শফিক ইসলাম ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে কাজ করেন। বাংলাদেশের একটি নামকরা কোম্পানীর পণ্যের প্রচারে ডিজিটাল মার্কেটিং-এর কাজ করেন। কোম্পানীর পণ্যের প্রচারণার উদ্দেশ্যে তিনি ওই কোম্পানীর নামে ও বিভিন্ন পণ্যের নামে সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি পেইজ পরিচালনা করেন তিনি। এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের অনেক নামকরা রাজনীতিবিদ, সেলিব্রেটি ও অন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের পেইজও পরিচালনা করে থাকেন বাড়তি আয়ের আশায়।
গত ২০ সেপ্টেম্বর হঠাৎ মেসেঞ্জারে তার কোম্পানীর সিইও তাকে একটি স্ক্রিন শট পাঠান। তাতে শফিক দেখতে পান, বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত নায়িকার নগ্ন ছবির সাথে তার কোম্পানীর চেয়ারম্যানের একটি সুপার ইম্পোজ করা নগ্ন ছবি আপত্তিকর বক্তব্যসহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিষয়টি চেয়ারম্যান যেকোনো মাধ্যমে জানতে পেরে সিইওকে পাঠিয়েছেন শফিককে দায়িত্বে অবহেলার কারণে চাকুরিচ্যূতির নির্দেশসহ। সিইও সাহেব চেয়ারম্যানের নির্দেশসহ শফিককে অফিসিয়ালি দ্রুত জবাব দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে এমন একটি নির্দেশ শফিকের মাথায় বজ্রাঘাতের মতো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তিনি দ্রুত কোম্পানীর পেইজে ঢুকে ছবিটি সার্চ করতে থাকেন। কিন্তু এমন কোনো ছবি পেইজে খুঁজে পান না।
এরপর তিনি ওই নামে পেইজ সার্চ দিয়ে হুবহু আরো একটি পেইজ খুঁজে পান এবং সেই পেইজের মধ্যে স্ক্রিনশটের ছবিটি দেখতে পান। সাথে সাথে সে বিষয়টি সিইওকে জানান। সিইও সেটা চেয়ারম্যান সাহেবকে জানান। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব তাতে কনভিন্স হন না। তার বক্তব্য ওই নায়িকা যদি তার নামে মানহানির মামলা করে তাহলে পুলিশ তাকে আগে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। এরপর এই পেইজ তার কোম্পানীর নয় তা তদন্তে করে প্রমাণ করে বের হয়ে আসতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। এরমধ্যে গণমাধ্যমে নিউজ হয়ে তার সামাজিক মর্যাদা, কোম্পানী সুনাম নষ্ট হবে। কাজেই শফিককে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জন্য বলেন। বিষয়টিতে শফিক নিজেও ভয় পেয়ে যান, কারণ একই ঘটনা তার সাথেও ঘটতে পারে। কারণ এই পেইজের এডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে পুলিশ তাকেও আটক করতে পারে।
শুধু শফিক ইসলাম নয়, দেশে বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ায় এবং এতে জামিন অযোগ্য শাস্তি সংযুক্ত হওয়ায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে, বিশেষ করে সামাজিক গণমাধ্যম ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সাথে সংযুক্ত পেশাদাররা আতঙ্কে আছেন। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের উপকারভোগী প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তারাও।
তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের সাথে সাথে মানুষের সামাজিক গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের বেশিরভাগটা জুড়েই থাকে সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুক। বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ফেসবুক গ্রাহক রয়েছেন। এই বিপুল সংখ্যক জনসম্পৃক্ততার কারণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই ফোরামকে ব্যবহার করছে বাণিজ্যিকভাবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ তাদের প্রচারের উদ্দেশ্যে এই ফোরামকে ব্যবহার করে। কিন্তু ফেসবুক এখনো বাংলাদেশের জন্য আইডি বা পেইজ ভেরিফাই অপশন চালু করেনি।
ফলে যখনই কোনো আইডি বা পেইজ জনপ্রিয় হয়, অসাধু লোকেরা সেই একই নামে, একই তথ্যে ও ছবি ব্যবহার করে আইডি, পেইজ খুলে প্রচার করতে শুরু করে। বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যম এখন সংবাদ প্রচারে সামাজিক গণমাধ্যমের সহায়তা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এসব সামাজিক গণমাধ্যমে খুঁজলে প্রকৃত প্রতিষ্ঠানের পেইজ ছাড়াও একই নাম, লোগো ও তথ্য দিয়ে অনেক পেইজ সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব পেইজে নানা ধরনের আপত্তিকর প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য। এতে প্রকৃত সেবা গ্রহণকারীরা কেবল বাণিজ্যিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, বিব্রতকর পরিস্থিতি, মানহানি, এমনকি আইন আদালত পর্যন্ত দৌড়াতে হয়।
বর্তমান ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন পাস হওয়ার পর এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ডিজিটাল মার্কেটিং অভিজ্ঞ ও পেশাদার মোহাম্মদ বাহারউদ্দীন ইনকিলাবকে বলেন, ‘আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে কাজ করি আমরা এখন আতংকিত। কতিপয় অসাধু ফেইক মেন্টালিটির মানুষের জন্য আমরা কেন আতঙ্কিত থাকবো? আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি ফেইক আইডি কিংবা পেজ দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয় তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত। আর কেউ যদি অপরাধ না করে তাহলে তাকে কোন প্রকার হয়রানি করা যাবে না। অপরাধ প্রমাণিত হবার পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত’।
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রশিক্ষক ব্ল্যাক আইজ আইটির সিইও মেহেদী আবদুল্লাহ ইনকিলাবকে এ বিষয়ে বলেন, ‘বিষয়টি ভয়াবহ আতঙ্কের ব্যাপার। আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি আইনের বিষয় আরো ট্রান্সপারেন্ট হওয়া উচিত ছিলো। বিশেষ করে এ জাতীয় অপরাধের ক্ষেত্রে আগে পর্যাপ্ত গবেষণা করে তারপর অ্যাকশনে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, যেহেতু আমার এখানে পরিপূর্ণভাবে আইপি ট্র্যাক করতে পারে না, বা করার মতো টেকনলজি এখানে নেই। ধরেন কেউ যদি ভিপিএন ইউজ করে কোনো পেইজ চালায় তাহলে তাকে ট্র্যাক করা অনেক সময়সাপেক্ষ। যদি সে ভাল মানের ভিপিএন ইউজ করে তাহলে তাকে ট্র্যাক করা কখনোই সম্ভব নয়।
ফলে দেখা যেতে পারে, যে মানুষটা এর সাথে জড়িত না সে যেকোনো সময় ফেঁসে যেতে পারে। এমনকি আমার আইপি ইউজ করে আমার নামে পেইজ খুলে অন্যজন অপকর্ম করতে পারে। কাজেই এ ধরনের ক্ষেত্রে যেকোনো অ্যাকশনে যাওয়ার আগে পর্যাপ্ত গবেষণা করা দরকার রয়েছে এবং এগুলো যারা হ্যান্ডেল করবেন, মনিটিরিং টিমে যারা থাকবেন তাদের আইটি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। আমি ওপর লেভেলের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের থানা লেভেলে যারা এগুলো হ্যান্ডেল করবেন তাদের এই জ্ঞান নেই। ফলে সাধারণ মানুষ, নিরাপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে তো রিয়েল আইপি দেয়াও হয় না। সবাই শেয়ার আইপি ব্যবহার করে। ফলে যে কারো আইপি দিয়ে যে কেউ যে কোনো জিনিস পোস্ট করতে পারে। আমার পরিচিত একজনের ফোনে থ্রেট আসার প্রেক্ষিতে সে সরকারের প্রায় সকল এ সংক্রান্ত সংস্থার কাছে গেছে। সকলে ৬ মাস ধরে চেষ্টা করেও বের করতে পারেনি থ্রেটটা কোথা থেকে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ও সাধারণ কেউ শত্রুতা বশত যে কাউকে খুব সহজেই ক্ষতি করতে পারবে। ফলে এই আইন নিরাপত্তার থেকে বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি করবে’।
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের প্রশিক্ষক ও জেনেসিস ব্লগের প্রধান মোহাম্মদ ইকরাম ইনকিলাবকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে আমি সমর্থন করি। কারণ আমাদের এখনকার বেশিরভাগ ক্রাইমগুলো ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করেই হচ্ছে। যে কাউকে হ্যারেসমেন্ট করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে তাকে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে বিব্রত করছে। এ ধরনের পরিস্থিতির বেশিরভাগ শিকার হচ্ছে আমাদের নারী এবং যারা সামাজিকভাবে সম্মানিত এবং পরিচিত ব্যক্তিরা। এ আইনের কারণে এগুলোও রোধ হবে- সেজন্য আমি অত্যন্ত খুশি’।
তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু আমাদের দেশের আইনগুলো সবসময় মিস ইউজ হয়। সরকার, দেশের পুলিশ প্রশাসন কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এবং বিভিন্ন সময়, এমনকি সাধারণ মানুষও আইনকে কাজে লাগিয়ে অন্যের ওপর আঘাত করে। এ আইনেও সেইরকম সুযোগ রয়েছে এবং খুব বড় ধরনের সুযোগ রয়েছে। আমার নাম দিয়ে যদি আরেকটা আইডি খুলে সেই আইডিকে জনপ্রিয় করে কেউ একজন আইডি হতে সরকার বিরোধী কোন বক্তব্য পোস্ট করে, তাহলে পুলিশ তদন্ত ছাড়াই এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেলো।
একই ঘটনা বিভিন্ন সেলিব্রেটি কিংবা বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের নামে আলাদা পেইজ খুলেও করা হতে পারে। আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সেলিব্রেটিদের নামে অসংখ্য আইডি খুলে কিংবা পেইজ খুলে অনেক অপরাধ ঘটছে। অনেক সময় বুঝা যায় না, কোনটা সেলিব্রেটিদের আসল অফিসিয়াল পেইজ। অনেক সময় বিপদে পড়ার পর সেলিব্রেটিরা হয়ত সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা দিচ্ছেন তার আসল অফিসিয়াল পেইজ এবং ফেসবুক আইডি কোনটি’।
ইকরাম বলেন, ‘এ আইনের কারণে সেই সব সেলিব্রেটিরাও তাদের ফেইক পেইজের উস্কানিমূলক পোস্টের কারণে বিপদে পড়তে পারে। কিংবা সেই সেলিব্রেটিদের আইডি হ্যাক হয়ে বেহাত হয়ে যেতে পারে এবং সেই আইডি থেকেও আপত্তিকর পোস্ট যেতে পারে। কিন্তু সেই পোস্টের কারণে দায়দায়িত্বগুলো সেই আইডির মূল মালিকের ওপর এসে পড়বে। ত্ইা এ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সতর্কতার বিষয়েও কিছু পয়েন্ট যুক্ত করা জরুরী মনে করছি। না হলে প্রত্যেকটা মানুষকেই শত্রুতাবশত বিপদে ফেলানো সামনের দিনগুলোতে অনেক সহজ হবে।’
এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ইনকিলাবকে বলেন, ‘এই আইন নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো আতঙ্ক নেই। আপনারা যারা কলম নিয়ে চলছেন আতঙ্ক তাদের মাঝে। এই আইন সাংবাদিকরা প্রতিরোধ করছেন। আমি বুঝি না আইনটা হয়েছে অপরাধ দমনের জন্য, সাংবাদিকরা এতে আতঙ্কে থাকছেন কেন? তার মানে কি সাংবাদিকরা ডিজিটাল অপরাধ করার জন্য অবাধ স্বাধীনতা চায়’?
সামাজিক গণমাধ্যমে ফেক আইডি ও পেইজ খুলে অপপ্রচারের আইনগত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তিনি বলেন, ‘সরকার এখন এতোটা দুর্বল নয় যে, এখন কোনো আইডি ভেরিফাই করতে পারে না। কাজেই এটা আমি যুক্তিসঙ্গত মনে করি না। যে আইন এখনো প্রয়োগ হয়নি তা নিয়ে এতো আতঙ্কের কারণ কী? আমি এখানে আতঙ্কের কোনো কারণ দেখি না।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন