শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব নদী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর

প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিজানুর রহমান তোতা : নদ-নদীর ঢেউ দেখা যায় না, শোনা যায় না দাপুটে গর্জন, নদী হয়ে গেছে পুকুর ও খাল, পায়ে হেঁটে নদ-নদী পার হওয়া যায়, নদীর বুকে চলে চাষাবাদ, নদপাড়ের মানুষের কানে ভেসে আসে নদীর কান্না, সব নদী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নদী একুল ভাঙে ওকুল গড়ে, এই তো নদীর খেলা Ñ সেই খেলা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। জনপ্রিয় গানে ছিল, কেউ কোনো দিন ঘর বেঁধো না নদীর ধারে আমিরকে সে এক পলকে পথের ফকির করে Ñ এখন হয়েছে উল্টো, নদীর ধারে এক শতক জমি কিনলে দখলে আসে কয়েকগুণ বেশি জমি। এমন কোনো নদ-নদী নেই যা দখল হয়নি, শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদী দখলের মহোৎসব চলছে, দখল কোনো দিন বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েই চলেছে দিনে দিনে Ñ এই চিত্র দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের মৃত ও অর্ধমৃত নদ-নদীর। কারো দৃষ্টি নেই এদিকে। অনেক নদী মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কার ধাক্কা সামলাতে না পেরে নদ-নদী কাহিল হয়ে পড়েছে বলে নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত। পরিবেশবাদীদের কথা, নদীই জীবন। নদী শুকিয়ে জীবন-জীবিকায় মহা সংকট নেমে আসছে। পরিবেশ হচ্ছে মারমুখী। ভূপৃষ্ঠে পানি নেই, ভূগর্ভেও পানি সংকট। চারদিকে পড়ছে পানির জন্য হাহাকার।
এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভর করে মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ইছামতী, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতী, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ ও নবগঙ্গাসহ পদ্মার শাখা-প্রশাখা এবং অভিন্ন নদ-নদীর উপর। অথচ নদ-নদী বাঁচাতে কখনোই জোরদার পদক্ষেপ নেয়া হয় না। পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন সেতু পয়েন্টের বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে ধু-ধু বালুচর। নদী নয়, খালের মতো শীর্ণ পদ্মা দিয়ে একরকম চুইয়ে পানি আসছে। শৈলকূপার কুমার নদী, নড়াইলের চিত্রা ও মধুমতি, কালীগঞ্জের চিত্রা, যশোরের কপোতাক্ষ, ভৈরব ও মুক্তেশ্বরীসহ গোটা অঞ্চলের ছোট-বড় নদ-নদীর পানিও দ্রুত কমে যাচ্ছে। বেশিরভাগই শুকিয়ে মুমূর্ষু খালে পরিণত হচ্ছে একসময়ের স্রোতস্বিনী ও প্রমত্তা নদ-নদী। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার ২২ হাজার ৭৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার কৃষি, শিল্প, বনজ, মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষায় পদ্মা ও গড়াইয়ের শাখা নদ-নদী খনন এবং সংস্কার অত্যন্ত জরুরী। স্বাধীনতার পর বহুবারই সকল নদ-নদী ড্রেজিং, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প ও পানির রিজার্ভার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পরিকল্পনা কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক নদী হয়ে পড়েছে অস্তিত্বহীন। গোটা অঞ্চলের ক্ষতি হয়েছে অপুরণীয়। এ অঞ্চলের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ বরাবরই প্রত্যাশা করে বিশাল এলাকার মাটি ও মানুষের স্বার্থে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নদ-নদী খনন ও সংস্কারের ব্যাপারে একটা মাষ্টার প্লান তৈরী করা হবে। কারণ নদ-নদী খনন ও সংস্কারের অভাবেই উর্বর জনপদ মারাত্মক হুমকির মুখে। ক্রমাগতভাবে সবুজ ঘেরা প্রান্তর হয়ে পড়ছে বিবর্ণ। তাছাড়া দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পও (জিকে প্রজেক্ট) পানির অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং মংলা সমুদ্রবন্দর ও নওয়াপাড়া নদী বন্দরের অবস্থাও শোচনীয়। নদ-নদী স্রোতহীন হয়ে পড়ায় লবনাক্ততা গ্রাস করছে নতুন নতুন এলাকা। কিন্তু জনপ্রত্যাশা পূরণে বাস্বমুখী পদক্ষেপ বরাবরই অনুপস্থিত থাকছে। মরা খালে পরিণত হচ্ছে নদ-নদী।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর মধ্যে ভৈরব নদ ছিল সবচেযে গভীর। এখন ভৈরব নদ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদ বাাঁচানোর আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঐহিত্যবাহী ভৈরব নদটি গঙ্গা থেকে বের হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে সীমান্ত জেলা মেহেরপুরে ঢুকেছে। মেহেরপুরের সুবলপুর পয়েন্টে মিশেছে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে। ভৈরব আর মাথাভাঙ্গা অভিন্ন ধারায় দর্শনা রেলস্টেশন এলাকা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়। কিন্তু ১৮৬১ সালে শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেলপথ স্থাপনের সময় ভৈরব নদ ভরাট করে মাথাভাঙ্গা নদীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ওই পয়েন্ট থেকে দর্শনা ও জীবননগর হয়ে ভৈরব নদ এসে মিশেছে চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষের সাথে। সেখান থেকে ভৈরব নদ যশোর ও শিল্পশহর নওয়াপাড়া হয়ে শিল্পনগরী খুলনা ছুঁয়ে সুন্দরবনের পশুর নদীতে গিয়ে মিশেছে।
ভৈরব নদকে ঘিরেই মূলত যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনায় নগর, শহর ও শিল্প গড়ে ওঠে। ব্যবসা-বাণিজ্যও সম্প্রসারিত হয়। ভৈরব নদে একসময় বড় বড় জাহাজ ভিড়তো। এখন ভৈরবে নদীপথ নেই বললেই চলে। নদটির গুরুত্ব রয়েছে অনেক। কিন্তু গুরুত্বটা অনুধাবন করছেন না সংশ্লিষ্টরা। যার জন্য নদ বাঁচানো কিংবা দখলমুক্ত করার উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেই। শুধু যশোর এলাকা নয়, বলা যায় পুরো ভৈরব নদটি দখল করে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট ও বড় অর্ধশতাধিক নদ-নদীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী শুকিয়ে গেছে ভৈরব নদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও হাইড্রোলজি বিভাগসহ সংশিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৪ শতাধিক কিলোমিটার নদপথের প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার শুকিয়ে গেছে। যার কোনো কোনো অংশে নদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। বিশেষ করে যশোর শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়ায় ভৈরব নদের প্রায় পুরোটাই অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। কোথাও নদের পাড় পাওয়া যাবে না যেখানে দখল হয়নি। অনেকে কাগজপত্র তৈরী করে ব্যক্তি সম্পত্তি করে নিয়েছে নদের জমি। নদের প্রশস্ততা কমে গিয়ে নদ কেন খাল হলো কিংবা ব্যক্তি সম্পত্তি হলো কিভাবে, কারা এর পেছনে কাজ করেছেÑএসবের কোনো তদন্ত কেউ করেনি। এমনকি যাদের দায়িত্ব তারা কখনো নদের সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগও নেয়নি। বরং সরকারী দায়িত্বে থাকা অনেকে নামে বেনামে নদপাড়ে বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ে তুলে মহানন্দে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদ এখন মরা। দুই পাড় দখল করতে করতে নদের অস্তিত্ব মুছে যেতে বসেছে। বড় বড় বাড়ীঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে প্রশাসনের চোখের সামনেই। দিনে দিনে দখল চলছেই।
শুধু যশোর শহরে নয়, শিল্পশহর নওয়াপাড়া ও খুলনায় ভৈরব নদ দখল হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘ ভৈরব নদে নতুন করে পাটা দিয়ে নদের স্বাভাবিক গতিকে থামিয়ে মাছ চাষসহ বিভিন্ন কর্মকা- করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, শহর ও শহরতলীর অংশে নদের দুই পাড় দখল করে পাকা বাড়ী-ঘর ও দোকান-পাট নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা। স্বাধীনতার পর যশোর জেলা প্রশাসন অন্তত অর্ধ শতবার অভিযান চালিয়েছে। বারবারই অভিযান শুরুর পরই থেমে গেছে রহস্যজনক কারণে। দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে সর্বশেষ দড়াটানা পয়েন্টে নদের দুই পাড়ে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। শহরের অভিজাত এলাকা ঘোপের পানি নিষ্কাশনের বড় ড্রেন যেটি হাসপাতালের সামনে তার উপরে বড় বিল্ডিং নির্মিত হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন