বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

পানির জন্য হাহাকার

প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
পানি মহান আল্লাহর এক নেয়ামত। প্রাণীজগতের সবকিছুই আল্লাহ পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের শরীরে ৭০ ভাগ পানির মতো, ভূপৃষ্ঠেরও প্রায় ৭০ ভাগ পানি; বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে এমনটিই জানা যায়। পানি ছাড়া মানুষের জীবন অচল। পানিশূন্যতা বা পানির অভাব মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও বিশুদ্ধ পানি না পাওয়া এখন বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা। সাধারণত গ্রীষ্মকালে পানির ব্যবহার অন্য সময়ের চেয়ে বহুগুণে বেশি হয়। অথচ এই প্রকৃত সত্যটি মেনে নেওয়া কষ্টকর; গত এক মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত যেসব খবর মানুষকে কষ্ট দিয়েছে তারমধ্যে ‘পানির হাহাকার’ সংবাদটি বেশ আলোচিত। এমন একটি দিন পাওয়া যায় না যে দিন কোনো না কোনো পত্রিকায় ‘পানির হাহাকার’ নিয়ে সংবাদ ছাপা হয় না! মানুষের এই মৌলিক প্রয়োজনটি পূরণের দায়িত্বরত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে দৃশ্যমান কিছু ভাবছে বলেও মনে হয় না। অনেকেই দিনের পর দিন গোসল করতে পারছেন না। মায়েরা সন্তানদের মুখে পানি দিতে পারছেন না। কিন্তু পানির সমস্যা দূর করা কি বড়ই কষ্টসাধ্য?
সরকারের দাবি বিদ্যুৎ বিভাগের উন্নতি সর্বাগ্রে। অথচ দেশের বিভিন্নস্থানে ওয়াসার দায়িত্বরত কর্তাব্যক্তিরা বলেন, গত এক সপ্তাহে লো-ভোল্টেজ, পানি সরবরাহ লাইনের ত্রুটি, নতুন লাইন স্থাপন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, লোডশেডিং-বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ওয়াসার ৭১৩টি পাম্পের মধ্যে ৮৭টি পাম্প বন্ধ ছিল। আর এ কারণে সর্বমোট ২৩৩ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ থাকায় এ সময়ের মধ্যে ২৪ কোটি ৮০ লাখ লিটার পানি উৎপাদন করার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। যার ফলে জনগণ চাহিদানুযায়ী পানি পায়নি বলে তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। চাহিদানুযায়ী নিরাপদ পানি না পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে।
বিশেজ্ঞদের মতে, ‘মানুষের ব্যবহার উপযোগী স্বচ্ছ পানির পরিমাণ মাত্র ২.৫ ভাগ। এর মধ্যে ৭০% মেরুদেশে বরফ হিসেবে, বাকি ৩০% মাটির আর্দ্রতা এবং ভূগর্ভস্থ পানি হিসেবে বিরাজিত। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ ৩৫টি দেশে পানি দুর্লভ হয়ে পড়বে, যা ১৯৯০ সালে ছিল ১৭টি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের ২০০৬-০৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পৃথিবীর ৭৮ কোটি মানুষ বা ১১% মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ৯০ কোটি এবং ২০১২ সালের হিসেবে ১০১ কোটি মানুষ নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে।’
বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৭% লোক পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। দেশে পানি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ১৩টি মন্ত্রণালয় ও ৪৭টির বেশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকলেও অনিয়ম, অসচেতনতা, দায়িত্বহীনতার কারণে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে কারখানার ব্যবহার করা রাসায়নিক বর্জ্য যা খাবার পানির সাথে মিশে পানিকে দূষিত করছে। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, এভাবে চলতে থাকলে ২০ বছর পর বিশ্বের কমপক্ষে ৪০০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানির জন্য হাহাকার করবে, যার মধ্যে বাংলাদেশে থাকবে কমপক্ষে ১০ কোটি মানুষ। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতি বছর পানির স্তর নামছে তিন মিটার হারে। এ অবস্থা যদি আরো কয়েক দশক চলতে থাকে তাহলে পানির ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দেবে। এভাবে সমস্যা যদি বাড়তেই থাকে তাহলে জনগণ যে কোনভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। সে জন্য বোদ্ধামহলকে প্রস্তুত থাকতে হবে, নয়তো অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতি বা কোনো জবাবদিহিতা মেনে নেওয়া লাগতে পারে। পানি সরবরাহে যেসব ত্রুটি দৃশ্যমান তা সমাধান করাই যুক্তিসঙ্গত।
গত ১১ এপ্রিল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, আমি ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে আগামী তিন দিনের মধ্যে বিদ্যমান পানি সংকট নিরসনের জন্য নির্দেশ দিয়েছি এতে করে ৭০ ভাগ সমস্যা দূর হবে। অথচ বাস্তবতা হলো আজও (২০ এপ্রিল, বুধবার) দৈনিক যুগান্তর ও ভোরের কাগজে ‘পানি নিয়ে হাহাকার : গরমে নগরবাসীর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ শিরোনামে সংবাদ বেরিয়েছে। এতে করে বুঝা যায় মন্ত্রীর কথা আর ওয়াসা কর্মকর্তাদের মাঝে বিশাল ব্যবধান। চাহিদানুযায়ী পানি কেন পাওয়া যায় না এ বিষয়ে ওয়াসা কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, চাহিদার ৪০ শতাংশ পানি ওয়াসা সরবরাহ করতে পেরেছে বলে তারা দাবি করছেন। এছাড়া পাম্প বিকল, জনশক্তির অভাব, বরাদ্দ নেই ইত্যাদি অজুহাত তো থাকছেই। প্রশ্ন হলো, আর কতকাল জনশক্তির অভাব ও ওয়াসার পাম্প বিকল এই দোহাই চলবে সেটাও আমাদের জানা নেই। এক তথ্যমতে, ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ কাজের জন্য বছরে ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে। মহানগরীর পানি সরবরাহের জন্য এ বাজেট বরাদ্দ যদি যথেষ্ট হয়ে থাকে তাহলেতো পানি সংকট থাকার কথা নয়। যথেষ্ট বরাদ্দের পরেও যখন পানির কষ্ট দূর হয় না তখন সংশয় তৈরি হয় যে, ওয়াসার জন্য বরাদ্দ টাকাগুলোও কি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের মতো হ্যাকিং(?) হচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নারী-শিশু ও যুবক-বৃদ্ধরা পানির অভাবে প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নেমে আসছেন। মিছিল, মিটিং, মানববন্ধনসহ ওয়াসার অফিসগুলোতে তালা ঝুলিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে দেশের কোথাও কোথাও পানির কলসি, ঝাড়ু ও জুতা নিয়ে মিছিল করছেন। পত্রিকা ও টেলিভিশন সংবাদকর্মীদের দেখলে তারা সমস্যার কথা তুলে ধরে তা প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানাভাবে অনুরোধ করছেন। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দৃষ্টি ফেরাতে সব ধরনের উপায় অবলম্বন করা হলেও পানির সমস্যা দূর হচ্ছে না। কোথাও কোথাও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সাংসদগণ নিয়মিত জনগণের তোপের মুখে পড়ছেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ তার এলাকার মানুষের পানির সমস্যা দূর করতে না পেরে জনগণের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালিয়ে ছিলেন বলে তাকে লোকেরা এখনও ‘দৌড় সালাউদ্দিন’ বলে জানেন। তেমনি জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হলে দৌড়েও পার পাবেন কিনা তা বলা মুশকিল। জনগণের ভয়ে দৌড়ে পালানোই সমাধান নয়। এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সর্বোপরি বলতে চাই, রাষ্ট্র প্রধানের সম্মানটাও যেহেতু সবার উপরে তেমনি দায়িত্বটাও বেশি পালন করতে হবে। শুধু পানি পাওয়ার দাবি নয় জনগণের যে কোনো দাবি পূরণের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা থাকতে হবে। লাঠিচার্জ আর বুলেটের ভয় দেখিয়ে জনগণকে সাময়িকভাবে দাবিয়ে রাখা যেতে পারে, তবে তা কল্যাণকর নয়। কেননা, জনগণের সেবার জন্য মূলত সরকার গঠন করা হয় সে বিষয়টি সামনে রেখে জনসম্পৃক্ত বিষয়ে সরকার এগিয়ে এসে পানির সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যা দূর করতে সচেষ্ট হবেন বলে প্রত্যাশা করছি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
সধনফঁষশধযযধৎ@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন