বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

লুটপাটের রাজত্ব

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি

মাহফুজুল হক আনারও মোঃ আবু শহীদ,দিনাজপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ২৪ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে লুটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। গত এক দশকে লুটপাট হয়েছে শত শত কোটি টাকা। সর্বশেষ ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা গায়েবের ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বন্ধ হয়ে যায় দেশের একমাত্র কয়লা ভিক্তিক ৫২৫ মেগাওয়ার্ড তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুতের সঙ্কটে পড়ে উত্তরের ৮ জেলা। চাঞ্চল্যকর কয়লা চুরির ঘটনায় পেট্রোবাংলা তাৎক্ষণিকভাবে খনির ব্যবস্থাপকসহ ৪ জনকে প্রত্যাহার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। গতকাল সোমবার দুদকের একটি টিম প্রাথমিক তদন্তে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা মূল্যের এক লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা খোয়া যাওয়ার প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে।
অসুন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোন ডিও ছাড়া খনি থেকে বের হয়ে যায় ৩’শ মেট্রিক টন কয়লা। আশ্চর্যজনক হলেও যে বা যারা এই ঘটনার জন্য দায়ী তাদের খুজেঁ বের না করে বা কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন না করেই খোয়া যাওয়া কয়লার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়। কে বা কারা এই কয়লা চুরি করেছিল বা গেট থেকে ট্রাক ভর্তি কয়লা কিভাবে বের হলো তার কোন হদিস আজো পাওয়া যায়নি। এর আগেও ২০০৮ সালে দুই কোটি ৯ লাখ টাকার তামা চুরি হয়। মামলা করা হয় সাধারণ এক শ্রমিকের বিরুদ্ধে। আদালতের রায়ে সে বেকসুর খালাস পেলেও উদ্ধার হয়নি চুরি যাওয়া তামা। এভাবে আরো কত কোটি টাকার মালামাল চুরি হয়েছে তা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকায় গেলে পুকুর চুরির ঘটনা অকপটে স্বীকার করে খনির কর্মকর্তা, শ্রমিক ও এলাকাবাসী। তাদের মতে, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সদস্য দলীয় বিবেচনায় মন্ত্রী এমপি জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ পেট্রোবাংলার পদস্থ কর্মকর্তা এবং খনির কতিপয় কর্মকর্তারা। সিন্ডিকেট কোন ধরনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ডিও ও বিশেষ ডিও এর মাধ্যমে ফড়িয়াদের নিকট কয়লা বিক্রি করে। বিনিময়ে আয় করে লাখ লাখ টাকা কমিশন।
সূত্র জানায়, নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাপ বিদ্যুৎ চালু রাখার জন্য দুই লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রেখে ফড়েয়া ও ব্যবহারকারীদের কাছে কাছে কয়লা বিক্রি করতে পারবে খনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাজারে কয়লার ব্যাপক চাহিদার কারণে অতিরিক্ত মূল্যে ডিও বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার টন কয়লা বিক্রি করা হয়েছে। অপর একটি সূত্র মতে, গত মার্চ পর্যন্ত কয়লা উত্তোলনের ধারাবাহিকতা এবং মজুদ পরিমাণকে বিবেচনায় না রেখে কয়লা বিক্রি করা হয়।
এদিকে, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা না থাকার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে বড় পুকুরিয়া কর্তৃপক্ষ গত জুন মাসেই চাহিদামত কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে জানিয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ইউনিট। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে থাকে ২৭৫ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিটটি। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ হাকিম সরকার জানান, শেষের দিকে বড় পুকুরিয়া থেকে যে কয়লা সরবরাহ করা হয় তার মধ্যে কয়লার চেয়ে পাথর ও আবর্জনাই বেশী ছিল। এসব কয়লা বাছাই করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সচল রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গত ২২ জুলাই রাত ১০ টা ২০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায় তাপ বিদ্যুতের উৎপাদন। লক্ষনীয় বিষয় যে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা কয়লা চুরি করতে করতে কয়লা স্তুপের মাটিকেও ছাড়েনি। ফলে নিজেদের বাঁচাতে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ময়লা আবর্জনাসহ কয়লা সরবরাহ করতে থাকে।
অপরদিকে কয়লা উৎপাদনকারী চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিএমসি এর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সাথে যোগসাজসে উত্তোলিত কয়লার পরিমাণ বেশি দেখিয়ে কমিশন বাণিজ্য করারও অভিযোগ উঠেছে খনি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন খনি শ্রমিক এই প্রতিবেদককে জানায়, প্রতিটন কয়লা উত্তোলন করার বিনিময়ে সিএমসি কোম্পানী ১৭ ডলার পেয়ে থাকে, এ কারণে সিএমসি কোম্পানী প্রতিদিন ৪ হাজার টন কয়লা উত্তোলন করলেও এর পরিমাণ সাড়ে ৪হাজার টন দেখিয়ে ৫শ টন কয়লা উত্তোলনের টাকা পকেটস্থ করে খনি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানিটি ১৯৭৮ সালে বড়পুকুরিয়া বাজারে একটি গভীর সেচ পাম্প বসাতে গিয়ে কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর ১৯৯২ সালে চীনা কোম্পানী সিএমসির সাথে চুক্তি, ১৯৯৪ সালে বাস্তবায়নের কাজ শুরু এবং ২০০৬ সালে খনিটি থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। ২০০৮ সালের শেষে এসে খনিটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পেট্রোবাংলার হস্তক্ষেপে দলীয় বিবেচনায় খনি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, পদবঞ্চিত এবং দলীয় বিবেচনায় কয়লার ডিও ফড়িয়াদের হাতে দেয়া শুরু হয়। এতে করে ধীরে ধীরে খনিটি একটি দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিণত হয়। আমদানীকৃত নিম্নমানের কয়লা’র সাথে বড় পুকুরিয়া কয়লা মিশ্রিত করে বিক্রি’র শুরু করা হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় কোটি কোটি টাকার ডিও জমা দিয়ে হাজার হাজার টন কয়লা কিনে নিতে থাকে একটি চক্র। এদের সাথেই যোগসাজসে বের হয়ে যায় অলিখিত হাজার হাজার টন কয়লা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Md Rakibul Islam ২৪ জুলাই, ২০১৮, ২:৩৯ এএম says : 1
আমার দেশের জাদুকর বিশ্বসেরা। ১ লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা একেবারে গায়েব করে ফেলেছে। এই সুনাম বিশ্বের কাছে বাংলার অর্জন।
Total Reply(0)
Suhail Rana ২৪ জুলাই, ২০১৮, ২:৪০ এএম says : 0
দেশটা হরিলুটের রাজ্যে পরিনত হয়েগেছে। ...........দের ব্যক্তিগত উন্নয়ন হচ্ছে। তাই মুখ বুজে সহ্য করতে হবে তা নাহলে নিরপরাধ জামাত জঙ্গী হয়ে যাব!
Total Reply(0)
Khokan Mohammed Yusuf ২৪ জুলাই, ২০১৮, ২:৫৯ এএম says : 0
ভাগ্যিস বলে নাই যে কয়লা ও প্রেমে বা ব্যাবসায় ছ্যাকা খাইয়া গুম হইয়া গেছে !! সম্ভবত বাতাসে উড়াইয়া ........... নিয়ে গেছে !
Total Reply(0)
Habibur Rahaman ২৪ জুলাই, ২০১৮, ৩:০৫ এএম says : 0
যখন একটি দেশে নাগরিকের অধিকার থাকে না। অন্য দেশ নাগরিক অধিকারের ব্যাপারে মাথা ঘামায় তখন স্বর্ণ কেন দেশও গায়েব হয়ে যায়।
Total Reply(0)
Murtuza Chowdhury ২৪ জুলাই, ২০১৮, ৩:১৮ এএম says : 0
কাজীর গরু কাগজে আছে গোয়ালে নাই। এটা পুরানো প্রবাদ বাক্য। খোঁজ নিয়ে হয়তো দেখা যাবে কয়লার মত ধান,চাল,সার সহ অন্যান্য দ্রব্য সরকারি গুদামে কাগজেই সীমাবদ্ধ। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।
Total Reply(0)
Md abdul Hai ২৪ জুলাই, ২০১৮, ৯:৫৬ এএম says : 0
Corruption is the main problem in Bangladesh. so if our minds do not change, we will reach as developing country even 5000 years later. So change the mentality and give the Gov. job to people who are able to keep trust. That's it
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন