মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

তরঙ্গ বরাদ্দে ৮৪০ কোটি টাকা ক্ষতি অডিট আপত্তি সঠিক নয় -বিটিআরসি

প্রকাশের সময় : ২৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ফারুক হোসাইন : অনিয়ম ও ৮৪০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির কথা তুলে তিন মোবাইল অপারেটরকে তরঙ্গ বরাদ্দ প্রক্রিয়ার অডিট আপত্তি করে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল। কোন নবায়ন ফি ছাড়াই অতিরিক্ত ১৫ বছরের জন্য তরঙ্গ বরাদ্দের বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব এবং সন্তোষজনক না হলে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে পাওনা আদায় করার কথা বলে ১০ম জাতীয় সংসদের সরকারী হিসাব বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। তবে অডিট আপত্তি ও আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি যথার্থ নয় বলে জানিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (বিটিআরসি)। যে সময়ে (২০০৮ সালে) তরঙ্গ বরাদ্দে অডিট আপত্তি করা হচ্ছে তা ২০০৫ ও ২০১১ সালে নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় অধিকতর যৌক্তিক বলেও মন্তব্য করা হয় কমিশনের সভায়। বিটিআরসি ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জ্ঞান ও সাধ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করে পূর্ণ আন্তরিকতা এবং সরল বিশ্বাসে ওই মূল্য নির্ধারণ করে। একইসাথে অডিট আপত্তি বিষয়ে ব্যক্তির পরিবর্তে কমিশনের পক্ষ থেকে ১০ম জাতীয় সংসদের সহকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে ব্যাখ্যা প্রদানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। কমিশনের সর্বশেষ সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
২০০৮ সালে অনিয়ম ও ৮৪০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির মাধ্যমে তিন মোবাইল অপারেটরকে তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয় উল্লেখ করে ওই প্রক্রিয়ায় অডিট আপত্তি করা হয়। অডিট আপত্তির কারণে অপারেটরদের মাঝে জিএসএম ব্যান্ডে তরঙ্গ বরাদ্দের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত কমিটির কাছে ব্যাখ্যা চায় সংসদীয় সহকারি হিসাব কমিটি। ওই সময় তরঙ্গ বরাদ্দ প্রক্রিয়ার কমিটিতে তৎকালীন বিটিআরসি চেয়ারম্যান, কমিশনার, মহাপরিচালক, পরিচালক ও সহকারী পরিচালকগণ ছিলেন। অডিট আপত্তিতে কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল এবং ১০ম জাতীয় সংসদের সরকারী হিসাব কমিটি তরঙ্গ বরাদ্দে অনিয়মের কারণে একুইজিশন ফি বাবদ সরকরের ৮৪০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির কথা জানায়। কোন নবায়ন ফি ছাড়াই অতিরিক্ত ১৫ বছরের জন্য পুনরায় নবায়নের বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব এবং ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে পাওনা আদায় করার কথা বলা হয়।
বিষয়টি নিয়ে কমিশনের সর্বশেষ সভায় আলোচনার পর ইতোমধ্যে ব্যাখ্যা পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে টেলিযোগাযোগ সেবা বিস্তারের জন্য ওই তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ভৌগলিক, আর্থ-সামাজিক, কারিগরি ইত্যাদি অনেক বিষয় বিবেচনা করে তরঙ্গের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কারণ তরঙ্গের মূল্য নির্ধারণ একটি জটিল ও বিশেষায়িত বিষয়। জিডিপি, কমিউনিকেশনের ধরণ, তরঙ্গের চাহিদা ও যোগান, জনসংখ্যা, তরঙ্গ ব্যবহারের দক্ষতা, চার্জ পরিশোধের সম্মতি, কমিউনিমেশন সেবার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, জনসংখ্যা প্রতি মেগাহার্টজে মূল্য ইত্যাদি মূলনীতি অনুযায়ী তরঙ্গের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
অডিট আপত্তি প্রসঙ্গে বলা হয়, অপারেটরদের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তরঙ্গের একুইজিশন ফি ৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। যদিও অপারেটরদের লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১১ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল, তারপরও প্রাথমিক অবস্থায় ৩ বছরের জন্য তরঙ্গ বরাদ্দের জন্য তিন অপারেটর (গ্রামীণফোন, ওরাসকম এবং টিএমইবি) কে প্রস্তাব করলেও তারা আগ্রহী হয়নি। ফলে লাইসেন্স নবায়ন সাপেক্ষে শুধুমাত্র টুজি প্রযুক্তিতে ব্যবহারের শর্তে ১৮ বছরের জন্য অপারেটরদের তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। এর আগে অডিট আপত্তিতে বলা হয়, ৩টি মোবাইল অপারেটরকে লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ১০ নভেম্বর ২০১১ তারিখে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে জানা সত্ত্বেও অনিয়মিতভাবে অতিরিক্ত ১৫ বছরের জন্য ফ্রিকুয়েন্সী বরাদ্দ দেয়ায় সরকারের ৮৪০ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। ২০০৯-১০ সাল সময়ে লাইসেন্সিং কার্যক্রমের উপর বিশেষ নিরীক্ষাকালে অপারেটরদের লাইসেন্স সংক্রান্ত নথি ও ফ্রিকুয়েন্সী বরাদ্দ সংক্রান্ত এই অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসে। গ্রামীণফোন, বাংলালিংক এবং একটেল এই তিনটি কোম্পানিকে মোট ১২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ১৮ বছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। যার প্রতি মেগাহার্টজ এর মূল্য ৮০ কোটি টাকা। এই তরঙ্গের মধ্যে ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর গ্রামীণফোনকে ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ ও বাংলালিংককে ২ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ বরাদ্দ দেয়া হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর একটেলকে ২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু অপারেটরগণ লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুনরায় মেয়াদ বৃদ্ধি করবে কিনা তার সিদ্ধান্ত পাওয়ার আগেই ১৮ বছরের জন্য তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়। ফলে ২০১১ সালের ১০ নভেম্বরের পর থেকে অতিরিক্ত ১৫ বছরের জন্য ফ্রিকুয়েন্সীর সুবিধা ৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। অথচ ওই সময় এর মূল্য ছিল ১৫০ কোটি টাকা। ফলে প্রতি মেগাহার্টজে ৭০ কোটি টাকা করে কম মূল্য নির্ধারণ করায় সরকার ৮৪০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
এই বিষয়ে অডিট আপত্তি করা হলে বিটিআরসি যে জবাব প্রদান করে তা অডিট প্রতিষ্ঠানের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। বিষয়টি ১০ম জাতীয় সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থাযী কমিটির ২৯তম সভায় আলোচনা হয়। ওই কমিটি অডিট আপত্তির সাথে একমত পোষণ করে এবং আপত্তিকৃত অর্থ আদায় না করে যারা গ্রামীণফোন, বাংলালিংক এবং একটেল (বর্তমানে রবি) কে ২০১১ সাল পর্যন্ত লাইসেন্সের মেয়াদ কোনরূপ অতিরিক্ত নবায়ন ফি ছাড়া লাইসেন্সের মেয়াদ ১৫ বছর শেষ হওয়ার তিন বছর আগে ১৮ বছরের জন্য পুনরায় নবায়ন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কেন যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে ৬০ দিরে মধ্যে পাওনা আদায় করতে বলা হয়।
এর আগে ২০০৫ সালে তরঙ্গ মূল্য নীতিমালা প্রণয়ন করে বিটিআরসি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে বিটিআরসি প্রতি তরঙ্গের মূল্য ৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে কমিশন সেলুলার মোবাইল ফোন অপারেটর রেগুলেটরি এন্ড লাইসেন্সিং গাইডলাইন ২০১১ প্রণয়ন করে। এই গাইডলাইনে জিএসএম ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের প্রতি মেগাহার্টজ এর মূল্য ১৫০ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ অনুযায়ী মার্কেট কম্পিটিশন ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করে অপারেটরদের লাইসেন্সের শর্তানুযায়ী বিটিআরসি ২০০৮ সালে বরাদ্দ দেয়া মেগাহার্টজের মূল্যের সাথে বর্তমান মূল্যের সমন্বয় করতে পারে। যেহেতু অপারেটরদের লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর শেষ তাই তাদের তরঙ্গ বরাদ্দ ওই তারিখ পর্যন্ত নেয়াই আইনসম্মত বলা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তরঙ্গ বরাদ্দের রেকর্ডপত্রের তথ্য থেকে জানা যায়, ওই সময় তরঙ্গের মূল্যে এককালীন একুইজিশন ফি ধার্য করা হয়নি। ২০০৫ সালের ২০ডিসেম্বর ওয়ারিদ টেলিকম ইন্টারন্যাশনাল (বর্তমানে এয়ারটেল) কে লাইসেন্স প্রদানের সময় প্রথমবারের মতো লাইসেন্সে একুইজিশন ফি বাবদ ৩৩৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়। প্রতিষ্ঠানটিকে জিএসএম ১৮০০ মেগাহার্টজে ১৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। এই হিসেবে প্রতি মেগাহার্টজের মূল্য হয় ২২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এরআগে দেশে সেলুলার ফোন প্রযুক্তির বিকাশের জন্য গ্রামীণফোন, ওরাসকম (বর্তমানে বাংলালিংক), টিএমইবি (বর্তমানে রবি), সিটিসেল এবং টেলিটককে বিনামূল্যে তরঙ্গ (এক্সেস এবং মাইক্রোওয়েভ) প্রদান করা হয়।
২০০৫ সালে ওরাসকম টেলিকম ও ওয়ারিদ টেলিকম ব্যাপক বিনিয়োগ করলে টেলিকম মার্কেটে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং দ্রুত গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্রামীণফোন ১০ মেগাহার্টজ এবং বাংলালিংক ও রবি আজিয়াটা ৫ মেগাহার্টজ করে তরঙ্গ বরাদ্দ চেয়ে বিটিআরসি’র কাছে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আবেদন করে। ২৯ অক্টোবর ২০০৮ সালে জিএসএম ১৮০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ গ্রামীণফোনের অনুকূলে ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ, ওরাসকমের ৫ দশমিক ১ মেগাহার্টজ ও টিএমইবি’র অনুকূলে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। যার মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গ ৮০ কোটি টাকা। অপারেটরদের লাইসেন্স মেয়াদ ২০১১ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকায় প্রাথমিকভাবে ৩ বছরের জন্য তরঙ্গ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। তবে গ্রামীণফোন, ওরাসকম ও টিএমাইবি এই অর্থের বিনিময়ে মাত্র ৩ বছরের জন্য ক্রয় করতে আগ্রহী ছিল না। এরফলে ৩ বছর পর অপারেটরদের লাইসেন্স নবায়ন সাপেক্ষে শুধু ২জি অপারেটর হিসেবে ১৮ বছরের জন্য তরঙ্গ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তরঙ্গ মূল্য অধিক হওয়ায় গ্রামীণফোন ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনলেও ওরাসকম ২ দশমিক ৬ ও টিএমাইবি ২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনে।
অডিট আপত্তিতে বলা হয়, ২০১১ সালে লাইসেন্স নবায়নের সময় ১২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ অপারেটর তিনটিকে ১৫০ কোটি টাকা মূল্যে দেয়া হয়। ফলে ২০০৮ সালে ৮০ কোটি টাকা মূল্যে ২০২৬ সাল পর্যন্ত তরঙ্গ বরাদ্দে অনিয়ম ও ৪৮০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। তবে বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৬ সালে এয়ারটেলকে ২২ দশমিক ২ কোটি টাকা মূল্যে প্রতি মেগাহার্টজ ১৫ বছরের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০০৮ সালে তার প্রায় চারগুণ মূল্যে ৮০ কোটি টাকায় বরাদ্দ দেয়া হয়। আবার ২০১১ সালে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে ১৫০ কোটি টাকায় তরঙ্গ বরাদ্দ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তরঙ্গের মূল্যবৃদ্ধির হার ও তৎকালীন বিশ্ব বাজারে তরঙ্গের মূল্যের তুলনায় কোন অংশে কম ছিল না। অডিট আপত্তিতে যে আর্থিক ক্ষতির কথা বলা হয়েছে তা সঠিক নয়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন