মদকে হাদিসে বলা হয়েছে ‘উম্মুল খাবায়েস’ অর্থাৎ সকল প্রকারের অনাচারের উৎস। মদ মানব জীবনকে সর্ব দিক দিয়ে অচল ও পঙ্গু করে দেয়ার প্রধান উপাদান। মদের অনিষ্টকারী ও ক্ষতিকর দিকগুলোর ন্যায় মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আরো অনেক খাদ্যবস্তু আল্লাহ হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এ হারাম খাদ্যসামগ্রীর দ্বারা হৃষ্টপুষ্ট মানুষের কোনো ইবাদত-বন্দেগি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, আল্লাহ মানুষের কল্যাণই কেবল কামনা করেন, অকল্যাণ ও ক্ষতি নয়।
এখানে বিশেষভাবে মদ তথা নেশাজাতীয় খাদ্যদ্রব্যের কথাই ধরা যাক। মদের ব্যবহার নতুন কোনো বিষয় নয়। এর প্রচলন আদিকাল থেকেই চলে আসছে। আরবের জাহেলি যুগে মদের ব্যবহার ছিল অস্বাভাবিক ও ব্যাপক, একই সঙ্গে জুয়াও। এ দু’টি বস্তু ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। ইসলামের আগমনের পরও মদ ও জুয়া পূর্ণ মাত্রায় চালু ছিল। তাই প্রশ্ন দেখা দেয় মদ ও জুয়া সম্পর্কে। এ দু’টি নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোরআনে কয়েকটি আয়াত নাজিল হয়। যেমন-
০১. লোক আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দিন, উভয়ের মধ্যে আছে মহা পাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও। কিন্তু উহাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক। (সূরা: বাকারা, আয়াত-২১৯)
এতদসংক্রান্ত এটি প্রথম আয়াত। এটি মদ নিষিদ্ধ হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করলেও এতে নিষিদ্ধ হওয়ার অর্থাৎ পরিত্যাগ করার নির্দেশ ছিল না। আয়াতটি শ্রবণ করার পর হজরত উমর (রা:) দোয়া করলেন, ‘আল্লাহুম্মা বাইয়্যিন লানা বায়ানান শাফিয়ান।’ ‘হে আল্লাহ! (এ সম্পর্কে) আমাদের জন্য বিশদ বর্ণনা দান করুন।’
০২. অত:পর দ্বিতীয় আয়াত নাজিল হয়, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু লা তাকরাবুছ সালাতা, ওয়া আনতুম সুকারা।’ ‘হে মোমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের (নামাজের) নিকটবর্তী হয়ো না। (সূরা নিসা, আয়াত-৪৩)
এ আয়াতেও মদ নিষিদ্ধের কোনো ব্যাখ্যা ছিল না, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়ার নিষেধাজ্ঞা ছিল, মদ নিষিদ্ধ বলা হয়নি। হজরত উমর (রা:) আবারো বর্ণিত দোয়া করলেন। অত:পর আয়াত নাজিল হয়। যার অর্থ
০৩. ‘হে মোমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ধারক সব ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ ‘শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতাও ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে (নামাজে) বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’ (সূরা মায়িদাহ, আয়াত : ৯০-৯১)
এটি হচ্ছে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার প্রথম আয়াত। হজরত উমর (রা:) আয়াতটি শ্রবণ করা মাত্র চিৎকার করে বলে উঠেন, ‘ইন্তাহাইনা, ইন্তাইনা’। অর্থাৎ- ‘আমরা বর্জন করলাম, আমরা বর্জন করলাম।’
এ আয়াতে মদ ও জুয়ার সাথে ‘আনছাব ও আজলাম’ যোগ করে দেয়া হয়। ‘আনছাব’ অর্থ মূর্তি পূজার বেদী এবং ‘আজলাম’ অর্থ ভাগ্য নির্ধারক শর। এ চারটি বিষয়কে শয়তানের ঘৃণ্য কাজ (রিজসুন) বলা হয়েছে।
আয়াত নাজিল হওয়ার পর লোকেরা মদের পাত্রগুলো ভেঙে ফেলে এবং শরাবখানাগুলো ধ্বংস করে দেয়। তখন মদিনার অবস্থা এমন হয় যে, অলিগলি সর্বত্র পানির মতো মদ প্রবাহিত হয়। সমগ্র আরব তখন থেকে এ দুর্গন্ধ, বিশ্রী বস্তু হতে মুক্ত হয়ে যায়। অবস্থা ছিল এই যে, এ মাদকাসক্তির কারণে মানুষের জ্ঞান হারিয়ে যেত, কখনো কখনো মদ্যপায়ী পাগল হয়ে পরস্পর হানাহানি, খুনাখুনিতে লিপ্ত হয়ে পড়ত। এমন কি নেশা দূর হয়ে যাওয়ার পরও কখনো কখনো পরস্পর লড়াই শেষ হতো না এবং শত্রুতার অবসান ঘটত না। জুয়ার অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। এ হার-জিতের মধ্যে ঝগড়া, ফ্যাতনা লেগেই থাকত। আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে শয়তানের জুড়ি ছিল না। এসব প্রকাশ্য ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ছাড়া ও ক্ষতিকর অপ্রকাশ্য দিক ও কম ছিল না। যেমন- এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়ে মানুষ আল্লাহর স্মরণ, তাঁর ইবাদত-বন্দেগি থেকে একেবারে দূরে সরে পড়ত। এরূপ আরো নানা অপকর্ম রয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এবার একটি প্রাচীন কাহিনী নিম্নে তুলে ধরা হলো :
বর্ণিত আছে যে, হজরত আদম (আ:) আঙ্গুরের কিছু চারা রোপণ করেছিলেন। অভিশপ্ত ইবলিশ প্রথমে একটি ময়ূর জবাই করে তার রক্ত চারাগুলোতে ঢেলে দিলে চারাগুলো তা চুষে নেয়। এরপর গাছের পাতা গঁজালে একটি বানর জবাই করে তার রক্ত তাতে ছিটিয়ে দেয়। গাছগুলোতে ফল আসতে শুরু করলে একটি বাঘ জবাই করে তার রক্তও তাতে ছিটিয়ে দেয়। যখন ফল পাকতে শুরু করে তখন একটি শুকর জবাই করে তার রক্ত সার হিসেবে গাছগুলোতে ব্যবহার করে।
সুতরাং যখন কেউ আঙ্গুরের মদ পান করে তখন উপরোক্ত চার পশুর গুণাবলির প্রভাব তার মধ্যে বিস্তার লাভ করে। তাই কেউ যখন মদ পান করে, তখন প্রথমে তার সারা দেহে এর প্রভাব দেখা দেয় এবং তরুতাজা শ্যামল সবুজ রঙ সৃষ্টি হয়, যার মধ্যে এক প্রকারের সৌন্দর্য ও চমক প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় সে ময়ূর রূপ ধারণ করে এবং যখন নেশা শুরু হয়, তখন বানরের ন্যায় নর্তন-কুর্দন ও অশালীন আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে থাকে। যখন নেশার আবেগ উত্তেজনা বেড়ে যায়, তখন বাঘের ন্যায় হিংস্রতা প্রকাশ পায় এবং নৃশংস আচরণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। অত:পর শূকরের ন্যায় আক্রমণ করতে উদ্যত হয় এবং সব শেষে দেহ অবস ও দুর্বল হয়ে পড়ে, তার নিদ্রা এসে যায় এবং সর্বাঙ্গ ঢিলে হয়ে পড়ে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন