শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আষাঢ়ে গল্প!

নূরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৮, ১২:৩৯ এএম

৫ জুলাইয়ের ঘটনা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশানে অভিযান চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর একটি বিলাসবহুল গাড়ি আটক করে। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮ এর ২০১৩ মডেলের গাড়িটি ৪৬০৮ সিসির। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেন ওই গাড়ির মূল্য ৫ কোটি টাকা। উদ্ধারকৃত বিলাসবহুল সেই গাড়ির ছবিসহ সংবাদ পরদিন প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। মালিকবিহীন ৫ কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি বলে কথা! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮, ২০১৩ মডেলের গাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। ৯০ লাখ টাকার গাড়ি মূল্য ৫ কোটি টাকা দাবি করে সস্তা বাহাবা নিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তাদের আজ্ঞাবহ মিডিয়াগুলোও এ নিয়ে প্রচারে পিছুপা হয়নি।
বছরজুড়ে এরকম বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধারের বহু ঘটনা ঘটে। এর বেশিরভাগই আষাঢ়ে গল্প। কোটি কোটি টাকা মূল্যের উদ্ধারকৃত এসব গাড়ি শেষ পর্যন্ত কি হয়? কোথায় যায়? কবে নিলাম হয়? কতো টাকায় নিলাম হয়? তা কেউ জানে না। রাজধানীর বারিধারা এলাকার এক গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে এরকম বাহাবা কুড়ানো কোটি কোটি টাকা মূল্যের কমপক্ষে ৭টি গাড়ি পড়ে আছে বহুদিন ধরে। বৃষ্টি আর কাদায় সেগুলোর ভাঙ্গারীতে পরিণত হয়েছে। অথচ এই গাড়িগুলো যখন উদ্ধার দেখানো হয় তখনও মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ থেকে সরবরাহকৃত কাগজে ‘উদ্ধারকৃত গাড়ির তালিকায়’ চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত ১২টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। ১২টি গাড়ির মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। এই হিসাবে একেকটি গাড়ির মূল্য আড়াই কোটি টাকা। তবে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে গত ৪ জুলাইয়ে দেয়া এক পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, সাভার পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুণর্বাসন কেন্দ্র সিআরপি থেকে ১১টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। যেগুলোর মূল্য ৩০ কোটি টাকা। তাহলে বাকী আরেকটি গাড়ি কোথা থেকে উদ্ধার হলো? নাকি উদ্ধার হয়নি? জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ১১টির স্থলে ১২টি গাড়ির তথ্যের মধ্যে ভুলও হতে পারে।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সরবরাহকৃত আরেক লিখিত তথ্যে দেখা গেছে, চলতি মাস পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর মোট ৮২টি বিলাসবহুল গাড়ি আটক করেছে। যার মধ্যে পোরসা, মার্সিডিস বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, লেক্সাস, জাগুয়ার ব্র্যান্ড, ঘোস্ট মডেলের রোল্স রয়েলস, টয়োটা সিডান গাড়ি রয়েছে। উদ্ধারকৃত ৮২টি গাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে গাড়িপ্রতি মূল্য ধরা হয়েছে গড়ে ৯১ লাখ টাকা। আগের হিসাবের সাথে এ হিসাবের গড়মিলই বলে দেয় উদ্ধারকৃত গাড়ির মূল্য নিয়ে দেয়া তথ্যের হেরফের আছে।
শুল্ক গোয়েন্দা বাংলাদেশের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ জুলাই বুধবার বিকেলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একটি দল সাভার পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুণর্বাসন কেন্দ্র সিআরপিতে অভিযান চালিয়ে ১১টি বিলাসবহুল গাড়ি আটক করে। জব্দকৃত গাড়ির আনুমানিক মূল্য ৩০ কোটি টাকা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক ড. মোঃ সহিদুল ইসলাম এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঐ অভিযানে নেতৃত্ব দেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী মুহম্মদ জিয়া উদ্দিন।
উদ্ধারকৃত গাড়িগুলোর ছবিসহ এ সংক্রান্ত পোস্টে বলা হয়, “যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)-এর নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ১৯টি গাড়ি দুই বছর আগে সিআরপি এর গ্যারেজে রাখা হয়। এর মধ্যে দুই দফায় ৮টি গাড়ি সরিয়ে নেওয়া হলেও অবশিষ্ট গাড়িগুলো শুল্ক ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে রাখা হয়। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুণর্বাসনকেন্দ্র সিআরপি’র বরাতে জানা যায়, অনেক আগে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) সিআরপির বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল। সেই সুবাদে ২০১৬ সালের ২৭ জুন মাত্র ৬ মাসের জন্য ডিএফআইডি গাড়িগুলো রেখে যায়। তারপর থেকে ডিএফআইডি দুই দফায় ৮টি গাড়ি সরিয়ে নিলেও বাকিগুলো নেয়নি। পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপির হেড অব সাপোর্ট সার্ভিস শহিদুর রহমান সূত্রে জানা যায়, গাড়িগুলো সরিয়ে নেয়ার জন্য বহুবার সিআরপি হতে ডিএফআইডি-কে মেইল দিলেও ডিএফআইডি কোন সাড়া দেয়নি।”
উদ্ধারকৃত গাড়িগুলোর ছবিসহ ফেসবুকের সেই পোস্টে অনেকেই কমেন্ট করেছেন। মোহাম্মদ জিসান নামে একজন লিখেছেন, ‘এগুলো নাকি বিলাস বহুল গাড়ি। শালার কি যুগ আসলো, পেইজের অ্যাডমিনগুলো মনে হয় গাঁজা টানে। মনিরুজ্জামান নামে একজন লিখেছেন, ‘এইগুলো নাকি বিলাসবহুল গাড়ি। এরা বিলাসবহুল গাড়ির ডেফিনিশন-ই জানে না। এই সব বস্তাপঁচা গাড়ি নাকি বিলাসবহুল গাড়ি, যত্তসব....। তিনি আরও লিখেছেন, নিলামে উঠালেই বোঝা যাবে কয় টাকা দর ওঠে। সিসি বেশি হলে তো ৭ টনের ট্রাক সবচেয়ে বেশি বিলাসবহুল! শাহেদ ইকবাল নামে একজন লিখেছেন, ‘‘এই গাড়ি রেকার দিয়ে টানতে যেকয় টাকার তেল গেছে, গাড়িগুলো বিক্রি করে ওই টাকাও উঠানো যাবে না।’’ তিনি আরেক কমেন্টে লিখেছেন, ‘৩০ কোটি টাকার গাড়ি ৩০ হাজারে বিক্রি করতে কষ্ট হবে।’
রাজধানীর গুলশান সংলগ্ন বারিধারা এলাকার একটি গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ৭টি বিলাসবহুল গাড়ি বহুদিন ধরে পড়ে আছে। এর মধ্যে মার্সিডিস ৪টি। বাকীগুলো বিএমডবিøউ, এবং ওডি। গ্যারেজের একজন কর্মচারি বলেন, বিলাসবহুল বলা হলেও গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ৭টি মধ্যে একটা গাড়ি কোনোমতে সচল করা যেতে পারে। এই গ্যারেজে বর্ষায় পানি জমে থাকে। কয়েক দফা সেই পানিতে গাড়িগুলো একেবার নষ্ট হয়ে গেছে। ওই কর্মচারি জানান, শুল্ক বিভাগের লোকজন এই গাড়িগুলো জব্দ দেখিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। এগুলো রাখতে গিয়ে গ্যারেজের মালিককে দীর্ঘদিন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অচল হওয়ায় গাড়িগুলোকে ঠেলে নিতেও সমস্যা। ৭টি গাড়ির দাম কতো হবে জানতে চাইলে ওই গ্যারেজের কর্মচারি বলেন, এগুলোর আর বিক্রির মতো অবস্থা নেই। ৭টি গাড়ি ৭ লাখ টাকা দিয়েও কেউ কিনবে না। এমনকি এগুলোর যন্ত্রাংশগুলোও আর বিক্রি করা সম্ভব নয়।
জানা গেছে, রাজধানীর গুলশান-বারিধারার অনেক গ্যারেজেই এরকম ‘বিলাসবহুল’ গাড়ি আছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে মালিক গাড়ি রাস্তায় বের করতে না পেরে মেরামতের কথা বলে কোনো গ্যারেজে নিয়ে রাখে। এরপর ‘নেই’ ‘নিচ্ছি’ করে আর আসেনা। খবর পেয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা গ্যারেজে গিয়ে সেই গাড়িকেই অভিযানে ‘উদ্ধার’ বলে দাবি করে থাকেন। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের জব্দ তালিকাভুক্ত হওয়ার পর সেই গাড়িগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েন গ্যারেজ মালিকরা। তারা তখন গাড়িগুলো সরাতেও পারেন না, আবার গাড়ির কোনো ক্ষতির জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বারিধারা এলাকার স্বদেশ অটো নামে একটি প্রতিষ্ঠান উদ্ধারকৃত এমন গাড়ি নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছে। গত ১৪ জানুয়ারী শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে স্বদেশ অটো লিমিটেড উদ্ধারকৃত চারটি গাড়ি সরিয়ে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, উদ্ধারকৃত বিলাসবহুল ওই চারটি গাড়ির মালিক ছিল এমপি ইয়াহিয়া চৌধুরী, হাবিব শেখ, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক কাজী হায়াতের ছেলে চিত্রনায়ক কাজী মারুফ এবং জনৈক সিরাজুল ইসলাম। জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে একজন কর্মচারি বলেন, আমরা শুল্ক কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অনুরোধ করার পরেও তারা কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় গাড়িগুলো নিয়ে ঝামেলায় আছি। তারা ইচ্ছা করলে এগুলো তাদের ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে গেলেই পারে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মোঃ সহিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা বিলাসবহুল গাড়িগুলো মূলত জব্দ করা হয়। এরপর সেগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার কাস্টমস হাউসে জমা দেয়া হয়। কেউ গাড়ির মালিকানা দাবি করলে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তা নিষ্পত্তি করা হয়। দাবিদার না থাকলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে নিলামে বিক্রি করা হয়। তবে তিনি স্বীকার করেন, নিলাম প্রক্রিয়া আসতে অনেক দিন সময় লাগে। গাড়িগুলো তখন আর গাড়ি থাকে না। একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।
গত ৫ জুলাই গুলশান থেকে উদ্ধার করা গাড়ির মূল্য ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। কিন্তু শুল্ক কর্তৃপক্ষ ওই গাড়ির মূল্য ৫ কোটি টাকা দাবি করেছে। এতোটা বেশি কেনো দাবি করা হলো-এ প্রশ্নের জবাবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত মহাপরিচালক ড. মোঃ সহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আছে। তিনি বলেন, গাড়িটি আনা হয়েছিল আরও ৫ বছর আগে। তখন এর মূল্য ছিল প্রায় ৫ কোটি টাকা। আমরা সেটাই বলেছি। এখন ওই মডেল পুরনো হওয়াতে মূল্য কমে যেতেই পারে। ###

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
ঝর্ণা ১৭ জুলাই, ২০১৮, ২:৫৪ এএম says : 0
এরকম আরও কত গল্প যে আমরা প্রতিনিয়ত শুনি তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
Total Reply(0)
মাসুদ ১৭ জুলাই, ২০১৮, ২:৫৪ এএম says : 0
এই সত্যগুলো তুলে ধরায় নূরুল ইসলাম সাহেবকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
সেলিম উদ্দিন ১৭ জুলাই, ২০১৮, ২:৫৫ এএম says : 0
এর নাম সাংবাদিকতা। এখন দেশে অনেক সাংবাদিক আছে যারা শুধুমাত্র তেল মারার কাজে নিজেদেরকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখেন।
Total Reply(0)
পাপিয়া মনি ১৭ জুলাই, ২০১৮, ২:৫৮ এএম says : 1
দিনের পর দিন এরা দেশের মানুষগুলোকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন