শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

মাতা-পিতার প্রতি অসদাচরণ এবং ভরণপোষণ আইন

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবর, পটুয়াখালীর বাউফলে ছেলের কাছে ভারণপোষণ চাওয়ায় জমিলা খাতুন নামে এক মাকে বিবস্ত্র করে পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে তার পুত্র ও পুত্রবধূ। জমিলা খাতুন জানান, দীর্ঘদিন ধরে ছেলে জালাল তার কোন ভরণপোষণ দিচ্ছে না। ঐদিন সকালে ভরপোষণের কথা বলতে গেলে জালাল ও তার স্ত্রী শারমিন উত্তেজিত হয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে জখম করে। এরপর ছেলে ইট দিয়ে আঘাত করে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। এ সময় জমিলা খাতুনের এক নাতি আমিনুল এগিয়ে এলে তাকেও বেধড়ক পিটিয়ে জখম করে তার ছেলে ও পুত্রবধূ। পরে বাড়ির আঙিনায় কাদার মধ্যে তাকে বিবস্ত্র করে ফেলে দা দিয়ে গলা কাটতে গেলে স্থানীয়রা এগিয়ে আসে। তাকে উদ্ধার করে বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।
আরও একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবর, ভাত খেতে চাওয়ায় বৃদ্ধা মা তসলিমা খাতুনকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। ঘটনাটি ঘটেছে ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ভাঙ্গিপাড়া ইউনিয়নে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, প্রায় ৩০ বছর আগে তাসলিমার স্বামী সকিব উদ্দিন মারা যান। মা বহু কষ্ট করে ২ ছেলে ও ২ মেয়েকে উপযুক্ত করে বিয়ে দেন। কিন্তু সামান্য কিছুতেই ছেলেরা ও তাদের স্ত্রীরা বৃদ্ধা তাসলিমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। ঠিকমত খাবার দাবার দিত না ও খোঁজ খবর করত না। ঘটনার দিন সকালে খিদে পাওয়ায় তাসলিমা খাতুন বড় ছেলের বউয়ের কাছে ভাত চান। এতে পুত্রবধূ রাগান্বিত হয়ে শ্বাশুড়ীকে গালি গালাজ করে। এ সময় বড় ছেলে বদির উদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে মার মুখে আঘাত করে। এতে তার বাম চোখের নীচের অংশ কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। পরে তারা বৃদ্ধা মাকে বাড়ী থেকে বের করে দেয়। স্থানীয়রা বিষয়টি জেনে একত্রিত হয়ে বৃদ্ধা তাসলিমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করে। অবস্থার উন্নতি না হলে তাকে ঠাকুরগাঁও আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সত্য বলতে দ্বিধা নেই, নারী নামের দু’ অক্ষরের ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক সম্ভাবনাময় পৃথিবী। অতীতকাল থেকে আরম্ভ করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কবি সাহিত্যিকদের রচনায় এক বিশেষ আসন দখল করে আছে নারী সমাজ। এক সময় নারী ধর্মবুদ্ধি, বিক্রম এবং কলাকৌশলে জগতের শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। নারীর ফুলের চেয়ে কোমল কিন্তু প্রয়োজনে বজ্রের চেয়েও কঠোর হওয়ার মত জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত প্রচুর আছে। প্রাচীনকালের বিভিন্ন নারীর শ্রেষ্ঠ অবদানের কথা বাদ দিলেও ঐতিহাসিক এবং আধুনিক যুগে রাজনীতি, যুদ্ধ বিগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে এ অঞ্চলের নারীদের প্রতিভার মহৎ উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে একটি কথা আছে যে, নারীর কোন স^তন্ত্র অধিকার নেই। নারী সমাজের অনুপযুক্তা। নারীকে পুরুষের উপর নির্ভর করেই জীবন ধারণ করতে হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, উপমহাদেশের সর্বত্রই নারীকে পুরুষের অধীন বলে বিবেচনা করা হয়। নারীকে শিশুকালে মা বাবার উপর, যৌবনে স^ামীর উপর এবং বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রের উপর ভরসা করেই থাকতে হয়।
একথা স^ীকার করতেই হবে, সকলকেই জীবন গ্রহণ এবং জীবনের সূচনা এমনকি জীবন ধারনের জন্য নারীর উপরেই ভরসা করতে হয়। একজন নারীকে শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন এবং প্রৌঢ় ও বৃদ্ধাবস্থায় পরিণত হতে হয় চিরন্তন নিয়মে। নারী জীবনের শৈশব অতিক্রম করে যৌবনের মধ্য দিয়ে যখন বৃদ্ধাবস্থায় পরিণত হয় তখন বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিবেশে তার ভ‚মিকাও বিভিন্ন ধরনের হতে দেখা যায়। যেমন মাতৃপ্রধান। সমাজে বৃদ্ধা মায়ের ভ‚মিকা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। কেননা সমাজে পরিবারের বয়জ্যষ্ঠা হিসাবে বৃদ্ধা মা সকল ধরনের ধন স¤পদের অধিকারী তথা পরিবারের যে কোন পদক্ষেপে তার সক্রিয় পরামর্শ থাকে। তদুপরি স¤পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ, বিবাহ বা অন্য যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বৃদ্ধা মার ভ‚মিকা অতি আবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হতে দেখা যায়। কেবল মাতৃপ্রধান সমাজেই যে বৃদ্ধা নারীর ভ‚মিকা পরিবারের সদস্যরা আবশ্যকীয় বলে ভাবেন তা নয়। পুরুষ প্রধান সমাজেও এমন বহু পরিবার আছে যেখানে বৃদ্ধা নারীকে প্রচুর স¤মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। তাই পরিবারের প্রতিটি কাজ কর্মে তথা সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদির বিষয়ে বৃদ্ধা নারীর ভ‚মিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
মাতৃপ্রধান হোক আর পিতৃপ্রধানই হোক, আমাদের সমাজের প্রত্যেক পরিবারে বৃদ্ধা নারীর ভ‚মিকা থাকা প্রয়োজন। লক্ষ রাখতে হবে, প্রত্যক বৃদ্ধা মহিলা পরিবার থেকে প্রকৃত মর্যাদা পাচ্ছেন কি না। এমন বহু ঘটনা আছে, বৃদ্ধা নারীর দায়িত্ব নেয়া ও স¤মান দেয়া দূরের কথা তাদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে অস¤মানিত করে উড়িয়ে দিচ্ছে পরবর্তী প্রজšে§র যুবক-যুবতীরা। ফল স^রূপ বৃদ্ধারা হƒদয়ে আঘাত পান এবং নীরবে চোখের পানি ফেলে বসে থাকতে বাধ্য হন। একটি কথা মনে রাখা উচিত, বৃদ্ধ পুরুষের তুলনায় বৃদ্ধা নারীরাই আর্থিক চিন্তা, সন্তান-সন্তুতির ভবিষ্যৎ ইত্যাদির চিন্তায় বেশি অস্থির হয়ে পড়েন এবং তখনই বৃদ্ধাদের জীবন থেকে সবুজ রং হারিয়ে যায়। এ সময় তারা অনুভব করেন সাংসারিক ঘাত-প্রতিঘাত, জীবন যন্ত্রণা।
প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের পরিবর্তন চলতে থাকে। প্রবর্তিত জীবনযাত্রার মানুষের মানসিক মূল্য এবং চিন্তা ধাবার পরিসর সংকুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের জীবনযাত্রার এক অবাস্তব কল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পরিবার বলতে অনুমিত হয় মা-বাবা আর তাদের এক জোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায়, যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্ততিরা এক নিজস^ মনোজগত সৃষ্টি করে নেয়। অন্যদিকে আর্থিক স^াবলম্বিতার স^ার্থেই সন্তানেরা বৃদ্ধা মায়ের থেকে দূর থাকার ফলে চিন্তা, চর্চা তথা সংস্কারের রূপে এক বংশগত ব্যবধানের সৃষ্টি হচ্ছে। জীবনের দুঃসহ বোঝা একই শহরে থাকা সন্তানকে বৃদ্ধা মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সুতরাং এমন অবস্থায় বৃদ্ধা নারীদের অভিমান না করে উত্তর পুরুষের সমস্যাগুলোকে সহানুভ‚তিসুলভ দৃষ্টি ভঙ্গিতে হƒদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা উচিত। কেননা প্রত্যেক মানুষের জীবনের এক নিজস^ বৃত্ত আছে। সে নিজস^ বৃত্তের মধ্যে থেকেও প্রত্যেক প্রত্যেকের হƒদয়কে অনুভব করার চেষ্টা করলে নিঃসঙ্গতা জীবনকে গিলে ফেলতে পারে না। আজকের যান্ত্রিক সময়ে মানবিক স¤পর্ক এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়েছে এক অভিশাপ। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস^রূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। এটা হওয়া উচিত নয় বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ সবাইকে মনে রাখতে হবে, বউ হয়ে শাশুড়ী হতে হয়, ছেলে হয়ে বাবা হতে হয়। বেঁচে থাকলে এর ব্যতিক্রম হয় না বা হওয়ার কথাও নয়। একটা কথা সত্য, মা-বাবার অনাবিল স্নেহ-মমতায় আমরা বড় হলাম, একটি সময়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলাম কিন্তু তারপর স্বার্থপরের মতো ভুলে গেলাম তাদের কথা যারা আমাদের পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখালেন, নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ালেন, আমাদের মানুষ করার জন্য যারা নিজেদের আরাম-আয়েশকে পায়ে ঠেলে দিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের শুভ চিন্তায় উদগ্রীব থাকলেন। এতকিছুর পর রিক্ত হাতে চলে যাওয়া মা-বাবাকে ন্যূনতম একটু প্রীতি ভালবাসা কি দিতে পারি না আমরা? এ থেকে বড় স্বার্থপরতা আর কি হতে পারে?
লক্ষণীয় তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি, বহু সন্তান রয়েছেন যারা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বিদেশ বিভুইয়ে বছরের পর বছর মা-বাবা ছেড়ে দিব্যি রয়েছেন। একবারও মা-বাবাকে দেখার তাগিদ অনুভব করেন না। অথচ একদিনের জন্য প্রিয়তমা স্ত্রী চোখের আড়াল হলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অসংখ্য অশীতিপর মা-বাবা রয়েছেন যারা নিজ সন্তানকে মানুষ করে শেষ জীবনে সন্তানের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষ আছেন যারা মা-বাবাকে দেখভালের দায়িত্ব নিতে চান না। এমনকি স্ত্রীর প্ররোচনায় মা-বাবাকে মারপিট করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয় এমন মানবরূপী দানবদেরও দেখেছি। আশ্চর্যের বিষয়, হাজারো নিপীড়ন-নির্যাতন সত্তে¡ও মা-বাবা বলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। আমি বিভিন্ন স্থানে দেখেছি, ছেলে নিজের আলাদা সংসারে চিত্তসুখে দিন কাটাচ্ছে অথচ প্রৌঢ়া মা অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে এক মুঠো ভাতের সন্ধান করছেন। এ ধরণের অসংখ্য উদাহরণ চোখের সামনে রয়েছে। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলে দস্তুর মতো একটি বই লেখা যাবে। কিন্তু এসব চূড়ান্ত নিলর্জ্জতার কাহিনী লিখে ঘুনে ধরা সমাজকে বদলানো সম্ভব নয়। কারণ আমরা যারা শিক্ষার দম্ভে বড়াই করে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছি অথবা বিদেশ থেকে বছরে কিছু টাকা পাঠিয়ে মা-বাবার সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকছি তাদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। কারণ অসভ্যরা আজ সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই মূল্যবোধের কথা বলে অযথা কালি, কাগজ এবং নিউজপ্রিন্ট নষ্ট করে লাভ নেই। নৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সে শিক্ষা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দেয়া প্রায় হচ্ছেইনা। আমাদের বুঝতে হবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এটা কি অস্বীকার করা যায় যে, প্রতিটি মানব সন্তানের জীবনে মা-বাবার অবদান অপরিসীম। মা অসহনীয় যন্ত্রনা সহ্য করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে সন্তান প্রসব করেন। সীমাহীন ধৈর্য্য ও অতুলনীয় মমতায় লালন পালন করে সন্তানকে ধীরে ধীরে বড় করে গড়ে তোলেন। পিতা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানের ভরণপোষণের সংস্থান করেন। সহায়-সম্বল নিঃশেষ করে দিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। সে পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়সে সব অর্থ ও সম্পদ সন্তানের পেছনে বিনিয়োগ করে নিজেরা অসহায় হয়ে সন্তানের করুণার মূখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সে অসহায় মা-বাবাকে সন্তানের চরম অবজ্ঞা অবহেলায় নিদারুণ দুঃখ কষ্টে মানবেতর দিন যাপন করতে হয়। অনেককে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে আপমানের গøানি নিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। পৃথিবীর সকল ধর্ম গ্রন্থে পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও বাধ্যকারী নির্দেশনা আছে। ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কুরআন ও নবীজির হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বহুবার বহুভাবে মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। মাতাপিতাকে কাছে পেয়ে যথাযথ সেবা শুশ্রæষা, আদর যতœ, সদ্ব্যবহার ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য দিয়ে যারা জান্নাতে যাবার সুযোগ করে নিতে পারেনি তাদেরকে চরম দুর্ভাগা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি অবাধ্য ও রুঢ় আচরণ কবিরা গুনাহ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পিতা মাতার প্রতি সর্বোত্তম আচরণ করা, বিনয়, দরদ, মায়া-মমতার সাথে কথা বলতে নির্দেশ আছে। তাদের সাথে কখনো অসম্মান ও অব্যক্তিসূচক আচরণ করা যাবে না। বিভিন্ন মনীষীর জীবনী পর্যালোচনা করলে আমরা মাতৃভক্তির চরম পরাকাষ্ট প্রদর্শনের অনন্য নজির দেখতে পাই। হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর মাতৃভক্তির কাহিনী কিংবদন্তি হয়ে আছে।
মা-বাবার প্রতি সন্তানের অগ্রহণযোগ্য আচরণ কোনভাবেই বরদাস্ত করা যায় না। সন্তানের অনাদর অবহেলায় নির্যাতিত মা বাবার সীমাহীন দুঃখ কষ্ট লাগব করার জন্যে সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে পার্লামেন্টে ‘মাতা-পিতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩’ প্রণয়ন করে। আইনটি ২৭ অক্টিাবর ২০১৩ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মতি লাভ করে। পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রণিত আইনটি বর্তমানে কার্যকর। এই আইনের বিস্তারিত বর্ণনায় যাওয়ার পূর্বে তার কিছু টার্ম সংজ্ঞায়িত করা দরকার। বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কোন কিছু না থাকলে এই আইনে ‘পিতা’ অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তাননের জনক। ‘ভরণপোষণ’ অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান। ‘মাতা’ অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তানের গর্ভধারিণী। ‘সন্তান’ অর্থ পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া সক্ষম ও সামর্থবান পুত্র বা কন্যা। এই আইনের ৩(১) ধারা মতে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার ভরনপোষন নিশ্চিত করতে হবে। ৩(২) ধারা মতে, কোন পিতা-মাতার একাধিক সন্তান থাকলে সেইক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার ভরণপোষন নিশ্চিত করবে। ৩(৩) ধারা মতে, পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে। ৩(৪) ধারা মতে, কোন সন্তান তার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তার বা ক্ষেত্রমত, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না। ৩(৫) ধারা মতে, প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। ৩(৬) ধারা মতে, পিতা বা মাতা কিংবা উভয়, সন্তান হতে পৃথকভাবে বসবাস করলে সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তাদের বা ক্ষেত্রমত, তাদের সহিত সাক্ষাৎ করতে হবে। ৩(৭) ধারা মতে, কোন পিতা কিংবা উভয়ে, সন্তানদের সঙ্গে বসবাস না করে পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাদের দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমত, মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসংগত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা ক্ষেত্রমত উভয়কে নিয়মিত প্রদান করবে। ৪(ক) ধারা মতে, প্রত্যেক সন্তান তাদের পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং ৪(খ) মতে, মাতার অকর্তমানে নানা-নানীকে ধারা ৩ অনুযায়ী ভরণপোষণ প্রদানে বাধ্য থাকবে এই ভরণপোষণ পিতা-মাতার ভরণপোষণ হিসাবে গণ্য হবে। ৫ ধারায় পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করার দন্ড সম্পর্কে বর্ণনা আছে। ৫(১) ধারা মতে, কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যে কোন উপ-ধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ৩ মান কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। ৫(২) ধারা মতে, কোন সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রমত স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তি ৫(২ক) মতে, পিতা-মাতা বা দাদা-দাদীর ভরণপোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করলে বা ৫(২খ) পিতা-মাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানী ভরণপোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করলে তিনি উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করলে গণ্যে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত দন্ডে দন্ডিত হবে। ৬ ধারা মতে, এ ধারার অধীন অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য হবে। ৭(১) ধারায় এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ ১ম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারযোগ্য হবে। ৭(২) ধারা মতে, কোন আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করবে না। ৮(১) ধারায় আদালত এই আইনের অধীন প্রাপ্ত অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, কিংবা ক্ষেত্রমত, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভায় মেয়র বা কাউন্সিলর, কিংবা অন্য যে কোন উপযুক্ত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করতে পারবে। ৮(২) উপ-ধারা (১) এর অধীন কোন অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য প্রেরিত হলে, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেয়র, মেম্বার বা কাউন্সিলর উভয় পক্ষকে শুনানীর সুযোগ প্রদান করে, তা নিষ্পত্তি করে এবং এইরূপে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য হবে।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিষয়টি পারিবারিক ও মানবিক ইস্যু। তাই শুধুমাত্র আইন দিয়ে মা-বাবার প্রতি অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার অপরাধ বোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চ মাত্রার নৈতিকতা বোধ, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস এবং তা যথাযথ পালন। প্রয়োজন পারিবারিক, মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা। যারা মা-বাবার প্রতি যথাযথ দায়িদ্ব পালন করে না তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে। যে ছেলে বা মেয়ে তার মা-বাবার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করেনা সেও তো তার ছেলে বা মেয়ের নিকট হতে ভাল ব্যবহার পাবেনা এটা পরীক্ষিত সত্য। আমরা নিজ নিজ মাতাপিতা ও তাদের অবর্তমানে নিকট আত্মীয়দের প্রতি সম্ভব সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা, ভালবাসা ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সুন্দর পারিবারিক জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখতে পারি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md Asaduzzaman Kaiser ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:১২ পিএম says : 0
এতো সুন্দর পোস্ট।পড়ে খুব ভালো লেগেছে। আল্লাহ সুবহানাল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন