্বীকার করে না, সে আল্লাহ পাকের আদালতে মুমিন হিসাবে গণ্য হবে। যদিও দুনিয়ার বিচারে মুমিন বিবেচিত হবে না। (ফাতহুল মুশাহিম: ১/৪৩৪; নিবরাস: ২৫০; শরহে ফিকহে আকবার: ১২)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন