শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গণপরিবহন চালক-শ্রমিকরা যেন আগের চেয়েও বেপরোয়া

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম


ঈদুল আজহার পর ঢাকার নাগরিক জীবনে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসতে বেশ কিছুদিন লেগে যায়। জুলাই মাসের ২৯ তারিখে ঢাকার কুর্মিটোলায় যাত্রীবাহী বাসের চাকায় ফুটপাতে অপেক্ষমান দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিল তা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্যসাধারণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সড়ক নিরাপত্তার মত একটি গুরুতর সামাজিক সংকট নিরসনে দেশের লাখ লাখ শিশু-কিশোরের রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ বিক্ষোভের পাশাপাশি দিনের পর দিন রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালনের ঘটনা বিশ্বইতিহাসে নজির বিহিন। এটি এমন এক সময়ে সংঘটিত হল, যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সরকারী বাহিনীর নানামুখী চাপে দিশাহারা। যখন কোন রাজনৈতিক দল বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে রাজপথে আন্দোলন করা দূরে থাক, সভা সমাবেশ করতেও সরকারী বাহিনীর বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। বিরোধিদলের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে লাখ লাখ নেতাকর্মী হামলা-মামলার ভয়ে কার্যত পলায়নপর জীবন বেঁচে নিতে বাধ্য হচ্ছে, ঠিক তখন দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে দেখিয়ে দিয়েছে, ঐক্যবদ্ধ জনতার কাছে সরকারী বাহিনী ও দলীয় লাঠিয়ালরা কোন শক্তিই নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যে দাবীর সাথে দেশের সব মানুষের স্বার্থ থাকে, গণ-আকাঙ্খার প্রতিফলন থাকায় তার প্রতি জনসর্থন থাকে তেমন দাবীর আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়না। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে এ দেশের নাগরিক সমাজের সুদীর্ঘ দিনের দাবী ও আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছিল বলেই সরকার, বিরোধিদল, নাগরিক সমাজ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ কোন পক্ষই অগ্রাহ্য করতে পারেনি। দাবী মেনে নেয়ার ঘোষনা দিয়ে এবং আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রায় সব পক্ষকেই শিশু-কিশোরদের সম্মিলিত উদ্যোগের সাথে সামিল হতে দেখা গেছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শিশু-কিশোরদের আন্দোলনের সংবাদ প্রচারে গণমাধ্যম. বিশেষত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উপর এক ধরনের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তিনবছর আগে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের লাইভ সংবাদ প্রচারে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশী স্বতস্ফুর্ত, প্রাণবন্ত, নাগরিক সমাজের প্রত্যাশিত ও যৌক্তিক প্রাণের দাবীতে শিশু-কিশোরদের আন্দোলন তার দশভাগের একভাগও প্রচার পায়নি এসব টিভি চ্যানেলে। তবে সরকারের নিয়ন্ত্রনাধীন টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি দেশের সাধারণ মানুষের আস্থায় অনেক আগেই চিড় ধরেছে। তারপরও দেশের পেশাদার গণমাধ্যম কর্মীরা প্রকৃত ঘটনাবলী জাতির সামনে তুলে ধরতে সদা বদ্ধপরিকর। শিশুদের আন্দোলনের চুড়ান্ত মহূর্তে সরকারী বাহিনী ও সরকারী দলের ক্যাডারদের টার্গেটে পরিনত হয়। সব বাঁধা ও হুমকি ডিঙ্গিয়ে যারা প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে ক্যামেরা নিয়ে রাজপথে অবস্থান করছিলেন তাদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শেল্টারে থাকা রাজনৈতিক ক্যাডারদের হামলার শিকার হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ের সব সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনেই ফেইজবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মেইনস্ট্রীম মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করছে। মূল ধারার গণমাধ্যমকর্মীদের অনুপস্থিতিতে রাজপথে সংঘটিত ঘটনাবলী নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে উপস্থাপনের সুযোগের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাস্তার বাতি নিভিয়ে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে বাঁধা দেয়ার পর কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা সংঘটিত হলে তা নিয়ে গুজব ও অতিরঞ্জনের আশঙ্কা বহুগুন বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। গণমাধ্যম কর্মীদের উপর হামলা এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে পরোক্ষভাবে সরকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররাই এমন পরিস্থিতি তৈরী করেছে। ঘটনার নির্ভরযোগ্য তথ্যসুত্র খুঁজে পাওয়া না গেলে, সথ্যমিথ্যা যাচাই করার সুযোগ না থাকলে কথিত ঘটনার প্রচারকে কেউ গুজব, কেউ সত্য বলে মনে দাবী করতে পারে।
‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র মত একমাস আগে সংঘটিত নিরাপদ সড়কের আন্দোলন দেশের কথিত গণপরিবহন মাফিয়া তো বটেই খোদ সরকারের গদিকেই যেন নড়বড়ে করে দিয়েছিল। যদিও শিশু-কিশোররা কিছু সুনির্দিষ্ট দাবী দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছিল। সে সব দাবীর মধ্যে সরকার বা কোন মন্ত্রীর পদত্যাগসহ কোন রাজনৈতিক দাবী না থাকলেও সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কথাবার্তা ও আচরণে একধরনের নার্ভাসনেস প্রকাশিত হয়েছিল। আন্দোলনের শেষধাপে ধানমন্ডিতে, মিরপুরে এবং কয়েকটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও হেলমেট বাহিনীর যে তান্ডব ও ধরপাকড় দেখা গেছে তা আন্দোলন দমনে ক্রাশ প্রোগ্রাম হিসেবেই ব্যাখ্যাত হতে পারে। তবে আন্দোলনের শুরু ও সমাপ্তি যেভাবেই ঘটুক না কেন, এই আন্দোলন আমাদের ঘুণে ধরা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর আমাদের সন্তানদের শক্ত আঘাত বলেই গণ্য হয়েছে। তারা এবং তাদের পিতা-মাতা পরিজন সকলেই গণপরিবহনের নিরাপত্তাহীনতার শিকার। রাস্তায় নেমে হাতে নাতে তারা সড়কপথ ও গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার ফোঁকড়গুলো ধরিয়ে দিতেও সক্ষম হয়েছে। তারা দেখিয়েছে কিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্য আইন লঙ্ঘন করছে, কিভাবে কোন কোন আইনপ্রণেতা-মন্ত্রী লাইসেন্স বিহিন ড্রাইভার দিয়ে, উল্টোপথে গাড়ী চালাচ্ছেন। ডাকসাইটে মন্ত্রীরাও শিশু-কিশোরদের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে লা-জওয়াব হয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের সব দাবীই মেনে নিয়েছেন। অতএব সড়কপথের নিরাপত্তার চালচিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটবে এমনটাই ছিল নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা। ইতিমধ্যে বহুল প্রতিক্ষিত সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়া মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদন পেয়েছে। প্রস্তাবিত আইনেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অগ্রাহ্য হয়েছে এবং সংসদে চুড়ান্ত অনুমোদনের আগে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে বলেও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনসহ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা ও দাবী তুলে ধরা হয়েছে। নাগরিক সমাজের সে সব প্রত্যাশা কতটা পুরণ হবে তা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমনে সংশয় দেখা দিয়েছে।
নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর এবারের ঈদযাত্রায় অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী সংখ্যক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। ঈদের ছুটির পর রাজধানীসহ সারাদেশে গণপরিহণের চালক-শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাব আরো প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র দুই সপ্তাহে শত শত মানুষের মৃত্যুই বলে দিচ্ছে নিরাপদ সড়কের দাবীতে শিশু কিশোরদের আন্দোলন তাদের মধ্যে কোন পরিবর্তনের বদলে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠার বার্তা দিয়েছে। শিশু কিশোরদের আন্দোলনের শুরুতে সড়ক পরিহন মালিক শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা ও নৌপরিবহন মন্ত্রীর তাচ্ছিল্যের হাসি, নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সাড়াদেশে গণপরিবহন বন্ধ রেখে লাখ লাখ যাত্রীকে জিম্মি করে ফেলার মধ্য দিয়েই শিশুদের আন্দোলনের প্রতি বিপ্রতীক চ্যালেঞ্জ ও ভিন্নবার্তা দিয়েছিল তারা। এখন সড়ক পরিবহনের আরো বেপরোয়া হয়ে পড়া এবং সড়কে মৃত্যুর মিছিল আগের চেয়ে বাড়িয়ে তোলার মধ্য দিয়ে সেই বার্তার যেন বাস্তবায়ন ঘটে চলেছে। সড়কপথে গত কয়েকদিনে সংঘটিত দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যুর ঘটনাগুলো দেশের পরিবর্তন প্রত্যাশী নাগরিকদের কপালে উদ্বিগ্ন চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে।
দেশের মানুষ সড়কপথে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে, পাশাপাশি গণপরিবহনে যাত্রী ভাড়া নিয়ে মুনাফাবাজি,নৈরাজ্য, সন্ত্রাস এবং নির্মমতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সিটি সার্ভিসের শতকরা ৯০ ভাগ গাড়ীর ফিটনেস ঠিক থাকেনা। গাড়ীতে যান্ত্রিক ত্রæটি, লক্কড়ঝক্কড় বডি, অপরিকল্পিত সিট প্লান, ভাঙ্গা ও নোংরা সিট, কখনো ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশী যাত্রী বহন করছে আবার কখনো সিটিং বা ডাইরেক্ট সার্ভিস নাম দিয়ে দিগুন বা তার বেশী ভাড়া হাঁকিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করে বাসে তুলছে। এসব ব্যাপার নিয়ে যাত্রীরা বাসের ভেতর চালক-শ্রমিকদের হাতে অপদস্ত নাজেহাল হচ্ছে, আবার কখনো চালক-হেল্পাররাও বাসযাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। তবে বাসচালক শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও যাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ঘটনা বিরল। রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কখনো যাত্রী হয়ে লোকাল বাসে চড়েননা। রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ এসব বিষয় কখনো আমলে নেয়না, প্রতিটি বাসস্টান্ডে মালিকশ্রমিকদের পক্ষে সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় থাকলেও বাসযাত্রিদের নিরাপত্তা ও স্বার্থের বেপারে কেউ নেই। অতএব বাসচালক ও শ্রমিকরূপী ডাকাত হন্তারকদের কাছে নাজেহাল হওয়াই যেন দরিদ্র খেটে খাওয়া, কর্মজীবী মানুষের নিয়তি। কয়েক মাস আগে দুই বাসের প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজিব হোসেনের একটি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত সেই বিচ্ছিন্ন হাতের ছবি পুরো জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। বেশকিছুদিন মুমুর্ষ অবস্থায় হাসপাতালের বেড়ে কাটিয়ে অবশেষে এই নৈরাজ্যের সমাজ থেকে চিরবিদায় নেন রাজিব। পিতৃহীন পরিবারের একমাত্র ভরসার স্থল রাজিব নিজের এবং ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখা ও ভরণপোষনের খরচ সে টিউশনি এবং খন্ডকালীন চাকরি করে যোগাড় করতো। প্রতিদিন সড়ক মহাসড়কে শতাধিক মানুষ দুর্ঘটনায় হতাহত হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই এমন হৃদয় বিদারক গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে। কুর্মিটোলা রমিজউদ্দিন স্কুলের শিক্ষার্থী রাজিব ও মিমের মৃত্যুর ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেয়া যায়না। মানুষের জীবন নিয়ে বাসচালকদের বেপরোয়া প্রতিযোগিতার শিকার এই শিক্ষার্থীরা। ঈদের সপ্তাহে নাটোরে একটি বাসের ধাক্কায় ১৫জন লেগুনাযাত্রি প্রাণ হারিয়েছে। যে বাসটির ধাক্কায় একসাথে ১৫ যাত্রী প্রাণ হারালো সেই চ্যালেঞ্জার বাসটি নাকি ২৬ বছর ধরে কোন রুটপারমিট ছাড়াই অবৈধভাবে চলাচল করেছে। মানিকগঞ্জে বিয়ের দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফেরার সময় উল্টোপথে আসা বাসের ধাক্কায় শিশু সন্তানসহ প্রাণ হারিয়েছে এক পুলিশ কনস্টেবল। প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রামে বাসের ভেতর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাসযাত্রী রেজাউল করিম রনি কাঠের ব্রাশ দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ধাক্কা দিয়ে গাড়ীর চাকার নিচে ফেলে হত্যা করে বাসের চালক ও হেল্পাররা। বাসের চাকায় আটকে যাওয়া রনির ছিন্নভিন্ন, থেতলানো দেহটি অনেক দুর টেনে নেয়ার পর হন্তারক চালক ও হেল্পার জানলা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যায়। বেশীরভাগ দুর্ঘটনার পর এমন প্রায় অভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত হন্তারক চালক হেল্পারদের কিছুই হয়না। গত রবিবার রাজধানীর মিরপুর শাহআলী থানার রাইনখোলা এলাকায় আরেকটি দুর্ঘটনার মামলায় অভিযুক্ত সন্দেহে জব্দ করে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় ঈগল পরিবহনের একটি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে ডিএমপির সাব ইনস্পেক্টর (এসআই) উত্তম সরকারের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। হত্যাকারী বাসচালক বিল্লাল হোসেনকে জনতা হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোর্পদ করেছে। বাসটিকে কর্ডন করে নিয়ে যাওয়ার সময় মোটরবাইকসহ পুলিশ কর্মকর্তাকে পিষে মেরে পালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল বাস চালক।
এ সপ্তাহে একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে দেশের কোটি মানুষের নজর কেড়েছে। সংবাদটি হচ্ছে, বুলগেরিয়ায় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন যাত্রী নিহত হওয়ার পর সে দেশের সরকারের ৩ মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে বুলগেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি শহরে এক বাস দুর্ঘটনায় ১৭জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়। এই ঘটনার দায় রাজনৈতিক নেতাদের নিতে হবে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বয়কো বরিসভ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের পদত্যাগের আহŸান জানানোর পর দেশটির সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ইভালো মাস্কোস্কি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যালেন্টিন রাদভ এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন মন্ত্রী নিকোলাই নানকভ পদত্যাগ করেন। সুসভ্য সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা কোন নতুন বিষয় নয়। আগস্টের মাঝামাঝিতে অস্ট্রেলিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের আভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের জেরে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী টার্নবুলকে হারাতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনজন কেবিনেট মন্ত্রী পদত্যাগের ঘোষনা দেয়ার পর আস্থাহীনতার সংকট ও নৈতিক মানদন্ডে টার্নবুল নিজেই পদত্যাগ করেন। আর জাপানে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীদের পদত্যাগ যেন অবকাশ যাপনের মত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। তুচ্ছ ও অগ্রাহ্য করার মত ঘটনায় গত ১০ বছরে সেখানকার ৪জন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং অন্তত ২ জন দায়িত্ব গ্রহনের ২ বছরের মধ্যেই জনপ্রিয়তা হারিয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ব্রেক্সিট বিতর্কে গত জুলাই মাসে বৃটেনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন এবং ডেভিড ডেভিস পদত্যাগ করেন। চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে বিভিন্ন দেশের অন্তত ২ ডজন মন্ত্রী ও সরকার প্রধান পদত্যাগ করেছেন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পোন্নত বিশ্বে সরকারের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের পদত্যাগের ঘটনাগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত আত্মমর্যাদাবোধের পরিচয় বহন করে থাকে। কুর্মিটোলায় বাসের চাকায় দুই শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে সারাদেশের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসার পর সরকারের যে মন্ত্রী টেলিভিশনের টকশোতে ত্রæর হাসি দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন, তিনি দেশের গণপরিবহন মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নেরও শীর্ষ নেতা। ইতিপূর্বেও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার পর সারাদেশের মানুষ যখন গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ও আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তখন এই মন্ত্রীকে নির্লজ্জভাবে হন্তারক গাড়ী চালকদের পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে। অথচ এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর বিবেকের দায় থেকেই তার পদত্যাগ করার কথা ছিল। এর থেকে অনেক দূরবর্তি দায় নিয়েও বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন। আমাদের দেশের মানুষও এ ধরনের দায়কে ধর্তব্যের মধ্যে রাখেনা। রানাপ্লাজা ধসে সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যুর পর দেশের গামের্ন্ট রফতানী অনেক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা পদত্যাগ দূরের কথা প্রকাশ্য দাঁত কেলিয়ে হেসেছেন। একজন তো দুর্ঘটনার জন্য বিরোধিদল বিএনপিকে দায়ী করে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে স্মরণীয় হয়ে গেছেন। দুর্ঘটনার পর উদ্ধার তৎপরতায় ব্যাপক ঘাটতি ও হাজার হাজার শ্রমিক হতাহতের দায় নিয়ে যে কোন সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ ছিল অবধারিত।
বেপরোয়া গাড়ী চালকের কারণে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর হাজার হাজার শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী রাজপথে নেমে আসার পর রাজধানী ঢাকার সড়কপথের চালচিত্র আমূল পাল্টে গিয়েছিল। সকলে এমন ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিল যে, শিক্ষার্থীদের দেখানো পথ ধরে দেশের গণপরিবহণের বিশৃঙ্খল, অরাজক ও বেপরোয়া অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। না, তা ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাওয়ার পর থেকেই গণপরিবহন চালকরা রাজপথে আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছে। ঈদের পরের এক সপ্তাহে সংঘটিত দুর্ঘটনা ও চালক-শ্রমিকদের হাতে অপমৃত্যুর ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়। রাজধানীতে গণপরিবহন চালক ও হেল্পারদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ওরা জনগনের উপর এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। যাত্রিদের জিম্মি করে নানা অজুহাতে বাড়তি ভাড়া তোলা এবং যে কোন প্রতিবাদি কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়া এবং নাজেহাল করার ঘটনা অহরহ ঘটছে। শুধুমাত্র চট্টগ্রামের রনি বা মিরপুরের উত্তম সরকারের মত রাস্তায় চাকার নিচে ফেলে হত্যার ঘটনাগুলোই চাঞ্চল্যকর সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেমে যাওয়ার পরও রাস্তায় প্রয়োজনীয় গাড়ী চলেনি। এর কারণ, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং গাড়ীর ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিলনা। ঈদ যাত্রায় লাখ লাখ মানুষকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ছেড়ে বাড়ি যেতে হবে, অতএব হাজার হাজার গাড়ীর ফিটনেস নয়, প্রয়োজন ফিটনেস সার্টিফিকেট। মিরপুর বিআরটিএ অফিস থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৮২টি ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রাপ্ত এসব গাড়ীর বেশীরভাগেরই হয়তো বহু আগেই ফিটনেস শেষ হয়ে গেছে। এতদিন ওরা ফিটনেস সার্টিফিকেট বা রুটপারমিট ছাড়াই কিছুটা লুকোচুরি করে চলছিল, এখন তারা সড়ক মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে। গত রবিবার ঈগল পরিবহনের যে গাড়টি এসআই উত্তমের উপর চালিয়ে তাকে হত্যা করল, সেই গাড়িটি একজন ব্যবসায়ীর গাড়িকে চাপা দিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে গাড়ীর মালিক বেঁচে গেলেও গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গাড়ির মালিক থানায় মামলা করেছিলেন। সেই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পড়েছিল এসআই উত্তম সরকারের উপর। তিনি গাড়ীটি জব্দ করে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় পেছন দিক থেকে তাকে মটরসাইকেল সহ চাপা দিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যাচ্ছিল হত্যাকারী ড্রাইভার বিল্লাল হোসেন। এই বিল্লাল হোসেনরা একদিনেই এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেনি। বছরের পর বছর ধরে এদেরকে যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে হন্তারকে পরিণত করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে অবস্থার পরিবর্তন হবেনা।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন