বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মুখোমুখি অবস্থানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নার্সরা

প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : দীর্ঘদিন থেকে ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়ে আসছেন নার্সরা। হঠাৎ করেই এই নিয়মকে বাদ দিয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে নার্স নিয়োগ দিতে চাচ্ছে সরকার। আর এ কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বেকার ও সরকারি চাকরিরত নার্সরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের ভাষ্যমতে, আন্দোলনরত নার্সদের দাবি অযৌক্তিক। অন্যদিকে বেকার নার্সরাও পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ পেতে চাচ্ছেন। আর সরকার এ দাবি না মানায় সকল পর্যায়ের নার্সরা যৌথভাবে মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে। নার্সদের অভিযোগ, নার্স নিয়োগে দেশে আজও কোন অনিয়ম-দুর্নীতি বা বাণিজ্যের সুযোগ ছিলো না। আর তাই দীর্ঘদিনের নিয়মকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে একটি চক্র উঠে পড়ে লেগেছে। সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, কোনো নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বাণিজ্যের স্থান থাকতে পারে না।
যারা মানব সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, সেক্ষেত্রে কিসের বাণিজ্য। ড. মিজান বলেন, যে নীতিতে নার্সদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, তাদের ১০ বছর আটকিয়ে রাখা হয়েছে, সেই আশ্বাস বাণীর সাথে একটি জাতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে না। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে পাসকরাদের ৮০ শতাংশ ২০১৩ সালে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাকিদের পরে নিয়োগ দেয়ার কথা। একই ক্ষেত্রে দুটো ভিন্ন আইন কখনো চালু থাকতে পারে না। নার্সদের মতে, এভাবেই একটি সিদ্ধান্তের কারণে ২০০৩ সালে চাকরিতে যোগদান করা নার্সরা এখনো বিপাকে রয়েছেন। ওই ব্যাচের নার্সরা দীর্ঘ ১৬ বছর চাকুরী করেও সিনিয়র স্টাফ নার্স পদবি লিখেতে পারছে না। অথচ গত ২০১৩ সালেও যেসব নার্স নিয়োগ পেয়েছেন তারাও পদবি হিসেবে সিনিয়র স্টাফ নার্স লিখছেন। একাধিক নার্স জানান, তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিব যুক্তি দেখান চাকরিতে প্রবেশ করেই সিনিয়র হবে কেন। স্টাফ নার্স হিসেবে যোগদান করে পরবর্তীতে প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র হবে। আর এ যুক্তিতে ওই ব্যাচে নিয়োগ পাওয়া নার্সরা আজও সিনিয়রিটি পাননি।
জানা গেছে, নিয়মতান্ত্রিক পরীক্ষার পরিবর্তে ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ চান নার্সরা। অন্যদিকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে নার্সদের নিয়োগ দিতে চায় সরকার। দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে বিষয়টি সুরাহা করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও চাকরিপ্রত্যাশী নার্সরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকেন। এরপর দাবি আদায়ে নার্সরা আন্দোলনে গেলে সরকার কিছুটা নমনীয় হয়। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু চলতি বছর মার্চের শেষ সপ্তাহে সরকার পিএসসির মাধ্যমে সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে নার্সরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বিজ্ঞপ্তি বাতিলের দাবিতে ৩০ মার্চ থেকে তারা লাগাতার আন্দোলনে রয়েছেন। নার্সদের দুটি সংগঠন ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিবিএনএ) ও বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটির (বিজিএনএস) ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। এই দুটি সংগঠনকে সার্বিক সহযোগিতা করছে সরকারি চাকরিরত নার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ নার্সেস ঐক্য পরিষদ।
মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়েগের দাবিতে নার্সদের দুটি সংগঠনের চলমান আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেন, অতীতে তাদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান করেন। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের আইন অনুযায়ী এবং সরকারি নিয়োগ বিধি অনুযায়ী সকল দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরি প্রার্থীদের নিয়োগ পিএসসির মাধ্যমেই হয়ে থাকে। নার্সদের ক্ষেত্রেও সেই নিয়েমের ব্যতিক্রম হবে না। তদের চাকরি করতে হলে প্রজাতন্ত্রের নিয়ম মেনেই করতে হবে। এক্ষেত্রে তারা যে আন্দোলন করছে এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অবৈধ।
এদিকে দাবি মেনে না নেওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পদত্যাগ চেয়েছেন বাংলাদেশ নার্সেস ঐক্য পরিষদের আহবায়ক ইসমত আরা পারভীন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত এই নার্স নেতা বুধবার বাংলাদেশ নার্সেস ঐক্য পরিষদের ব্যানারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে করে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাত বছর পূর্বের ঘোষণা বাস্তবায়নসহ নয় দফা দাবিতে নার্স সমাজের বিরাজমান সমস্যা সমাধানে এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন সমাবেশে বক্তব্য প্রদান কালে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন ওনাকে ধিক্কার জানাই, ওনার পদত্যাগ চাই।’ তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘অনেক দিন বেকার নার্সরা রাস্তায় বসে আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো আসলে তোমরা কি চাও। তোমাদের আমি কি উপকার করতে পারি। তোমরা আসো আমাদের সাথে আলোচনা করো।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘ওনাকে (স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে) ফোন দিলে উনি ফোনটা ওয়াইফকে ধরিয়ে দেন। আমি আমার নার্সদের ব্যাপারে বারবার কথা বলেছি, উনি একবারও কর্ণপাত করেন নি। উনি আছেন শুধু বদলি বাণিজ্য করার জন্য।’ ইসমত বলেন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় তারা রাস্তায় আসতে বাধ্য হয়েছেন। নার্সদের দফতরে আমলারা বদলি বাণিজ্য করে খাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে ইসমত আরা বলেন, তিনি চাকরি খেলেও তাতে ভয় নেই। তাদের সাথে আলোচনায় না আসলে হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গত বছরের নভেম্বরে সচিব কমিটি ও মন্ত্রিপরিষদের সভায় নার্সদের বয়সসীমা প্রমার্জনা করে ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৬ বছর করা হয়। একই সঙ্গে আগের মতো ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নার্সদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই সভার পর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রথম স্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির সিদ্ধান্ত হয়। এর পরই চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নার্স নিয়োগ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) পাঠানো হয়। ২৮ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিনিয়র স্টাফ নার্সের তিন হাজার ৬১৬টি পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পিএসসি।
বিডিবিএনএ ও বিজিএনএস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ২১ হাজার বেকার নার্স রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় চার হাজার নার্সের সরকারি চাকরির বয়সীমা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নতুন সৃষ্ট পদ ও শূন্য পদ মিলিয়ে মোট ১৩ হাজার ৭২৮টি পদ শূন্য রয়েছে। সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা জানান, পিএসসির নতুন পদ্ধতিতে বয়সের কারণে অধিকাংশ নার্স শুধু একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। এ অবস্থায় পিএসসির মাধ্যমে নার্সদের নিয়োগ সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্ত নার্সদের স্বার্থবিরোধী।
বাংলাদেশ বেসিক গ্রজিুয়েট নার্সেস সোসাইটির সভাপতি রাজীব কুমার বিশ্বাস বলেন, পরীক্ষার মাধ্যমে নার্স নিয়োগের নামে একদিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করা হবে। অন্যদিকে নিয়োগকে কেন্দ্র করে সংশ্লিস্টরা নিয়োগ বানিজ্যে মেতে উঠবে।
তবে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকতা জানান, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ হলে বাণিজ্য হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে নার্সদের আন্দোলনের সঙ্গে একটি দুষ্টচক্র জড়িত। কয়েকজন চিকিৎসক নেতার ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থে নার্সদের ব্যবহার করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, সকল দাবি পূরণের পরেও নার্সদের আন্দোলনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে দাবি আদায়ে বুধবার আয়োজিত মানববন্ধন থেকে নয় দফা দাবি জানানো হয়। একই সাথে সামনে আরো দুই দিনে কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। কর্মসূচি মধ্যে রয়েছে ২৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং ২৯ এপ্রিল মহাসমোবেশের মাধ্যমে বৃহত্তর ও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা। নয় দফা দাবির মধ্যে প্রথমেই রয়েছে, ২৮ মার্চ পিএসসির দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে পূর্বের মত ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ বাস্তবায়ন। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ১০ হাজার পদ সৃষ্টিসহ সকল শূন্য পদে ৮৯ শতাংশ ডিপ্লোমা ও ১১ শতাংশ বেসিক বিএসসি থেকে নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণীত কর্মরত নার্সদের অবিলম্বে প্রথম শ্রেণীতে নিয়মিত করণের দাবিও জানানো হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন