বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পোশাক খাতে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে

গার্মেন্টস খাত নিয়ে সিপিডি’র গবেষণা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

১৯ শতাংশ কারখানা ভাড়া বাড়িতে
ন্যায্য মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের সম্মান দিন : রেহমান সোবহান


রানা প্লাজাপরবর্তী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেটি হয়েছে দেশীয়ভাবে। বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের মূল্য বাড়ায়নি। একই সঙ্গে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশে গড়ে উঠা অতিরিক্ত ১৯ শতাংশ কারখানা এখনও ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে বলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, মাত্র ২১ শতাংশ কারখানায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। খুবই নিম্ন মানের প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে ১৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া, গার্মেন্টস কারখানাগুলোর মালিকানা পরিবার ভিত্তিক, যেখানে ৬৫ শতাংশ গার্মেন্টসই দ্বিতীয় প্রজন্ম দ্বারা পরিচালিত। এসব প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো স্বাধীন পরিচালক।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘ট্রান্সফরমেশন ইন দ্য আরএমজি সেক্টর ইন পোস্ট রানা প্লাজা পিরিয়ড ফাইন্ডিংস ফরম সিপিডি সার্ভে’র’ এক প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় গার্মেন্টস সেক্টরের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি বিষয়ক এই প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির সহযোগী গবেষক অবীর খন্দকার।
মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি শীর্ষক এই প্রবন্ধে কারখানার অভ্যন্তরের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পোশাক কারখানাগুলোয় পারিবারিক প্রাধান্য রয়েছে। কারখানাগুলোর অধিকাংশই দ্বিতীয় প্রজন্ম দ্বারা পরিচালিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসেছে তৃতীয় প্রজন্মও।
সিপিডির গবেষণা বলছে, ৬৫ শতাংশ গার্মেন্টস দ্বিতীয় প্রজন্ম দ্বারা পরিচালিত। ৮৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের ৩ জন পরিচালকের মধ্যে দু’জনই একই পরিবারের। সেসব প্রতিষ্ঠানে কোনো স্বাধীন পরিচালক নেই। একই সঙ্গে ৫৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠান একই গ্রুপের ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিচ্ছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশে ১৯ শতাংশ কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে আশঙ্কার বিষয়, এর বড় অংশটিই ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত।
গবেষণায় কারিগরি উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ২১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। খুবই নিম্ন মানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। আর ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪ শতাংশে উন্নত প্রযুক্তি এবং ৩৮ শতাংশে মধ্যম ও বৃহৎ পরিসরে প্রযুক্তির ব্যবহার হয়। এছাড়াও, বিকেএমইএ’র চেয়ে বিজিএমইএ’র প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা ৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।
আলোচনার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, গার্মেন্ট খাতে নতুন পণ্য উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বাড়ছে না প্রযুক্তির ব্যবহারও। কাজেই পরিকল্পিত বিনিয়োগ না হলে আগামীতে এ খাতটি প্রতিকূলতায় পড়ে যাবে। এ খাতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সুদের ঋণ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। প্রবন্ধে তিনি বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর এ খাতটি সামাজিক সূচকে এগিয়েছে। কিন্তু অন্যভাবে অর্থনৈতিক সূচকে পিছিয়ে পড়ছে।
দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের তৃতীয় সেশনে সিপিডির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান ন্যায্য মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের মূল্যায়ন করতে পোশাক মালিকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শ্রমিকরা পশু নয়, তাদের মূল্যায়ন করুণ। কারণ শ্রমিকদের উপর নির্ভয় করেই তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে রযয়েছে বাংলাদেশ।
প্রফেসর রেহমান সোবহান বলেন, দেশের পোশাক খাতের উন্নয়নের মূল কারিগর শ্রমিক সমাজ। তাদের পরিশ্রমের উপর ভর করে দেশ পোশাক রফতানিতে বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। মালিকদের প্রতি আহ্বান, শ্রমিকরা পশু নয়। তাদের মূল্যায়ন করুণ। ন্যায্য মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের সম্মান দিন।
তিনি বলেন, রানা-প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও লিঙ্গ বৈষম্য রয়েছে। তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নারী। তাই এ খাতে তাদের অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি এ খাতের পুরুষের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো দরকার বলেন মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। রেহমান সোবহান আরও বলেন, পোশাক খাত অনেক দূর এগিয়েছে। দেশ রফতানি পোশাকের উপর নির্ভরশীল। তাই এ খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। খাতটির উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। এক সঙ্গে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমিকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিযোগিতার বিশ্বে বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টিকে থাকতে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতি সহায়তা দিতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, পোশাক কারখানাগুলোর উন্নয়নে প্রযুক্তির অভিমুখী অবশ্যাম্ভাবী। এ উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মকৌশল ও ব্যবস্থাপনা হতে হবে শ্রমিকদের স্বার্থে। সামগ্রিকভাবে যে নীতি কাঠামো আছে এবং সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রণোদনা দেয়া হয় সেগুলোকে পুনর্বিবেচনা করা দরকার। যে উত্তরণ আমরা চাচ্ছি, সেই রুপান্তরের সঙ্গে এই নীতিগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না সেগুলো আরেকটু ভালো করে বিবেচনা করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পোশাক রফতানি বহুমুখীকরণের অগ্রগতি খুবই সীমিত। তবে একেবারেই যে নেই, তা নয়। বড় কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ছোট কারখানার ক্ষেত্রে তা একেবারেই কম। তবে পোশাক রফতানিতে গড় ‘লিড টাইম’ (পণ্য পরিবহণের বেঁধে দেয়া সময় বা নির্দিষ্ট সময়কাল) কমেছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষেত্রে কারখানার আয়তন ও স্থান সম্পৃক্ত। সব কারখানায় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে না। কারখানায় ব্যবস্থাপনা পরিচালনার ক্ষেত্রে খুব একটা উন্নয়ন হচ্ছে না। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের উৎপাদনশীলতা এখনও খুবই নিম্ন।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, অনেক গার্মেন্টস পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে গেছে। মালিকানায় পরিবর্তন আসছে। শুধু দ্বিতীয় প্রজন্ম নয়, কোনো কোনো কোম্পানিতে তৃতীয় প্রজন্মও এসেছে। করপোরেট ম্যানেজমেন্ট শুরু হয়েছে। দিনে দিনে পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতে মূলধনের জন্য আমাদেরকে শেয়ার মার্কেটেও যেতে হবে। এছাড়াও পোশাক রফতানি বাড়লেও বাইরে থেকে জনবল আমদানি কমেছে। আমরা চাই, ভবিষ্যতে যেন টপ ম্যানেজমেন্টের কর্মী দেশেই গড়ে উঠে।
দিনব্যাপী এই আলোচনায় কয়েকটি সেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আরও বক্তব্য রাখেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, আন্তপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, বাণিজ্য সচিব শুভাশীষ বসু, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রমুখ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন