১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট মার্কিন বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পারমাণবিক বোমা লিটলবয় নিক্ষেপ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিমলগ্নের এ হামলায় মারা যায় নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবাসহ ৮০ হাজার মানুষ। আহত হয় আরও ৩৫ হাজার। মাটির সঙ্গে মিশে যায় বেশির ভাগ দালান-কোঠা। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় একটি নগরী। হিরোশিমার ঘটনার তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরে ফ্যাটম্যান নামে আরেকটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তাতে প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ নিহত হয়। মার্কিন এ হামলাকে মানব সভ্যতার কলংক বলা হয়ে থাকে। জাপানের আসাহি শিমবুনের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের কারণে দুই শহরে চার লাখের মতো মানুষ মারা যায়। এদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লিটল বয় এবং ফ্যাটম্যান ব্যবহার করাটা মার্কিনিদের পূর্ব পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল। ১৯৪২ সালের জুন মাস থেকেই পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেন হেইমারের নেতৃত্বে ম্যানহাটান প্রকল্পে গোপন আণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪২ সালের ২ ডিসেম্বর এনরিকো ফেরমির নেতৃত্বে মার্কিন বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি করেন। পারমাণবিক বোমা তৈরি করার প্রকল্পের নাম ম্যানহাটান প্রকল্প। এই প্রকল্পের জন্য ১৭৫,০০০ লোক কাজ করেছিলো। এতে খরচ হয়েছিলো প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জে. রবার্ট ওপেনহেইমার। প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের মধ্যে ছিলেন ফিলিপ এইচ আবেলসন, হান্স বেটে, সেথ নেডারমেয়ার, জন ফন নিউমান, ইসিদোর ইজাক রাবি, লিও জিলার্দ, এডওয়ার্ড টেলার, স্তানিসল› উলাম, নিল্স বোর, জেম্স চ্যাডউইক, এনরিকো ফের্মি, রিচার্ড ফাইনম্যান, অটো ফ্রিশ্চ, জর্জ কিস্তিয়াাকোভ্স্কি, আর্নেস্ট লরেন্স, ফিলিপ মরিসন, হ্যারল্ড উরে এবং ভিক্টর ওয়েইজকফ। প্রকল্পে কাজ শুরু করার আগেই এদের মধ্যে ৫ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং যুদ্ধের পর এখান থেকে আরও ৩ জন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ম্যানহাটান প্রকল্প ৪টি পারমাণবিক বোমা বানিয়েছিল। এর মধ্যে ট্রিনিটি নামক প্রথম বোমাটি নিউ মেক্সিকোর আলামোগোর্ডোর নিকটে পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরিত করা হয়। অন্য দুটি লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান। শেষ বোমাটি আগস্টের শেষ দিকে জাপানের উপর নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
লিটলবয় নিক্ষেপের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। তিনি ছিলেন আকারে ছোট আর তাই এই বোমার নাম দেয়া হয় লিটল বয়। তবে বোমাহামলার নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান। বোমা বহনকারী বিমানটি ছিল বোয়িং বি-২৯ Superfortress Enola Gay, আর সেই বিমানের পাইলট ছিলেন কর্নেল পল। হামলা পরিচালনা করেন ঞরননবঃং এর ৩৯৩ৎফ বমবার্ডমেন্ট স্কোয়াড্রন, ভারি অফ, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী। এক নজরে লিটল বয়: তেজস্ক্রিয় পরমাণু: ইউরেনিয়াম-২৩৫ ওজন: চার হাজার কেজি, দৈর্ঘ্য: ৯.৮৪ ফুট, পরিধি: ২৮ ইঞ্চি বোমা পতনে সময় লাগে: ৫৭ সেকেন্ড বিস্ফোরণের মাত্রা: ১৩ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য।
জাপানিদের জব্দ করা আর জাপানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানোর জন্যই হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে হামলা চালায় মার্কিনিরা। হামলার ৭৩ বছর হয়ে গেলেও ভয়াল সেই দিনের কথা এখনো ভোলেনি জাপানের মানুষ। এখনো সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে হিরোশিমার ও নাগাসাকির মানুষ। আণবিক বোমা হামলার এতো বছর পরও শহর দুটোতে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু, অনেকে ভুগছে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য অনেক রোগে।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা কঠিন ও ভয়ংকর পরিণতির দিকে আমাদের পৃথিবীকে ঠেলে দিতে পারে। এটা সারা বিশ্বের বিবেকমান মানুষ সহজেই তা আঁচ করতে পারেন, হিরোশিমা অথবা নাগাসাকিকে দেখে। ধ্বংসের ভয়াবহতা ও এর পরিণতির প্রায় সাত দশকের অপ্রাপ্তি দেখে জাপান এখন শান্তিতে বিশ্বাসী। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে জাপানের সেই দুই শহর এখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের সবচেয়ে পরিচিত এবং সবচেয়ে আবেগতাড়িত প্রতীকী শহর হিসেবে গণ্য।
১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টের এ ধ্বংস লীলায় শিকার হওয়া মানুষরা জাপানে ‘হিবাকুশা’ নামে পরিচিত। একটা সময় ছিল যখন জাপানিরা হিবাকুশা’র দুঃখ আর বেদনার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করত। যুদ্ধের ঠিক পরপর জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি দখলে থাকার কারণে আণবিক বোমাসংক্রান্ত সব রকম খবর প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সামাজিকভাবে করুণার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা জাপানিদের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে রাখার মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। ম্যানহাটান প্রকল্প নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা তৈরির গবেষণার প্রধান মার্কিন জেনারেল লেসলি গ্রোভস মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে বলেছিলেন যে, উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসে মৃত্যুবরণ করা কার্যত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা ভোগ না করে মারা যাওয়া এবং সত্যিকার অর্থে সেভাবে মারা যাওয়া হচ্ছে বেশ সুখকর এক অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকেরা বাস্তবিক অর্থেই বিশ্বকে সেই ধারণা দিতে চেয়েছিলেন বলেই হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতার ঘটনা চেপে রাখা তাঁদের জন্য আবশ্যকীয় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
জন হার্সির লেখা ‘হিরোশিমার বোমা হামলা পরবর্তী সময়ের মর্মান্তিক বিবরণ’ সারা বিশ্বের পাঠক জেনে যাওয়ার পরও নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে জাপানি পাঠকেরা অনেক দিন ধরে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই বই পাঠ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। তবে মার্কিন দখলদারির অবসানের পর থেকে ধীরে সেই নিষিদ্ধ দুয়ার উন্মোচিত হয়। বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন আরও অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠার মুখে জাপানেও সেই ঢেউ এসে লাগে। এখন অনেকেই আগ্রহ নিয়ে হিবাকুশা এবং এঁদের মধ্যে যাঁরা আবার গল্পের আকারে সেই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরতে পারদর্শী, তাঁদের মুখ থেকে সরাসরি সেই ইতিহাস জেনে নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। পাশাপাশি হিরোশিমা আর নাগাসাকি দুই শহরই স্মৃতি ধরে রাখা এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত করার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নানা রকম উদ্যোগ নিয়মিতভাবে গ্রহণ করে চলেছে। হিরোশিমার বিধ্বস্ত গম্বুজ তো এখন অনেকটাই যেন পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের অনেক দেশের লোকজনই আণবিক বোমা হামলায় যারা সরাসরি শিকার হয়েছেন তাঁদের মুখ থেকে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শুনে নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সে রকম আগ্রহী ‘কাতারিবে’ নামে পরিচিত কথক বা গল্প বলার বোমা হামলার শিকার লোকজনের আবির্ভাবের সুযোগ করে দিয়েছিল, নিয়মিতভাবে যাঁরা তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁদের সেই দুর্দশার স্মৃতি তুলে ধরেছে। তবে এদের মধ্যে যারা এখনো জীবিত, তারা সবাই এখন বৃদ্ধ। হয়তো কয়েক বছর পর সেই স্মৃতি মানুষের কাছে রোমন্থন কথার মত কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ভিকটিমদের সেই অভাব পূরণ করতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। হিবাকুশাদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে ঠিক সেইভাবে মানুষের কাছে তা বলার চর্চা করার জন্য তরুণ সমাজের সরাসরি অংশগ্রহণ কামনা করছে। এতে হিবাকুশাদের চলে যাওয়ার পরও তাঁদের স্মৃতি অ¤øান রাখার কাজ জাপানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।
নাগাসাকির সে রকম ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ হচ্ছে শহরের কেন্দ্র্রস্থলে গড়ে ওঠা শান্তি পার্ক। পার্কের পরিচিত প্রতীক হলো ১৯৫৫ সালে আণবিক বোমা হামলার দশম বার্ষিকীতে সেখানে বসানো ১০ মিটার উঁচু ভাস্কর্য, এক হাত প্রসারিত করে এবং অন্য হাত আকাশের দিকে সোজা উঁচু করে ধরে রেখে যে ভাস্কর্য একই সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রের হুমকি এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। ভাস্কর্যটির নকশা করেছেন সেইবো কিতামুরা। জাপান ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ-সাহায্যে সেটা তৈরি করা হয়। এই ভাস্কর্যকে ঘিরে গড়ে ওঠা উদ্যানটি হলো নাগাসাকির শান্তি উদ্যান বা শান্তি পার্ক। নাগাসাকি নগর কর্তৃপক্ষ উদ্যানের আন্তর্জাতিক আকার দেওয়ার জন্য ১৯৭৮ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি শান্তি ভাস্কর্য স্থাপনের আহ্বানন জানিয়েছিল। সেই আহহ্বানে সাড়া দিয়ে একই বছর প্রথম সেখানে শান্তির প্রতীক একটি ভাস্কর্য স্থাপন করে পর্তুগালের পোর্তো নগরী। পোর্তোর সঙ্গে নাগাসাকির রয়েছে সিস্টার সিটি বা সহোদরা শহর চুক্তি। এ ছাড়া পর্তুগিজরা ছিল নাগাসাকিতে বাণিজ্যঘাঁটি গড়ে নেওয়া প্রথম বিদেশি, যদিও অল্প কিছুকাল পরে সেখান থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে চেকো¯েøাভিয়া, বুলগেরিয়া, জার্মান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চায়না, পোল্যান্ড, তুর্কিসহ ১৫টি দেশ ও শহর সেখানে ভাস্কর্য স্থাপন করায় নাগাসাকির শান্তি উদ্যান আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে।
লেখক: প্রভাষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, পিলখানা, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন