বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বঙ্গোপসাগরে ডেড জোন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

বঙ্গোপসাগরে জরিপ-গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। ফিরে গেছে নরওয়ের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সামুদ্রিক গবেষণা জাহাজ ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’। বাংলাদেশের নিজস্ব সমুদ্রসীমায় মৎস্য সম্পদসহ জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের প্রয়োজনীয় নমুনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে এই জাহাজযোগে। এতে দেশি-বিদেশি ৩০ জন বিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করেন।
‘ড. ফ্রিডজফ নেনসেন’ জরিপ-গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন হলে জানা যাবে বঙ্গোপসাগরে অর্থকরী মাছের মজুদ, জীববৈচিত্র্য এবং সমুদ্রজগতের পরিবর্তন-বিবর্তন সম্পর্কে। তাছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যরে অব্যাহত নিঃসরণে (বিশেষত নাইট্রাস) দূষণের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন-শূন্য বা ন্যুনতম হারে অক্সিজেনের উপস্থিতির কারণে ‘ডেড জোন’ তৈরি হয়ে মৎস্যসহ সামুদ্রিক প্রাণিজগত হুমকির মুখে পড়েছে মর্মে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। জরিপ-গবেষণায় সে সম্পর্কেও একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা লাভের আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ জানান, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নরওয়ের বিশেষায়িত জাহাজ ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’ শ্রীলংকার কলম্বো বন্দর হয়ে গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরের সাইলো জেটিতে ভিড়ে। এরপর গত ৩ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত গভীর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ পানিসীমায় সমুদ্র বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জরিপ-গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। গভীর সমুদ্রে বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির মাছের মজুদ বা স্টক, সমুদ্রে দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি বিষয়ে টানা ১৫ দিন ধরে জরিপ-গবেষণার কাজ চলে। এ সময় বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে সমুদ্রের পানি ও বিভিন্ন উপাদানের নমুনা সংগ্রহ, সমুদ্র তলদেশে পরিবেশের পরিবর্তন, দূষণের পরিস্থিতি বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। জরিপ-গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা শেষে জাহাজটি গত ২০ আগস্ট চট্টগ্রামে ফিরেই এরপর বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ত্যাগ করে গেছে।
জাহাজে অবস্থানকালে জরিপ-গবেষক দলের অন্যতম বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমুদ্র বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী গতকাল (শনিবার) দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, বঙ্গোপসাগরে জরিপ-গবেষণা কার্যক্রম সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। বিশেষায়িত জাহাজটিতে ৩০ জন দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানী গবেষক ছিলেন। এরমধ্যে বাংলাদেশের ১৮ জন, ইউরোপের শীর্ষ সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন রিসার্চের পক্ষ থেকে ৯ জন এবং ভারতের ৩ জন। বঙ্গোপসাগরে জরিপ-গবেষণা কার্যক্রমের প্রাথমিক বা খসড়া প্রতিবেদন ২ মাস পর দেয়া হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পেশ করা হবে আগামী বছর ২০১৯ সালের মার্চ মাস নাগাদ। প্রতিবেদন দাখিল করা হবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে।
তিনি আরও জানান, সমুদ্র থেকে সংগৃহীত নমুনা, তথ্য-উপাত্তসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশ্লেষণের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। দেশ-বিদেশের সামুদ্রিক গবেষণা সম্পর্কিত ৮টি পরীক্ষাগারে (ল্যাব) সেসব নমুনা ও তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের পর সবগুলো একত্রে সমন্বয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হবে প্রতিবেদন। নরওয়ে, ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ল্যাবে বঙ্গোপসাগর থেকে সংগৃহীত নমুনা ও তথ্য-উপাত্তসমূহ প্রেরণ করা হয়েছে।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন শূন্য বা মিনিমাম অক্সিজেন ‘ডেড জোনে’র সম্ভাব্য অবস্থান শনাক্ত করা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ জানান, নরওয়ের গবেষণা জাহাজ ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’ শ্রীলংকা থেকে দেশের সমুদ্রসীমায় আগমনের পথে (গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে) বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নমুনা সংগ্রহ এবং সামুদ্রিক জরিপ করা হয়েছে। সাগরে ৪টি স্টেশনের লোকেশনে পানির উপরতল এবং তলদেশের পানিসহ বিভিন্ন উপাদানের পরিমাপ, নমুনা ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় জাহাজে যুক্ত উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির সাহায্যে।
বঙ্গোপসাগরে অক্সিজেন শূন্য বা ‘ডেড জোন’ তৈরির বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে এখন স্বীকৃত। তাছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য সাগর-মহাসাগরেও অক্সিজেন শূন্য জোন তৈরি হয়েছে। এবারের ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’ জাহাজযোগে গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে এই অক্সিজেন শূন্য জোন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে পড়েছে কিনা অথবা কত দূরত্বে অবস্থান করছে? সমুদ্রজগত বিশেষত মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব কী তা নিরূপনের প্রচেষ্টা চলছে। কেননা সেখানে মাছসহ প্রাণিজগতের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে।
জাতিসংঘের পতাকাবাহী নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন রিসার্চ (আইএমআর) পরিচালিত জাহাজ ‘আরভি ড. ফ্রিডজফ নেনসেন-৩’ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় জরিপ-গবেষণার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক প্রকল্প। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদস্যভূক্ত বাংলাদেশের মতো যেসব দেশের এ ধরনের উন্নত জরিপ-গবেষণা জাহাজ নেই সেসব দেশকে সহায়তা প্রদান করে এটি।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এ জাহাজ বিশ্বের অনেক দেশে সামুদ্রিক মৎস্য, প্রাণিসম্পদ এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জরিপ কাজ চালিয়ে আসছে। সাগরের ১০ মিটার থেকে ২ হাজার মিটার গভীরতা পর্যন্ত জরিপ কাজ পরিচালনায় সক্ষম জাহাজটি। ‘আরভী ড. ফ্রিডজফ নেনসেন’ জাহাজটি একজন খ্যাতনামা সমুদ্র বিজ্ঞানীর নামানুসারে। ২০১৭ সালে নরওয়েতে এটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নির্মিত হয়। ৭৯ মিটার দৈর্ঘ্যরে এ জাহাজ প্রয়োজনীয় সবধরনের যন্ত্রপাতি ও ল্যাবে সমৃদ্ধ।
জ্বালানি তেল, পোড়া তেল, গ্যাস ও কয়লা জ্বালানোর কারণে এসব জ্বালানির বর্জ্য এবং জমিতে ফল-ফসল ক্ষেত-খামারে অনিয়ন্ত্রিত হারে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে সেগুলোর যাবতীয় বর্জ্য-জঞ্জাল খাল-বিল নদ-নদী হয়ে সাগরে গিয়ে মিশছে। এই নাইট্রাস অক্সাইড সাগরতলকে করে তুলছে অক্সিজেন-শূন্য। মানবসৃষ্ট এই অপরিণামদর্শী কর্মকান্ডের পরিণতিতে বঙ্গোপসাগর হারাচ্ছে স্বাভাবিক অক্সিজেনের মাত্রা। এরফলে সাগরের ২শ’ মিটার নিচে অক্সিজেন-শূন্য জোন তৈরির আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীরা। অক্সিজেন হারা কিংবা শূন্যের কাছাকাছি অক্সিজেন জোন থাকলে মূল্যবান মৎস্য সম্পদসহ সামুদ্রিক প্রাণিকূল, জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদরাজি ও তাদের প্রাকৃতিক খাদ্য-শৃঙ্খল মারা পড়বে অথবা অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে।
সাগরে নিঃসরিত ‘নাইট্রাস অক্সাইড’ থেকে পরিণত হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর ‘নাইট্রাইড’। এতে করে সমুদ্র পরিবেশে এককোষী শৈবাল সৃষ্টি ও এর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখান থেকে (ডি-কম্পোজ) নিয়মে সৃষ্টি ও খুব দ্রুত প্রাদুর্ভাব ঘটছে ব্যাকটেরিয়ার। এসব মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান সাগরতলের অক্সিজেন খেয়ে সাবাড় করে ফেলছে। এই প্রক্রিয়ায় সাগরতলে কোথাও কোথাও তৈরি হয় ‘অক্সিজেন-শূন্য’ জোন। সেখানে বিচরণশীল মৎস্যসহ প্রাণিকূল, উদ্ভিদ এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য স্বাভাবিক অক্সিজেনে ঘাটতি হয়। এ কারণে বাঁচার তাগিদে বড় আকারের প্রাণিকূল পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তবে মাছসহ ছোট আকারের কোটি কোটি প্রাণিকূল এবং তাদের খাদ্য-শৃঙ্খল মারা যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Istiaqe A Khan ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১২:১৭ এএম says : 0
বঙ্গোপসাগরে মূল্যবান বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জীবজগতের অবস্থা সম্পর্কে নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। সাগরে অক্সিজেন শূন্যতার কারণে যে ডেড জোন সৃষ্টি হয়েছে তাও শনাক্ত করা প্রয়োজ।
Total Reply(0)
Rashid ul Ahsan ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ৭:১৮ এএম says : 0
আমাদের সামুদ্রিক সম্পদকে সুরক্ষা করতে হবে। এই ধরনের জরিপ ও গবেষণা আরো অনেক দিন আগে থেকে শুরু করা প্রয়োজন ছিল।
Total Reply(0)
সকাল আহমেদ ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২৪ এএম says : 0
বাংলাদেশের সমুদ্রের সম্পদ গবেষণায় ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ভারতীয় বিজ্ঞান এর উপস্থিতি কেন আমরা কি ভারত ছাড়া এক পাও চলতে পারছি না এর মাধ্যমে কি বাংলাদেশের সম্পদের তথ্য পরিসংখ্যান ভারতের কাছে পাচার হয়ে যাবে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বলে আর কত ভারত ও হবো আমরা।
Total Reply(0)
করিম ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২৫ এএম says : 0
বিদেশি বিজ্ঞানীদের দিয়ে এ ধরনের গবেষণা সবসময়ই রাষ্ট্রের স্বার্থে ক্ষতিকর এর ফলে জাতীয় তথ্য বিদেশিদের হাতে চলে যেতে পারে।
Total Reply(0)
Harum ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২৬ এএম says : 0
উদ্যোগটি ভালো সন্দেহ নেই তবে ভারতীয় কর্মকর্তার এখানে কি কাজ
Total Reply(0)
সুমন ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২৭ এএম says : 0
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে ভারতীয় জেলেরা ব্যাপকহারে ইলিশ মাছ মেরে নিয়ে যাচ্ছে ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ইলিশ শূণ্য হয়ে পড়ছে আগে কোস্টগার্ড ভারতীয় জেলেদের দেখলে আটক করত তারা দিত এখন এই নতুন সরকারের আমলে কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা কিছুই বলতে পারেনা বরং সকলের সামনে ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের মাছ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশী জেলেরা ও প্রতিবাদ করতে পারে না করলে তাদের গুলি করতে আসে ভারতীয় জেলেরা ওদের সাহস এখন এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে
Total Reply(0)
Asad ২৬ আগস্ট, ২০১৮, ১১:২৮ এএম says : 0
শুভ উদ্যোগ সরকারকে ধন্যবাদ এ ধরনের কাজ জরিপ আরো আগেই করা উচিত ছিল
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন