শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পদ্মার ভাঙন প্রতিরোধ কাজে শুভঙ্করের ফাঁকি

এডিবি কনসালট্যান্টের অতি খবরদারিতে নকশায় পরিবর্তন

প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : গতি নেই কাজে। যেভাবে চলছে তাতে করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করাটা অসম্ভব। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও নাখোশ। পদ্মা নদীর ভাঙন থেকে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা রক্ষা প্রকল্পের এমন বেহাল দশার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে কাজের মূল নকশায় পরিবর্তন। প্রকল্পটির অর্থ জোগানদাতা সংস্থা এডিবি’র (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) কনসালট্যান্টদের চাপের মুখেই নকশায় এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে করে কাজের পরিধি বাড়লেও প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে চলছে গড়িমসি। অন্যদিকে, স্থানীয় জনরোষ ধামাচাপা দিতে এ কাজে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এতে করে শুধু অর্থেরই অপচয় হবে; কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প তার কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।
এই প্রকল্পের সার্বিক পরিস্থিতি থেকে দেখা যায়, শুরু থেকেই কাজের গতি ছিল মন্থর। বর্তমানে পদ্মার পানি বাড়ছে এবং এখানে বড়জোর আর ১৫ দিন কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। এর পরই বর্ষা শুরু হয়ে যাবে। তখন প্রকল্প এলাকায় ভাঙনের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে যতটুকু কাজ এই শুষ্ক মৌসুমে সম্পন্ন হয়েছে, তার কতটুকু আগামী শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত টিকে থাকবেÑএ প্রশ্ন এলাকাবাসীর মধ্যে। হরিরামপুর বাজারে বসে কথা হয় বয়স ষাট পেরিয়ে যাওয়া স্থানীয় মনতাজ মাদবরের সাথে। তিনি জানান, পদ্মার ভাঙনে তার পৈতৃক বসতবাড়ি দু’বার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। তার মতে, কয়েক বছর আগেও দরিকান্দিতে ব্লক বিছানো হয়েছে। কিন্ত যেভাবে কাজ হওয়ার কথা সেভাবে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় সবকিছুই এখন নদীগর্ভে। বর্তমানে যেভাবে কাজ চলছে, এই কাজও আসন্ন বর্ষা পাড়ি দিয়ে টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করেছেন মনতাজ মাদবর।
পদ্মার ভাঙনরোধে চলমান নদীতীর সংরক্ষণ কাজের ব্যাপারে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন বলেন, এই প্রকল্পের কাজে চলছে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি। যেভাবে কাজ চলছে তাতে এক যুগেও এটা শেষ হবে না। বরং আসন্ন বর্ষা পাড়ি দিয়ে আগামী শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত এই কাজ টিকে কিনা সময়ই তা বলে দেবে। তিনি বলেন, কাজ শুরুর পর যেভাবে নকশা বদলানো হলো, এটা আমরা প্রত্যাশা করিনি। পুরো ৩ কিলোমিটার এলাকা বাদ দিয়ে কাজ চলছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
পাউবো থেকে জানা যায়, এমএম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এখানে দুটি প্যাকেজে কাজ করছে। ডিপিপি অনুযায়ী, ৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের শুরু ও শেষ যথাক্রমে রামকৃষ্ণপুর থেকে হারুকান্দি ইউনিয়ন পর্যন্ত। নকশা পরিবর্তন হওয়ায় প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা বাদ দিয়ে কাজ চলছে। শূন্য থেকে সাত কিলোমিটার পর্যন্ত কাজ করার অনুমতিপত্র থাকলেও পরিবর্তিত নকশায় কাজের পরিধি দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে দশ কিলোমিটার। এই সাড়ে তিন কিলোমিটার বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজ নিয়েও চলছে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিলের মধ্যে এই কাজ সম্পন্ন হওয়ার বিষয়টি চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কাজের গতি প্রমাণ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নয়।
জানা যায়, পদ্মা নদীর ভাঙন থেকে হরিরামপুর উপজেলা, রামকৃষ্ণপুর, দরিকান্দি, হারুকান্দি ইউনিয়ন, আন্ধারমানিক বাজার, বয়রা ইউনিয়ন রক্ষায় প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। নানা চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে ২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট এই কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। তখন এই প্রকল্পের টেন্ডার নকশায় নদীতীর থেকে জিও ব্যাগ ডাম্পিং সীমা ছিল ৫০ মিটার। পরবর্তীতে ওয়ার্কি ড্রইংয়ে নদীতীর থেকে ডাম্পিং এরিয়া ধরা হয় ৫৯ মিটার। গত ১৬ মার্চ নতুন নকশায় কাজের ভিত দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। এতে নদীতীর থেকে জিও ব্যাগ ডাম্পিং এরিয়া ধরা হয়েছে মাত্র ১৫ মিটার। অর্থাৎ ৪৪ মিটারই নেই। এই যে শুভঙ্করের ফাঁকি, এ নিয়ে নানাভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে স্থানীয় জনগণ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারও এতে খুশি নন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, নতুন নকশা অনুযায়ী, কাজ করার অর্থ ৫০ কোটি টাকা পদ্মায় ফেলে দেয়া। যে উদ্দেশ্য সাধনে এই প্রকল্প তার সুফল স্থানীয় অধিবাসীরা পাবে না। তাছাড়া এরকম দুর্বল কাজ কেন করা হচ্ছে, তাও ওই কর্মকর্তার বোধগম্য নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শূন্য থেকে ৩ কিলোমিটার এলাকা বাদ দিয়ে এই প্রকল্পের নতুন নকশা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সকলকে খুশি করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সে মোতাবেক কাজের শক্তিশালী ভিতকে দুর্বল করে ডাম্পিং এরিয়া ৫৯ মিটার থেকে কমিয়ে ১৫ মিটারে আনা হয়। মূলত এডিবি’র কনসালট্যান্ট টিম প্রধান ক্যানুড আপত্তি তোলেন এই বলে যে, শূন্য থেকে ৩ কিলোমিটারের মাঝে যে চর পড়েছে তা সংশ্লিষ্ট এরিয়াকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করবে। তার  আপত্তির কারণেই নকশায় পরিবর্তন আনা হয় এবং কাজের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ক্যানুড যে তত্ত্ব দিয়ে এই ৩ কিলোমিটার এলাকা বাদ রেখে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন, ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে জোরেসোরেই ভাঙন চলছে এবং এলাকাবাসীর ঘরবাড়ি, আবাদি জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মো. আমিনুল হক বলেন, এই কাজের কন্ট্রাক্ট ভেরিয়েশন প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বর্ধিত সাড়ে ৩ কিলোমিটারের কাজের অতিরিক্ত অর্থ কাজের অংশ হিসেবেই ধরা হবে। এক্ষেত্রে নতুন করে কোনো টেন্ডারের প্রয়োজন হবে না। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারই এটি করতে পারবেন। নকশা পরিবর্তন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এডিবি’র কনসালট্যান্টরা যেটি ভালো মনে করেছেন, তারা সেই সিদ্ধান্তই দিয়েছেন। এখানে আমাদের করার কিছু নেই। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন