আমাদের সমাজ জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ যেসব দুর্নীতি করেছে সেগুলোর মধ্যে মওজুদদারী একটি মারাত্মক অপরাধ, একে আরবি পরিভাষায় ‘এহতেকার’ বলা হয়। খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সস্তা দামে খারিদ করে চড়া দামে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে জমা করে রাখা মওজুদদারীর অন্তর্ভুক্ত এবং ইসলামের দৃষ্টিতে এটা একটি অতি নিন্দনীয় কাজ।
ইসলাম এর ঘোর বিরোধিতা করে। এই অবৈধ, গর্হিত কার্যকলাপ সম্পর্কে মহানবী (সা:) স্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত ওমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা:) বলেছেন; ‘যে ব্যক্তি মওজুদদারী করে সে পাপী।’ ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা মানবতার উপকার সাধন করে থাকে এবং লোকদেরকে দু:খ-কষ্ট মোচন করে সুখ-শান্তি আনয়ন কররে থাকে, এটাই ইসলামের প্রধান উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ইসলাম তাকে কিছুতেই ক্ষমা করে না। ইসলাম কঠোর ভাষায় মওজুদদারীর বিরোধিতা করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চড়া দামে বিক্রয়ের জন্য ঘরে রাখা মহাপাপ। এই মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের জীবনে নানা দু:খ-কষ্ট এবং মানসিক ও দৈহিক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাই ইসলাম মওজুদদারকে কাঠোর শাস্তি পাওয়ার উপযোগী বলে গণ্য করে। বায়হাকীতে হজরত মাআজ ইবনে জাবাল (রা:) হতে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, এতে মহানবী (সা:) বলেছেন; ‘মওজুদদার অতি নিকৃষ্ট ব্যক্তি, আল্লাহ তায়ালা যদি (জিনিস পত্রের) দাম সস্তা করে দেন, তাহলে এই ব্যক্তি অনুতাপ, দু:খ প্রকাশ করে এবং যদি দাম বাড়িয়ে দেয় তাহলে সে আনন্দিত হয়ে যায়।
যারা মওজুদদরীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের অন্তর হতে খোদাভীতি চলে যায় এবং এটা হয় মানবতার প্রতি তাদের মারাত্মক অত্যাচার। আর যদি এরা কয়েক দিনও মওজুদদারী করে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বিক্রয় বন্ধ করে দেয়, তাহলে মানুষের সংকটের অন্ত থাকে না। এর পরিবর্তে যতই দান-সদকা করা হোক না কেন তাতে কোন কাজ হবে না, জুলুম-অত্যাচারের ক্ষতি পূরণ হবে না। হাদীসগ্রন্থ রজিনে হজরত আবু ওসামা হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূল (সা:) বলেছেন; ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন যাবত খাদ্যদ্রব্য জমা করে রাখে, অত:পর তা দান করে দেয়, তাতে মওজুদদারের পাপ মোচন হয় না।
যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্য মওজুদ করে রাখে, সে একজন বড় অত্যাচারী, মহাপাপী। ইসলাম মানবতার ধর্ম এবং জনসাধারণের কল্যাণই এর প্রধান উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি মানবতার এই অনুপ্রেরণা হতে বঞ্চিত, তার প্রতি আল্লাহর করুণা ও দয়া প্রদর্শিত হবে না। উল্লেখিত রজিন গ্রন্থে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর কর্তৃক বর্ণিত; তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চল্লিশ দিন পর্যন্ত জমা করে রাখে এবং লোকের মধ্যে বিতরণ করেন এবং লোকদেরকে প্রদান না করে সে চড়া দামে সেগুলি বিক্রয় করতে চায়, সে ব্যক্তি আল্লাহ হতে বঞ্চিত হবে এবং আল্লাহও তার মুখাপেক্ষী নন।’ অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি যখন বান্দার হক উপেক্ষা করে লোকদের অতিষ্ঠ করে তোলে, তার সাথে আল্লাহর আর কোন সম্পর্ক থাকে না। মানুষের সাথে যে ব্যক্তি সদাচরণ প্রদর্শন করে থাকে, আল্লাহর সম্পর্কও তার সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে। অত্যাচারীর সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকে না। ইবনে মাজায় হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা:) হতে বির্ণত হয়েছে যে, নবী করীম (সা:) মওজুদদারের জন্য বদদোয়া করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য বন্ধ রাখে, আল্লাহতায়ালা তাকে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ও অভাব-অনটনে পতিত করুন।’ অর্থাৎ তার ওপর আর্থিক ও শারীরিক বিপদ-আপদে লিপ্ত করুন এবং রোগ ও অভাবের শাস্তি দান করুন।
যে রূপে আল্লাহর নিকট মওজুদদার কঠিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, অনুরূপভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিভিন্ন শহরে ও বিভিন্ন দেশে পাচারকারীও আল্লাহর নিকট অতি নিন্দনীয়। এই প্রসঙ্গে বোখারী ও ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত উমর ফারুক (রা) নবী করীম (সা:) এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন; ‘মাল পল্লী এলাকায় ও শহরে-বন্দরে প্রেরণকারীকে আল্লাহর অফুরন্ত ধনভাÐার হতে দান করা হয় এবং মওজুদদারদের প্রতি অভিশাপ ও শাস্তি প্রদান করা হয়। এ সমস্ত হাদীস সামাজিক ধরণের, এগুলো সম্পূর্ণভাবে মানবতার সাথে জড়িত। যারা মওজুদদারী কারবারে লিপ্ত, তারা মানবতার শত্রæ। এদের দমনের জন্য কঠোরতর ব্যবস্থা অবলম্বন করা কর্তব্য। অবৈধ মোনাফা লোভীরা নিজেদের অজ্ঞতাবশত মনে করে থাকে যে, তারা অর্থ উপার্জনে অন্যান্যদের চাইতে অধিক চালাক কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে, অন্য কারণে তাদের প্রচুর ক্ষতি সাধিত হয়ে থাকে। মওজুদদার আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি ভোগ করে এবং তার উপার্জিত সমুদয় অর্থ বেকার হয়ে যায়।
মানুষ বহু পাপ কাজ করে, কোন কোন পাপ কেবল নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, আল্লাহ তাআলা তা ক্ষমাও করে দিতে পারে।
কোন কোন পাপের শাস্তি না দিয়ে আল্লাহতায়ালা ক্ষান্ত হন না এবং এই আয়াতগুলো নাজেল হওয়ার পর মদীনাবাসীরা তাদের এই অভ্যাস পরিত্যাগ করে ঠিক ঠিক পরিমাপ করতে থাকে। ইবনে আবি হাতেমে বর্ণিত হয়েছে যে, হজরত হেলাল ইবনে তাল্লেক একদা হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) কে বললেন যে, মক্কা ও মদীনা বাসীরা উত্তম মাপ করে। ইবনে উমর (রা:) বললেন; এরূপ কেন করবে না যখন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেছেন; ‘মাপ-ওজনে কম-বেশি করে যারা, সর্বনাশ তাদের জন্য।’ যারা জিনিস পত্রের পরিমাপে কম দিয়ে ব্যবসা করে, তাদের মুনাফালব্ধ অর্থ হারাম উপার্জনেরই অংশ বিশেষ এবং এই দুর্নীতির ফলে তাদের সমগ্র মুনাফাটাই দূষিত হয়ে যায়, যা আল্লাহর নিকট অপবিত্র এবং ঘৃণিত। তাই হুজুর (সা:) বলেছেন; ‘মানুষের নিকট এমন এক যুগ আসবে যখন তারা হালাল-হারামের কোন তোয়াক্কা করবে না, যা হাতে আসবে তাই অর্জন করবে।’ (বোখারী)। এই হারাম মাল ও হারাম উপার্জন সম্বন্ধে হুজুর (সা:) বলেছেন, ‘যে দেহে হারাম খাদ্য প্রবেশ করেছে তা জান্নাতে প্রবেশ করতে না।’ (মেশকাত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন