মুফতি জাবের কাসেমী
পৃথিবীতে প্রতিদিন কত মানুষ জন্মগ্রহণ করে, যারা নিজেদের মনমতো জীবন অতিবাহিত করে আবার চলে যায়। তাদের আগমন ও প্রস্থানে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না। তবে কিছু মানুষ স্বীয় যোগ্যতার বলে মানুষের হৃদয়ে এমনভাবে সমাসীন হয় যে, তাদের প্রস্থানে হৃদয় ইনসান থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়। এই উম্মতে মুসলীমার প্রতি আল্লাহপাকের বিশেষ অনুগ্রহ হলো, কোনোকালেই তিনি পৃথিবীকে উলামায়ে রব্বানী ও হক্কানী শূন্য করবেন না। তাই তো ভারত উপমহাদেশে উলামায়ে কেরামের এক সুবিশাল জামাত তৈরি করে দিয়েছেন, যারা হলো জাতির দিশারী, উম্মাতের কা-ারি, সমাজের ধারক-বাহক। যাদের নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত অনাগত উম্মত গর্ব করবে। যাদের আলো দ্বারা অন্তরের অন্ধকার দূর হবে। দিলের প্রদীপ প্রজ্বলিত হবে। অতীত নিকটে ভারত উপমহাদেশে যার সূচনা হয়েছিল শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী (রহ.) থেকে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম হযরত মাওলানা কাসেম নানতভী (রহ.) পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে হযরত থানভী (রহ.) থেকে হযরত মাওলানা কারী তায়্যিব সাহেব (রহ.) পর্যন্ত। যাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যতের কথা আজও মানুষ স্মরণ করে এবং কেয়ামত পর্যন্ত স্মরণ করবে। কিন্তু নুরে নবুওয়াতের এই প্রদীপের আলো কখনো নিভে যাবে না; রবং যুগের প্রয়োজনে, মানুষের কল্যাণে আল্লাহতায়ালা কেয়ামত পর্যন্ত একেকটি প্রদীপ প্রজ্বলিত করবেন। সেই ধারাবাহিকতার এক উজ্জ্বল নাম ফকীহুল মিল্লাত হযরত মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহ.)। যিনি ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেজবান হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাযি.)-এর বংশধর।
নাম ও বংশ : হযরত মুফতি মাহমুদ হাসান বিন মাওলানা হামেদ হাসান বিন হাজী খলীল বিন ওয়ালী মুহাম্মদ বিন কলন্দর বুখশ বিন মুহাম্মাদ আলী বিন গোলাম রাসূল বিন আব্দুল হামিদ বিন কাজী মুহাম্মদ ফাজেল বিন জামিল মুহাম্মদ বিন কাজী মুহাম্মাদ খলীল বিন কাজী ওয়ালী মুহাম্মাদ বিন কাজী কাবীর বিন কাজী আমান বিন খাজা ফরিদুদ্দিন বিন খাজা আলাউদ্দিন বিন খাজা রুকনুদ্দিন বিন খাজা শরফদ্দিন বিন খাজা তাজুদ্দিন বিন খাজা ইসমাঈল বিন খাজা হাশেম বুজুরগ বিন খাজা ইসমাঈল বিন শায়খুল ইসলাম খাজা আবু ইসমাঈল আবদুল্লাহ আনসারী বিন খাজা আবু মানসুর বিন আলী বিন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আলী বিন জাফর বিন আবু মানসুর বিন হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাযি.)
জন্ম : মুফতি আজম হযরত মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী ১৩২৫ হিজরির ৮ অথবা ৯ জমাদিউল উখরাতে সাহারানপুর জেলার অন্তর্গত গাঙ্গুহ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার সম্মানিত পিতা মাওলানা হামেদ হাসান বিন মুহাম্মদ (রহ.) হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.)-এর শাগরেদ এবং হযরত রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী (রহ.)-এর নিকট বায়আত ছিলেন। অন্ত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। কারও খাওয়ার দাওয়াত গ্রহণ করতেন না, তবে বিবাহ পড়াতে যেতেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে শরিয়তবিরোধী কর্মকা- দেখলে নিষেধ করতেন। কর্তৃপক্ষ তা হতে বিরত থাকলে বিবাহ পড়াতেন। কিন্তু খানা খেতেন না। আর যদি তারা শরিয়তবিরোধী কর্মকা- থেকে বিরত না থাকত তাহলে তিনি বিবাহ না পড়িয়েই চলে আসতেন। বিবাহ অনুষ্ঠানের খাবার যদি তার ঘরে প্রেরণ করা হতো তাহলে নিজে খেতেন না এবং পরিবারের লোকদেরও খাওয়াতেন না; বরং প্রতিবেশী একজন গরিব ধোপী ছিল, তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।
শিক্ষা জীবন : হযরত মুফতি সাহেব (রহ.)-এর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.)-এর নিকট হযরত গাঙ্গুহী (রহ.)-এর কন্যার বৈঠকখানায়, সেখানে হাফেজ করীম বখ্শ (রহ.)-এর নিকট কোরআন কারিম হেফজ করেন। কোরআন হেফজ শেষ করতে মাত্র সতের লাইন বাকি, এমতাবস্থায় হাফেজ করীম বখ্শ (যিনি অন্ধ ছিলেন)-এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। অতঃপর গাঙ্গুহ জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ আব্দুল করীম সাহেবের নিকট হেফজ সমাপ্ত করেন। সে সময় নিজের আগ্রহে উর্দু ভাষাও শিখে নিয়েছিলেন। আর আমদনামা ও বুস্তার কিছু অংশ পড়েছেন মাওলানা ফখরুদ্দীন গাঙ্গহী (রহ.)-এর নিকট। ১৩৪১ হিজরীতে মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে ভর্তি হয়ে সরফে মীর এবং নাহুমীর ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু করে মীর যাহেদ গোলাম ইয়াহইয়া, কাযী মুবারক দিওয়ানে হামাসাহ, দিওয়ানে মুতানাব্বী এবং হামদুল্লাহসহ অন্য কিতাবগুলো পড়েন ১৩৪৭ হিজরি পর্যন্ত। ১৩৪৮ হিজরির শাওয়াল মাসে দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হয়ে হেদায়া আখেরাইন এবং মিশকাত শরিফ অধ্যয়ন করেন। ১৩৪৯ হিজরিতে বায়যাভী, আবু দাউদ এবং মুসলিম শরিফ পড়েন। আর ১৩৫০ হিজরিতে শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী (রহ.)-এর নিকট বুখারি শরিফ ও তিরমিজি শরিফ পড়েন। পরবর্তী বছরে মাজাহেরুল উলুম সাহারানপুরে ভর্তি হয়ে দাওরায়ে হাদিসের সব কিতাব পুনরায় অধ্যয়ন করেন। অতঃপর মাজাহিরুল উলুমেই তাজভীদ এবং কেরাত শাস্ত্র সমাপ্ত করেন।
কর্মজীবন : হযরত মুফতি সাহেব (রহ.) ছিলেন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তার মেধার প্রখরতা ও তীক্ষè বুদ্ধিতে সবাই রীতিমতো অবাক হতো। তার প্রখর মেধাশক্তি ও প্রজ্ঞার ব্যাপারে মুহতারাম উস্তাদগণও ছিলেন সবিশেষ অবহিত। অসাধারণ ইলমী যোগ্যতার পাশাপাশি তাকওয়া, পরহেজগারী, সহনশীলতা, অনাম্বড়তা, সত্যনিষ্ঠ প্রভৃতি সৎ গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে উস্তাদগণের এ বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, এ ছেলের মাধ্যমে দ্বীনের বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দেয়া সম্ভব হবে। তাদের এ বিশ্বাস ও সুধারণা পরবর্তীতে সম্পূর্ণ সত্য হয়েছিল। তিনি ফারেগ হওয়ার পরপরই মুহতারাম উস্তাদগণের পরামর্শ ও নির্দেশক্রমে ১৩৫১ হিজরির জিলকদ মাসের ৪ তারিখে মাজাহিরুল উলুমে মাসিক দশ রুপি বেতনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং ১৩৫৩ হিজরিতে সহকারী মুফতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৩৭০ হিজরি পর্যন্ত মাজাহিরুল উলুমে ওই পদে বহাল থাকেন। এ সময়ের মাঝে মীযানুচ্ছরফ থেকে হেদায়া আওয়ালাইন এবং জালালাইন পর্যন্ত সব কিতাবের দরস প্রদান করেন। সে সময় তিনি হযরত মাওলানা আব্দুর রহমান কামেলপুরী (রহ.), হযরত মাওলানা আবদুল লতিফ (রহ.) এবং শাইখুল হাদিস হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে কামালিয়াতের সকল স্তর অতিক্রম করেন এবং শেষ পর্যন্ত যুগশ্রেষ্ঠ ফেকাহবিদ হতে সক্ষম হন।
মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে দীর্ঘদিন খেদমত করার পর তিনি ১৩৭১ হিজরি থেকে ১৩৮৪ হিজরি পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর যাবত জামেউল উলুম কানপুর মাদরাসায় মুহতামিম, মুফতি ও শায়খুল হাদিসের পদ অলঙ্কৃত করেন। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন