বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

আশ্রয়কেন্দ্রহীন কলাপাড়ার সাত গ্রাম

আতঙ্কে ১০ সহস্রাধিক মানুষ

বরগুনা থেকে মোঃ মোশাররফ হোসেন : | প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

মেঘ দেখলেই আঁতকে ওঠছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার দুর্যোগ কবলিত লালুয়া ইউনিয়নের সাত গ্রামের ১০ সহস্রাধিক মানুষ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত এক যুগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও নদী ভাঙনে এ গ্রামগুলোতে প্রানহানীর সাথে শতশত পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। কিন্তু বেঁচে থাকার মাথা গোঁজার বিকল্প আশ্রয় না পাওয়ায় মৃত্যুক‚পে খড়কুটোর মতো ঝুপড়ি করে বসবাস করছে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো। এ কারনে প্রতি বর্ষা মৌসুমে এ সাতটি গ্রামে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও একটিও আশ্রয়কেন্দ্রও নির্মাণ হয়নি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাগর মোহনা ঘেষা রামনাবাদ নদের ভাঙন কবলিত লালুয়া ইউনিয়নের ছোট হাসনাপাড়া, চৌধুরীপাড়া, নাওয়াপাড়া, ধনজুপাড়া, এগার নং হাওলা এবং মুন্সীপাড়া গ্রামের মানুষের প্রতিটি রাত কাটে আঙ্ককে। আকাশে মেঘ দেখলেই এসব গ্রামের মানুষ আশ্রয় নেয় বেড়িবাঁধের ওপর। সেই বাধটিও এখন নদী ভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে। দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেয়ার জন্য নাওয়াপাড়া গ্রামে একটি মাত্র মাটির কেল্লা থাকলেও তাতে মানুষ আশ্রয় নিতে পারছেন না। মাটির কেল্লায় যাওয়ার নেই কোন রাস্তা। খাল সাঁতরিয়ে দুর্যোগের সময় এ মাটির কেল্লায় আশ্রয় নিতে হয়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্নিঝড় সিডরের সময় এ কেল্লায় আশ্রয় নিতে গিয়ে নাওয়াপাড়া গ্রামের শেরআলী বয়াতী (৭০) এক বৃদ্ধ পানিতে ডুবে মারা গেছে। আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। নাওয়াপাড়া গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে বানাতিপাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গাছচাপা পড়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন এ গ্রামের মোখলেছ। নাওয়াপাড়া বাঁধের পাশে ঝুঁকিপূর্ন স্থানে বসবাস করছে রুমানের পরিবার। বাঁধের দুই দিক ভেঙে যাওয়ায় তারা এখন পানিবন্দী। তিনি বলেন, নৌকাই এখন তাদের চলাচলের একমাত্র বাহন। বিস্তীর্ন ফসলের মাঠ ৩-৫ ফুট পানিতে তলিয়ে থাকায় এবার পানিবন্দী অবস্থায় তাদের কাটাতে হয়েছে ঈদ। এমন কি নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ারও উপায় নেই। নেই মানুষ মারা গেলে দাফন করার কবরস্থান। এ গ্রামের স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়া আসাও নির্ভর করছে এখন নদীতে জোয়ার ভাটার ওপর।
নাওয়াপাড়া গ্রামের হাবিব গাজী জানান, ১৯৭৪ সালে পাঁচ একর জায়গার ওপর এ কেল্লাটি নির্মাণ করা হয়। তবে দীর্ঘ ৪৪ বছরে সংস্কারের অভাবে তা এখন মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। এ কেল্লায় এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করছে শতাধিক মানুষ। যারা নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব।
গ্রামবাসীরা জানান, প্রায় ১০ হাজার মানুষ এ সাত গ্রামে বাস করলেও সবাই যেন কচুরীপানা। বর্ষা কিংবা জলোচ্ছাস হলেই তাদের ভাসতে হয়। গত ১১ বছর ধরে নদীতে একটু পানি বাড়লেই তারা পানি বন্দী হয়ে পড়ে। এ মাটির কেল্লায় আশ্রয় নেয়া সাজ্জাদ গাজী জানায়, “বউ-সন্তান লইয়া এ্যাহন এইহানেই থাহি। দূরে রামনাবাদ নদ দেখিয়ে বলেন, ওই নদীর মাঝ খানে আমাগো ঘর ছিল। মোর যহন বিয়া হয়, তহন মোগে সব ছিলো। কিন্তু গত এক যুগে সর্বনাশা নদী মোগো সব গিইল্লা খাইছে। এ কেল্লায় ওঠার রাস্তা নাই। যহন জোয়ার থাহে তহন আর কেল্লা দিয়া নামা যায় না। হগল দিক পানিতে ডুইব্বা থাহে। ঝড়, বৃষ্টি হলে মানুষ এইহানে আইতে পারেনা।”
রুবেল বয়াতী বলেন, “সিডরের সময় এই কেল্লায় আইতে যাইয়া মোর বাবা শেরআলী বয়াতী (৭০) মরছে। কতো মানুষ যে এইহানে আইতে যাইয়া পানিতে ভাইস্যা গেছে কইতে পারমুনা।” বাঁধের পাশে তাল পাতায় ঘেড়া শ্যাত শ্যাতে কর্দমাক্ত ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে বাস করে ঝরনা বেগম (৩০)। তিনি বলেন, সামান্য বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস হলেই ঘর ভিইজ্যা যায় পানিতে। আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটতে হয় জীবন বাঁচাতে। কিন্তু জীবন বাঁচলেও প্রতিটি ঝড় জলোচ্ছাসের পানির তোড়ে ভাসাইয়া নিয়ে যায় ঘরের মালামাল। মহাসেন তান্ডবে সবকিছু ভাসাইয়া নিয়ে গেছে তার সংসারের। কলাপাড়া লালুয়া ইউনিয়নের চাড়িপাড়া বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়ি ঘরে বাস করা এ ঝরনা বেগমের মতো শতশত পরিবার সিডর, আইলা ও জলোচ্ছাসে সবকিছু হারিয়েছেন। কিন্তু বিকল্প আশ্রয় না পেয়ে কোন রকম ঝুপড়ি তুলে সেই মৃত্যুকুপেই তারা আবার ঘর বাঁধায় ঝড়, বৃষ্টি হলেই এই পরিবারগুলো সবার আগে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নাওয়াপাড়া গ্রামের একাধিক মানুষ জানান, এ সাতটি গ্রামের মানুষ দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য ইউনিয়নের একেবারে দক্ষিণ দিকের রহিমুদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমদিকের বানাতিবাজার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় এবং উত্তরদিকের চাড়িপাড়া রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হচ্ছে এখন একমাত্র ভরসা। তবে এই আশ্রয়কেন্দ্র তিনটি কোন কোন গ্রাম থেকে ৪-৫কিলোমিটার দূরে। ঝড় শুরু হলে এই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া তাদের জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক। লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান জানান, আশ্রয় কেন্দ্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভাঙা বেড়িবাঁধই এখন প্রধান সমস্যা। ঝড় হলেই আতংক ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন