শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

সার্বজনীনতা, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তারেকুল ইসলাম

শুভ বাংলা নববর্ষ-১৪২৩ উদযাপনের ব্যাপারে বলার আগে সঙ্গতকারণে আমি ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ সম্পর্কে আমার বিশেষ অভিমত ব্যক্ত করতে চাই। ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র তত্ত্বটি হচ্ছে আসলে হিন্দুয়ানি সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী প্রপাগা-ার একটি বঙ্গীয় রূপ মাত্র। আরব থেকে বিভিন্ন সময়ে এতদাঞ্চলে আগত মুসলিম শাসক ও পীর-আউলিয়াগণ ইসলামের সুমহান সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রসারের মাধ্যমে আমাদের পূর্বপুরুষ দলিত ও শোষিত হিন্দু চাষাভূষার সমাজকে যে মুক্তির দিশা দিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছিলেনÑ সেই ইতিহাসকে বরাবর আড়াল করার কসরত করা হয় কথিত ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র নামে। নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকভাবে আমরা জানি, আমাদের এখানকার হাজার বছর আগের পূর্বপুরুষ ছিলেন বৌদ্ধ, হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং তাদের যাবতীয় সাংস্কৃতিক উৎসব, কৃষ্টি ও জীবনাচারগুলো কার্যত ছিল হিন্দু পৌরাণিক ও সনাতনী ভাবধারায় সিক্ত। একইভাবে এটাও সত্য যে, জাতপাতের বিভেদে জর্জরিত সেই সনাতনী সমাজে এলিট হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা চাষাভূষা ও গরিব প্রজাদের ওপর নির্মম শোষণ ও অত্যাচার চালাতো। কিন্তু বাংলায় মুসলমান শাসক ও সময়ান্তরে পীর-আউলিয়াদের আগমনে সেই শোষিত ও দলিত শ্রেণির হিন্দুরা বৈষম্য ও জমিদার-মহাজনদের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে ইসলামের মহান ও উদার ছায়াতলে এসে মুক্তির আশা করতে পেরেছিল। এভাবে জাতপাতের বিভেদপন্থী হিন্দু ধর্ম ছেড়ে এবং পীর-আউলিয়াদের আধ্যাত্মিক ও মানবিক স্পর্শে এসে আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুসলিম হয়েছিলেন। এরই পরিক্রমায় সমগ্র বাংলায় ইসলাম তার ভাবাদর্শ উঁচু করে বিস্তার ও প্রসার লাভ করে। আর ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকরা বর্বর বর্ণবৈষম্য ও জাতপাতের সংস্কৃতির বিপরীতে ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে মানবিকতা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মহান সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। এরপর ব্যবসা-বাণিজ্যের মুলা ঝুলিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে এক পর্যায়ে কূটচাল ও হিন্দুদের সহায়তায় মুসলিম শাসকদের উৎখাত করে। ব্রিটিশরা প্রায় দুইশ’ বছর ভারত শাসন করে। পড়ন্ত বেলায় ব্রিটিশরা ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতিতে এগুতে চাইলেও তাদের আর শেষ রক্ষা হয়নি। তবে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে তাদের তৈরি দীর্ঘ ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও মেরুকরণের পরিণামে দেশভাগ হয়। ১৯০৫-১১ সাল পর্যন্ত সম্ভব না হলেও অবশেষে সাতচল্লিশে গিয়ে বঙ্গভঙ্গ হয়। ধর্মীয় বিবেচনায় হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ চলে গেলো ভারতের সাথে, আর তদ্রুপ মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ চলে এলো পাকিস্তানের সাথে। এখানে বলা সঙ্গত যে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালে তার লাহোর প্রস্তাবে বাংলাকে ভাগ না করে বরং পূর্ব ও পশ্চিম দুটো মিলে একটি স্বতন্ত্র বঙ্গরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ হিন্দু নেতৃবৃন্দের তীব্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে প্রস্তাবটি আমলে নেয়া হয়নি।
যাই হোক, তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি পাকিস্তানিরা ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় রক্তাক্ত ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের অত্যাচার ও শোষণের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলে। কিন্তু আমরা পি-ির শিকল থেকে মুক্তি পেলেও দিল্লির কবল থেকে আদৌ পাইনি। যার দরুন এখনো মাঝেমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন পরিষ্কার ভৌগোলিক রাজনৈতিক মেরুকরণ ও বাস্তবতা সত্ত্বেও তারা দুই বাংলাকে এক হওয়ার অলীক ও হাস্যকর আহ্বান জানান। কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, কোলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতীয়; পক্ষান্তরে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী। তাই পশ্চিমবঙ্গীয়রা যতটা না বাঙালি তারচেয়েও বেশি ভারতীয়, আর এদিকে আমরাও যতটা না বাঙালি তারও বেশি বাংলাদেশি। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ই এখানে মুখ্য বিষয়, কেননা এটা জাতিরাষ্ট্র তথা আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের মামলা। এছাড়াও ধর্মীয়ভাবে উভয় বাংলার স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্য ষোলআনাই বিদ্যমান। এমতাবস্থায় উভয় বাংলাকে এক হওয়ার আহ্বান স্পষ্টতই আবেগি হাউস মাত্র এবং ক্ষেত্র বিশেষে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও বটে। মজার ব্যাপার হলো, পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তাদের ভারতমাতাকে ত্যাগ করবে না; তার মানে, উভয় বাংলা এক হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো, বাংলাদেশের জনগণকে তাদের এতদিনের গড়া স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়ে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ভুলে গিয়ে এবং তৌহিদি চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যোগ দিয়ে ভারতমাতার কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রকারান্তরে হাজার বছরের সংস্কৃতি তথা হাজার বছর আগের হিন্দু সনাতনধর্মিতার দিকে প্রত্যাবর্তন করা। এটাই হচ্ছে আসলে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ তত্ত্বের মূল অভিসন্ধি। উল্লেখ্য যে, নিকট-অতীতে ‘বাঙালি’ বলতে মূলত হিন্দু সম্প্রদায়কেই বুঝানো হতো, মুসলমানদের ব্যঙ্গ করে বলা হতো ‘মোহামেডান’। এমনকি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথের আইকন সাম্প্রদায়িক মুসলিমবিদ্বেষী সাহিত্যস¤্রাট বঙ্কিচন্দ্রের মতো সাহিত্যিকরাও তাদের সাহিত্যকর্মে তৎকালীন বাংলাভাষী মুসলমানদের ‘বাঙালি’ বলে স্বীকৃতি দিতে চাননি।
ব্রিটিশ বেনিয়া ও তাদের কোলাবোরেটর হিন্দু প্রভাবশালী জমিদারদের মিলিত কুচক্রে ভারতবর্ষ তথা দিল্লি ও বাংলার সিংহাসন থেকে মুসলিম শাসকদের উৎখাত করার পর ব্রিটিশদের সুদীর্ঘ শাসন নিশ্চিত হয় এবং সময়ের পরিক্রমায় দেশভাগের পরিণতিতে কংগ্রেস নেতা নেহরুর হিন্দুত্ববাদী সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়নের বঙ্গকেন্দ্রিক প্রাপাগা-াটি হলো ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’। হাজার বছর আগের অর্থাৎ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিই তো হচ্ছে সুপ্রাচীন হিন্দু সনাতনধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার। কিন্তু এই হাজার বছরের মধ্যে যে ইসলাম এখানে তার মহান আদর্শ তথা তাওহিদ ও মানবিকতার উদ্বোধন ঘটিয়ে মুসলিম নামের একটি জাতি ও তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ গড়ে তুলেছে, সেটিকে চাপা দেয়ার জন্যই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদপ্রসূত এই তত্ত্ব। যার ফলে আমাদের এখানকার বাঙালি জাতীয়তার ধ্বজাধারী উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল সেকুলাররা সবসময় ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত থাকেন। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৌহিদি ও ধর্মপ্রাণ ইসলামপ্রিয় গণমানুষও গোঁড়া সেকুলারিজমপ্রসূত বর্ণবাদ, বৈষম্য ও জুলুমের শিকার। এইসব মুসলিম নামধারী ব্রাহ্মণ্যবাদপন্থী পেইড সেকুলারদের কাছে দাঁড়ি-টুপি, ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মাদরাসাগুলো একধরনের মানসিক এলার্জির মতো মনে হয়। বঙ্গীয় নাস্তিক ও সেকুলারদের কাছে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ আর ‘ইসলামবিদ্বেষ’ সমার্থক। কারণ মুসলমানদের কোরবানির ঈদের সময় তাদের পশুপ্রেম ও পরিবেশপ্রেম উথলে ওঠে, কিন্তু কালীপূজার উৎসবে পাঁঠা বলি দেয়া আর রাসূল (সা.)-এর নামে কটূক্তির বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত ‘হেফাজতি’দের শহিদ হওয়া তাদের কাছে অভিন্ন হয়ে যায়। দুর্গাপূজার সময় ত্রিশূল হাতে থাকা রণরঙ্গিণী মা দুর্গার তিলকে জোটে ‘সার্বজনীনতা’ কিন্তু মাদরাসার নিরীহ তালেবুল ইলমদের কপালে জোটে জঙ্গিবাদের তকমা! রবীন্দ্রবাবুর সাহিত্যাকাশে ‘হাজারবার আনন্দময়ী মায়ের আগমন ঘটলেও সে আকাশে একটি বারও ঈদের চাঁদ কিংবা মহররমের চাঁদ ওঠেনি।’ মুসলিমবিদ্বেষী কবিতা ‘শিবাজী উৎসব’ লিখলেন, তবুও তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক এবং বাঙালি সেকুলারদের খাঁটি আদর্শ; অন্যদিকে জীবনের বেশিরভাগ সময় হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রচেষ্টা চালিয়ে এবং হিন্দুদের জন্য শ্যামা সঙ্গীত লিখেও নজরুল সেকুলারদের মন জয় করতে পারলেন না!
১৯৭১-এ পাকিস্তান ভাঙার সফলতার পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হাজার সালকা বদলা লিয়া।’ ইন্দিরা পাকিস্তান ভেঙে হাজার বছরের বদলা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে হাজার বছরের পুরনো বা প্রাচীন হিন্দুয়ানি সনাতন ধর্মকে ভিত্তি করে বানানো নেহরু ডকট্রিনের সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিজয়কেই ইঙ্গিত করেছেন। সুতরাং বর্তমানকালে সেই বিজয়ের ধারাবাহিকতাকে আরো এগিয়ে নিতে তথাকথিত ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ এবং উভয় বাংলাকে এক করার উপর্যুপরি তত্ত্ব গিলিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ করাই মূল এজেন্ডা।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম নামধারী ভারতীয় সেকুলার বাঙালি গোলাম মুরশিদরা বাংলাদেশের মতলববাজ সেকুলারদেরকে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র তত্ত্ব শেখাচ্ছে এবং খাওয়াচ্ছে। ওদের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা আমাদের দেশে এলে ‘বাঙালিত্ব’ নিয়ে মায়াকান্না শুরু করে, অথচ ওদের ওখানে ইংরেজি আর হিন্দির আগ্রাসনে আজ বাংলা ভাষার যে মুমূর্ষু অবস্থা, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।
যাই হোক, পহেলা বৈশাখ নয়, বরং এটির উদযাপনের বর্তমান কালচারকে বাঙালি জাতীয়তার ধ্বজাধারী সেকুলারদের তরফে বলা হচ্ছে ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’র অংশ এবং এই মর্মে আরো বলা হচ্ছে, এটি ‘বাঙালি’র সার্বজনীন উৎসব। আক্ষেপের সাথে বলতেই হয়, লাখ লাখ শহিদের রক্ত এবং হাজারো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনপূর্বক নিজেদের জন্য একটি সার্বভৌম দেশ গঠন করার চার দশক পার হলেও ‘সার্বজনীনতা’র জন্য এখনো আমাদেরকে ‘বাঙালি’ হতে হয়, এখনো বুঝি ‘বাংলাদেশী’ হতে পারলাম না। ভাষার কারণে নৃতাত্ত্বিকভাবে আমরা বাঙালি, কিন্তু আমাদের নিজস্ব ভৌগোলিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কি সেটার চেয়েও কম কিছু? আমাদের তো নিজস্ব একটা দেশ আছে এবং মৌলিক রাজনৈতিক ইতিহাস আছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা হচ্ছে পরজীবী অর্থাৎ ভারতমাতার অঙ্গসম, তাই ‘বাঙালিত্বে’র ভবিতব্য ব্যতীত আর কোনো উৎকণ্ঠা ওদের নেই। কিন্তু আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চাভিলাষ নিয়ে সবসময়ই উদ্বিগ্ন এবং নিজেদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-স্বকীয়তা ও জাতিরাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার অধিকার সংরক্ষণে আমাদেরকে নিরন্তর লড়াই করতে হয়।
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের বিষয়টি নিশ্চয়ই আমাদের দেশজ সংস্কৃতির অংশ, কিন্তু এখন এটাকে উদযাপন করা হয় চাপিয়ে দেয়া বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক রাজনীতির উদ্দেশ্যসঞ্জাত কালচারকে অবলম্বন করে, যা আমাদের এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের তৌহিদি ভাব ও চেতনার পরিপন্থীÑআপসহীনভাবেই। সাম্প্রতিককালে আধুনিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্ম শহুরে পরিসরে পহেলা বৈশাখকে প্রধানত উদযাপন করে মূলত হিন্দু পুরাণ ও সনাতন ধর্মানুসারে বর্ণিত শক্তি ও মঙ্গলের প্রতীক বিভিন্ন দেবদেবীর বাহনের মূর্তি নিয়ে যেমনÑ কার্তিকের বাহন ময়ূর, মা স্বরস্বতীর বাহন হাঁস, মা লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা এবং আরো বিভিন্ন রাক্ষস-খোক্ষস ও জীবজন্তুর বিশাল বিশাল মূর্তি নিয়ে মঙ্গলশোভাযাত্রা করার মাধ্যমে। বস্তুতপক্ষে এখনো আমাদের দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের গণেশপূজার সময় মঙ্গলশোভাযাত্রা হয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখে এ যেন হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি তথা হিন্দুয়ানি সনাতনধর্মিতার দিকে আমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করানোর এক মহা আয়োজন।
বিগত ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে ক্ষমতা ও মঙ্গলের প্রতীক হিন্দুদের পৌরাণিক দেবদেবীদের বাহনের মূর্তি নিয়ে এবং বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের উদ্ভট মুখোশ পরে মঙ্গলশোভাযাত্রার মাধ্যমে ব্যাপক ঢোলবাদ্যে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। অথচ অতীতে এতটা আড়ম্বরপূর্ণ ও ঘটা করে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়নি, বরং তখন এই উৎসবের দিনে পুরো বছরের দেনা-পাওনার হিসাব, শুল্ক পরিশোধ ও খাজনা আদায় করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। মহাজন ও জমিদাররা নিজেদের প্রজাদের মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করতেনÑযাকে অনেক সময় ‘পুণ্যাহ’ নামেও ডাকা হতো। অথচ এখন এসবের চেয়েও বিকৃত উদযাপনটাই প্রাদুর্ভাব হয়ে দেখা দিয়েছে। এছাড়া বিশেষত শহুরে মধ্যবিত্তদের ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। যেখানে গরিব-দুখীদের নিত্যই পান্তাভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়, সেখানে সচ্ছল মধ্যবিত্তদের একদিনের জন্য পান্তাভাত খেয়ে ‘বাঙালি’ হওয়া কীভাবে সার্বজনীনতার পরিচায়ক হয় আমাদের বুঝে আসে না। ‘সার্বজনীন বাঙালি উৎসব’, ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ ইত্যাদি স্লোগান বস্তুতপক্ষে এদেশের গণমানুষের তৌহিদি ভাব ও চেতনা এবং ইসলামের প্রভাবকে সঙ্কুচিত করার দুরভিসন্ধির নামান্তর মাত্র।
পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ এদেশের বঙ্গীয় মুসলমানরা চাইলে অবশ্যই উদযাপন করতে পারবে, যদি উদযাপনরীতি ইসলামের মৌলিকত্ব বা তৌহিদের ধারণার বিরোধী একেবারেই না হয়ে থাকে। কোনো স্থানীয় বা দেশজ কালচারের সাথে ইসলামের স্বভাবতই কোনো বিরোধ নেই, যতক্ষণ তা ইসলামের তৌহিদি ভাব ও চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক না হবে। ইসলাম মোটেও সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেয় না। এতদাঞ্চলের স্থানিক বঙ্গীয় সংস্কৃতির সাথে এতদিন উদারভাবে সমন্বয় করে এসেছে বলেই ইসলাম এখানে বৃহত্তরভাবে প্রসার ও বিস্তার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে উৎসবের নামে অত্যুৎসবের চর্চা তথা যথেচ্ছাচার এবং ইসলামী মূল্যবোধ ও তাওহিদের সাথে সাংঘর্ষিক এমন বিজাতীয় কৃষ্টির অনুপ্রবেশ ইসলাম অনুমোদন করে না। এটা সত্য যে, ইসলাম আধুনিক সভ্যতার সু-অভিজ্ঞতাগুলোকে উপেক্ষা করে না, এক্ষেত্রে সে অ্যাকোমোডেটিভ। এমনকি আধুনিক সভ্যতার যেসব মেগা প্রকল্প নিয়ে পশ্চিমারা কাজ করে থাকে, সেসবেও ইসলাম তার নিজস্ব ফাংশন নিয়ে হাজির হতে চায়, তবে নিজের তৌহিদি চেতনাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। এইজন্যই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের এত অধঃপতনের পরও ইসলাম টিকে আছে স্বমহিমায়, শুধুমাত্র তার অবিমিশ্র তৌহিদি আদর্শের জোরেই।
ষ লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন