রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় আবারও বাংলাদেশকে দায়ী করলেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। গতকাল বৃহস্পতিবার ভিয়েতনামের হ্যানয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সে সময় বাংলাদেশ জানায়, তারা এখনো প্রস্তুত নয়।’ এদিকে, রোহিঙ্গাদের প্রতি অং সান সু চি’র আচরণ ‘জঘন্য’ এবং এজন্য তিনি মর্মাহত বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন মালয়েশিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার হওয়ার পরেও কালক্ষেপণের কারণ হিসেবে সু চি বলেন, ‘যারা পালিয়ে গেছে, তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার প্রস্তুত, কিন্তু এর সঙ্গে দুই দেশ জড়িত থাকায় বিষয়টি জটিল হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর আমরা সমঝোতা স্বাক্ষর করেছিলাম। চুক্তিতে যেহেতু দুই দেশ সম্পর্কিত, তাই কখন প্রত্যাবর্তন শুরু হবে সে বিষয়ে আমরা একা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাখাইনে শুধু মুসলমানরাই বাস করে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্বের অনেকে মনে করে। কিন্তু আসলে সেখানে আরো ছোট ছোট গোষ্ঠী আছে। তাদেরকে রক্ষার দায়িত্বও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর। সবার জন্যই আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা শুধু কাউকে বাছাই করে তাদের দেখভাল করতে পারি না।’
এদিকে, হংকং-এ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল বøুমবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আনোয়ার ইব্রাহিম জানান, রোহিঙ্গাদের প্রতি সু চি’র আচরণে তিনি মর্মাহত। এ ধরনের আচরণকে 'জঘন্য' আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
ভাগাভাগি করে প্রধানমন্ত্রিত্ব করাজনিত সমঝোতার অংশ হিসেবে এক, দুই বছরের মধ্যেই আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। বুধবার হংকংয়ে বøুমবার্গ টেলিভিশনকে সাক্ষাৎকার দেন আনোয়ার। সেসময় রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি’র নীরব ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এসব দিনগুলোতে সু চি’র আচরণে আমি মর্মাহত হয়েছি। বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই তাকে সমর্থন দিয়েছে। তাহলে কেন তিনি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাÐকে দেখেও না দেখার ভান করছেন?’
রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি’র আচরণকে ‘জঘন্য'’ আখ্যা দেওয়াটাকে সবচেয়ে যথার্থ বলে মনে করেন আনোয়ার। ‘হত্যা বন্ধ কর’ এতোটুকু বলার জন্যও সু চি প্রস্তুত ছিলেন না উল্লেখ করে আক্ষেপ জানান মালয়েশিয়ার এ হবু প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে, ২০১২ সালে নির্বাচনে জয় পাওয়ার জন্য সু চিকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন আনোয়ারের স্ত্রী ও মালয়েশিয়ার বর্তমান উপ প্রধানমন্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করার জন্য সু চি’র প্রতি আহŸান জানিয়েছিলেন তিনি।
এর আগেও সু চি বাংলাদেশের ওপর দায় চাপিয়েছিলেন। গত ২১ আগস্ট মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের। মিয়ানমার তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকেই প্রত্যাবাসনকারীদের ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা কেবল সীমান্তে তাদের স্বাগত জানাতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কত দ্রæত তারা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে চায়।’
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনও শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন।
সু চি বরাবরই তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করেন। রোহিঙ্গা শব্দের বদলে তাদেরকে ‘বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া’ মানুষ আখ্যা দেন। সেনা অভিযানের বিষয়ে নীরব থাকায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মুখে পড়েন দেশটির ডি ফ্যাক্টো সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী অং সান সু চি। ওই নীরবতার অভিযোগে এরই মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন তাকে দেওয়া সম্মাননা বাতিল করেছে। সূত্র- আল-জাজিরা, সিএনএন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন