বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বহুল আলোচিত ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন অবশেষে বাস্তবের পথে পা বাড়াচ্ছে। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)’র সভায় দোহাজারি- রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলওয়ে বাস্তবায়নে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বাস্তবায়িত হলে ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত ট্রেনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের অবারিত সুযোগের আওতায় আসবে বাংলাদেশ। স্থলপথে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার এই রেলনেটওয়ার্ক বাংলাদেশের বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় নতুন গতি সঞ্চার করবে, এটা নিশ্চিত। বিশেষত, বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক অংশীদার চীন এবং সিঙ্গাপুরের সাথে রেল যোগাযোগের এই সম্ভাবনা বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে এক যুগান্তকারী সম্ভাবনার সোপানে পৌঁছে দেবে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীনের সাথে বাংলাদেশের সড়ক ও রেলনেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা বহু পুরনো হলেও ট্রান্স-এশিয়ান রেলনেটওয়ার্ক সূত্রে দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগের এই নতুন সম্ভাবনা বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশী ইতিবাচক তাৎপর্য বহন করছে। সরকারের গৃহীত রোডম্যাপ অনুসারে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছেন বলে জানা যায়। দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১০১ কিলোমিটার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুনধুম পর্যন্ত রেলনেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের সময় যথাসম্ভব কমিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
অনেক দেরীতে হলেও দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেলওয়ে নির্মাণের মধ্য দিয়ে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে অহেতুক কালক্ষেপণ বা দীর্ঘসূত্রতা, ব্যয়বৃদ্ধি এবং প্রকল্প নকশায় নানাবিধ ভুল-ভ্রান্তি দেখা গেছে দোহাজারি-ঘুনধুম রেলওয়ে প্রকল্পে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে সে বিষয়ে তীক্ষè নজরদারি রাখতে হবে। উল্লেখ্য, আঞ্চলিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক হিসেবে কক্সবাজার-মিয়ানমার রেলযোগাযোগ পরিকল্পনা একটি শত বছরের পুরনো উদ্যোগ। ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক (১৮৯০) থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকাল পর্যন্ত মিয়ানমার রেলওয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার এই রেল নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা নিয়ে জরিপসহ বাস্তব উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ববাংলা রেলওয়ের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলসংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা’ সফল হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠায় গত একশ’ বছরে অনেকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা’ বাস্তবতার মুখ দেখেনি। ট্রান্স-এশিয়ান রেল ও সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা এবং তা’ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগও অন্তত দুই দশকের পুরনো। নব্বই দশকের শুরুতে বিএনপি সরকার, পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার এবং সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের মহাজোট সরকার পর্যন্ত এই রেল নেটওয়ার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়ে জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। অবশেষে তা শেখ হাসিনার সরকারের হাতে বাস্তবের সরণিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কিনা তা’ই এখন দেখবার বিষয়। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাওয়া যাওয়ায় এবার আর কোন প্রতিবন্ধকতা থাকছেনা বলেই ধরে নেয়া যায়। সিঙ্গাপুর ও চীনের সাথে সরাসরি রেল তথা স্থল যোগাযোগ কানেক্টিভিটির মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভারত নির্ভরতাও অনেকাংশের হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।
শুধু ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়েই নয়, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কানেক্টিভিটি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে রেলযোগাযোগ একটি বিকল্পহীন অধ্যায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সড়ক ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও রেলযোগাযোগের উন্নয়ন ও সম্ভাবনা ছিল বরাবরই উপেক্ষিত। সড়ক পথ ও সড়ক পরিবহনকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে লক্ষকোটি টাকা অর্থব্যয়ের পাশাপাশি প্রতিবছর হাজার হাজার একর কৃষিজমি অনুৎপাদনশীল খাতে চলে গেছে। অথচ রেলব্যবস্থার উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নে ন্যূনতম বিনিয়োগ নিশ্চিত করা হলে হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি বাঁচানো সম্ভব ছিল। আমাদের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় ব্যয়বাহুল্য, বিশৃঙ্খলা, যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার গতিকেও মন্থর করে দিচ্ছে। রেলপথ উন্নয়নের সাথে সাথে দেশের ট্রাডিশনাল নৌপথগুলো নাব্য ও সচল রাখারও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর এবং বাংলাদেশের পর্যটন ও বাণিজ্যিক গুরুত্ববহ উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে শত বছরেও কক্সবাজারকে জাতীয় রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা বিস্ময়কর। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, দোহাজারি-ঘুনধুম রেল নেটওয়ার্কের প্রাক্কলন ব্যয় গত মাত্র ৫ বছরের মধ্যে প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। ডুয়েলগেজ নেটওয়ার্কে উন্নীত করার অজুহাতে এই অস্বাভাবিক ব্যয়বৃদ্ধি ঘটেছে বলে জানা যায়। দেশের প্রায় প্রতিটি মেগা প্রজেক্টেই এমন অস্বাভাবিক ব্যয় এবং সময় বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে চলেছে। দোহাজারি-ঘুনধুম রেল নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার প্রকল্পটি যেন ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে চারলেনে উন্নীত করার প্রকল্পের মত ভাগ্য বরণ করতে না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। ট্রান্স-এশিয়ান রেলসংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি রেলওয়ের সামগ্রিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আগামী দশকে বাংলাদেশ উন্নয়নের নবতর মহাসরণিতে প্রবেশ করবে, এই প্রত্যাশা সকলের।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন