বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বেলা অবেলার গদ্য

গল্প

মু হা ম্ম দ কা মা ল হো সে ন | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৯ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

পেছন থেকে চৌধুরী সাহেব তবুও বিরক্তিহীন কন্ঠে চেঁচিয়ে ডাকে, ‘ও ভাই..ও ভাই একটু দাঁড়ান, প্লীজ আমার অঙ্কটা একটু কষে দিন।’ মানুষজন পড়িমরি করে ত্রস্ত পায়ে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে।
অঙ্কটা মিলে যাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে এই জন্মেও আর মেলার সম্ভাবনা নেই। সেই সম্ভাবনার সলতে’তে পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। তাই আশাটুকুও ক্ষীণ ও সুদূরপরাহত। ইশতিয়াক চৌধুরীর টাকা-পয়সা ও জমিজিরাত সবি ছিল। ছিল আরো অনেক কিছু। সুনাম প্রতিপত্তি ও ক্ষমতারও কোনো প্রকার অভাব কমতি ছিল না। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত সজ্জন। সৎ, আদর্শবান ও পরহেজগার ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। চতুর্দিকের আশপাশের কয়েক গ্রাম পর্যন্ত তিনি ছিলেন মধ্যমণি। নিজ খরচে এলাকায় একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। গাঁটের পয়সা খরচ করে স্কুল-মাদরাসা ও এতিমখানাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। নিজের তিন ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে করেছেন সু-প্রতিষ্ঠিত। ছেলেরা এখন সবাই স্ব স্ব অবস্থানে দেশ-বিদেশে উচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন। বড় ছেলে শাকিল চারবছর আগেই আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। এখন বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানে সেটেলড। বিয়ে করেছেন ওখানকার এক সিটি মেয়রের কন্যাকে। মেঝ ছেলে অনিকও অনেক কারিশমার পর লন্ডনে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে স্থায়ী হয়েছেন।বিয়ে করেছেন বৃটেনের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর মেয়েকে। ছোট ছেলে নওফেলও মোটামুটি সফল ও করিৎকর্মা ব্যবসায়ী। সেও ঢাকাতে অল্পসময়ের মধ্যে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলেছে। বউ বাচ্চাদের নিয়ে সেও মহাব্যস্ত। বিয়ে করেছেন শোবিজ জগতের এক সুন্দরী তন্বী মডেল কন্যাকে। ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরীর যাবতীয় সহায় সম্পত্তির সমুদয় অংশ আগেই তিন ছেলেদের মাঝে সমান হিস্যা অনুযায়ী ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছেন। শুধু ভাগাভাগি হয়নি তাদের দু’জনের। কেউ তাদের দায়িত্বভার পারতপক্ষে গ্রহণ করেনি। বৃদ্ধ বাবা-মার দিকে নজর ফেলার মতো ফুরসতও কোনো ছেলের নেই। তাদেরকে এই বয়সে দেখভাল করার চিন্তা ফিকির কোনো ছেলের মাঝেও আদতে দেখাও যাচ্ছে না। সবাই সবার স্ব স্ব বউ বাচ্চাকাচ্চা ও সম্পদের পেছনে অবিরাম ক্লান্তিহীন ছুঁটে চলেছে। প্রথম দিকে পিতামাতার জন্য সন্তানেরা একটু দায়সারাভাবে খোঁজ-খবর রাখলেও গত পাঁচ বছরে তাদের টিকিটির নাগালটুকুও পর্যন্ত কেউ খুঁজে পায়নি।
সময় কারোর জন্য বসে থাকে না। গতি দুর্গতি দু›টোই সমান পাল্লা দিয়ে চলে। বেলা অবেলার দুষ্টুচক্রে কেটে যায় যাপিত জীবন। অভাব অনটনে ও ধারদেনায় জর্জরিত রেহনুমা বেগম স্বামীকে নিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠেছেন। ছেলেদের কাছ থেকে এমন নিদারুণ প্রতিদান পাবেন জীবনে ঘুর্ণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি। মাঝে মাঝে নিজের পেট কেটে জরায়ু থলিটাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। এমন তিনতিনটে পাষণ্ড সন্তানকে কোথায় ধারণ করেছেন? দশ মাস দশ দিন সময়ের হিসেবে তো নিশ্চয়ই চাট্টেখানি কথা নয়! এদিকে ইশতিয়াক চৌধুরী সারাজীবনের অর্জিত সততা ও আদর্শের পুরস্কার এভাবে পাবেন দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। সারাজীবন মানুষের কল্যাণেই শুধু দিনরাত কাজ করে গেছেন। অথচ জীবনের এই সমীকরণটা তিনি আজ কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। সবকিছুু থেকেও তিনি সহায় সম্বলহীন, রিক্ত ও নিঃস্ব। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ও শিরায় শিরায় গিঁটবাতসহ নানারূপ অসুস্থতার প্রকোপ দানা বেঁধেছে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের। রেহনুমা বেগম পেটের দায়ে বেশ কিছুদিন অন্যের বাড়িতে কাজ করলেও ইদানিং স্বামীকে একা ফেলে কোথাও বের হতে খুব একটা সাহস পাচ্ছেন না। বৃদ্ধ মানুষটাকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে। কখন কোন সময়ে অনর্থক ঘটিয়ে ফেলে কে জানে। সহায় সম্পদ বলতে নিজেদের জন্য আছে শুধু মাথাগুজার সামান্য ভিটেমাটি টুকুই। রোগ-শোক ও মানসিক অস্থিরতায় বেশ কয়েক বৎসর যাবৎ মানুষটাও প্রায় পাগলপারা। রেহনুমা বেগম স্বামীকে নিয়ে পড়েছেন মস্তবড় দ্বন্দ্বে। নিয়তির কঠিন চ্যালেঞ্জের ঘোর অমানিশায় প্রতিনিয়ত তিনি খাবি খাচ্ছেন। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নিজের শূন্য হাতখানা। স্বামীর চিকিৎসায় নিজের স্বর্বস্ব দিয়ে প্রাণান্তকর লড়াই করে যাচ্ছেন। টিকে থাকার সে এক কঠিন লড়াই। যে লড়াইয়ের কোনো আদিঅন্ত নেই। ওদিকে ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরীও বসে নেই। মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষটার ব্যস্ততাও যেন কম নয়। বেলা অবেলার শেষ লগ্নে এসে এখনো হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছেন জীবনের সবচেয়ে জটিল অঙ্কখানা মেলাতে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন