শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত জাতীয় কবি নজরুল

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০২ এএম

নানা আয়োজন ও কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির কবরে শ্রদ্ধা জানিয়েছে সব শ্রেণি পেশার মানুষ। কবি নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় এনেছিলেন সম্পূর্ণ নতুন এক সুর, ছিলেন মানবতার উচ্চকণ্ঠ প্রচারক, গানে মিশিয়েছিলেন বিচিত্র ধারা। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র ও ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। নজরুলের চেতনা ও আদর্শ বাঙালির জীবনে চিরন্তন, বাংলাদেশের উত্থান-পতনময় সংগ্রামী ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। নির্মম দারিদ্র্য থেকে অসামান্য প্রতিভায় তিনি অভিষিক্ত হয়েছেন মহাপুরুষের আসনে। আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। সোচ্চার ছিলেন সা¤প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারে বিরুদ্ধে। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়েছে। বিটিভিসহ বেসরকারি চ্যানেলগুলোতেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান স¤প্রচার করা হয়েছে। নজরুল ইনস্টিটিউট জাতীয় জাদুঘরে নজরুল পুরস্কার প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে নজরুলসংগীতে অবদানের জন্য খায়রুল আনাম এবং নজরুলসংগীত গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রশিদুন্ নবীকে ‘নজরুল-পুরস্কার ২০১৭’ প্রদান করা হয়।
গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৬টায় কবি পরিবারের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কবির নাতনি খিলখিল কাজীসহ পরিবারের সদস্যরা। পরে তারা কবির রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাতে করা হয়।
এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে কবির কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে খিলখিল কাজী সাংবাদিকদের বলেন, আজ আমরা সবাই কবির ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছি, কিন্তু কবিকে শুধু বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিদ্রোহী কবিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে হবে; ছড়িয়ে দিতে তার জীবনী ও সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে।
জাতীয় কবির ৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্ম সবসময় আমাদের প্রেরণা দেবে। তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের কবি, সাম্যের কবি। তার চিন্তা ও সমাজভাবনা আমাদের পথ দেখাতে সাহায্য করেছে। বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে তার সৃষ্টিকর্ম সবসময় আমাদের প্রেরণা দেবে।
আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন নজরুল গবেষক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী, সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান টুম্পা সমদ্দার ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহসিনা আক্তার খানম (লীনা তাপসী), বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক ও বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ এনামউজ্জামান প্রমুখ।
এর আগে বাদ ফজর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদুল জামিয়ায় কোরানখানি হয়। সকাল ৭টায় কলাভবন প্রাঙ্গণে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জমায়েত হন। সেখান থেকে তারা সকাল সোয়া ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদেও নেতৃত্বে কবির সমাধিতে যান। সেখানে তারা পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এসময় তিনি বলেন, জাতীয় কবি অসা¤প্রদায়িক মানবতাবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ ছিলেন। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে এটাই শপথ নিব বাংলাদেশে যে সা¤প্রদায়িকতা বিষবৃক্ষ; এখন ডালপালা বিস্তার করে আছে। দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সা¤প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষকে আমরা উৎপাটিত করব।
বিএনপির পক্ষে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কবরে ফুল দিতে এসেছিলেন বিএনপি‘র স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে তিনি বলেন, আজকে আমাদের প্রয়োজন রয়েছে সেরকম একজন বিদ্রোহী কবির। কবি নজরুল যেমন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার তরবারি উন্মুক্ত করেছিলেন কলমের মধ্যদিয়ে। আজকে যেন সেই কলমের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান অনাচারের প্রতিবাদ করে সত্যিকার গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশ পুনরায় গড়ে তুলব।
জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে তার সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে ছাত্রলীগ। গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত কবির কবরে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। এরপর ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন দুর্গম পথের দুঃসাহসী যাত্রী এবং গভীর নিমগ্ন এক স্রষ্টা। তার সাধনা ছিল মানুষ আর তাদের মুক্তির আকাক্সক্ষা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক মূর্তমান বিদ্রোহের প্রতীক। ধ্রুবতারার মতোই ছিল তার আর্বিভাব। চোখ মেলেই যে সমাজ আর রাষ্ট্র দেখলেন, তা ছিল শ্বাপদসংকুল। তার যুদ্ধটা ছিল দূর্গম ও দীর্ঘ। স্বভাবতই তাকে বিদ্রোহের পথ যেতে হয়েছে। এতে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন। তবে স্থির প্রত্যয়ী উচ্চারণে দ্বিধা করেননি এতটুকু।
মাত্র বাইশ বছর শিল্প সৃষ্টিতে সক্রিয় থাকতে পেরেছিলেন। এই ক্ষুদ্রসময়ে পৌনঃপুনিকভাবে তিনি মানুষের মুক্তির কথাই বলেছেন। তাই এক হাতে বাঁশের বাশরি, আর হাতে রণ-তুর্য এই যুগলবন্ধী যেন অবধারিত ছিল। দ্রোহ আর প্রেম সত্তার নিবিড় যোগ নজরুল কাব্যে স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে। এ বিদ্রোহী কবি জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে ব্যাপকতর যে বোধের দিশা দিয়েছেন, তা এখনো ভালবাসায় পূর্ণ সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান দিতে পারে। বাংলাভাষী মানুষকে তার শরণ নিতে হবেই। তার লেখনী সাম্য আর অসা¤প্রদায়িক চেতনার মর্মবাণী উগ্র সা¤প্রদায়িকতা প্রতিরোধের শক্তি যোগায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার কবিতা ও গান ছিল প্রেরণার উৎস।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৪ মে নজরুলকে নাগরিকত্ব দিয়ে তাঁকে সপরিবারে এদেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের এই জাতীয় কবিকে ১৯৭৪ সালে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে সাম্যের কবিকে একুশে পদকেও ভূষিত করে রাষ্ট্র। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে ও বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। শৈশবেই স্বজন হারানো ‘দুখু মিয়া’ দারিদ্র্য আর সব বাধা ঠেলে একসময় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। ১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান তিনি। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র ও ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার জন্য মৃত্যুর আগে কবি গানে গানে বলেছিলেন ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোর থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ীই কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবরস্ত করা হয়। ###

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মাহবুব ২৮ আগস্ট, ২০১৮, ২:১৭ এএম says : 0
এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য--বিদ্রোহ,প্রেম,বিরহ, আবেগ,সাম্য,ইসলাম, লেলিনবাদ,মানবতাসহ বহু বৈশিষ্ট্যে সার্বজনীন ও কালজয়ী ।অনেকেই তাঁকে নিয়ে বৃত্তায়ন থিউরীতে ব্যাখ্যা করে,নিজেদের দর্শনগত ভিত মজবুতে ব্যবহার করেন ।এমনকি আন্যায়ের তান্ডবলীলা চালিয়ে তাঁর জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীতে মন্তব্য করেন--তিনিতো আমাদের লোক ।হায়!!! একি শুনি-দেখি ।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন