শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কক্সবাজারের মাঠে বাম্পার লবণ উৎপাদন

রফতানির সম্ভাবনা সৃষ্টি, আমদানির চক্রান্তে লিপ্ত সিন্ডিকেট

প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কক্সবাজার অফিস : চলতি মৌসুমে লবণের বাম্পার উৎপাদনে মহাখুশী কক্সবাজারের লবণ সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ। ১৬ লাখ মে.টন জাতীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানীর সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও পরিতোষ গং নামের ৬ মিল মালিকের একটি সিন্ডিকেট সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে। লবণ আমদানির চক্রান্তে লিপ্ত এই সিন্ডিকেটকে রুখে দেয়ার দাবী জানিয়েছেন লবণ সংশ্লিষ্টরা।
শতাব্দীকাল থেকে লবণ উৎপাদনে ভূমিকা রেখে আসছেন কক্সবাজার উপকূলের মানুষ। কক্সবাজারের লবণ চাষীরা আজ সফল। কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানীর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। লবণ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের লবণ আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রশংসিত হয়েছে সর্বত্র। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রামু সেনানিবাসে ‘লবণ আমদানি নয় প্রয়োজনে রপ্তানী করা হবে’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা খুবই প্রশংসিত হয়েছে। কক্সবাজারের লবণ সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ এজন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে কক্সবাজার জেলার উখিয়া ছাড়া ৭ উপজেলা এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেই রয়েছে লবণ উৎপাদন উপযোগী জমি। এই জমির পরিমাণ বিসিকের হিসেব মতে ৯৪ হাজার একর হলেও বাস্তবে এর পরিমাণ দুই লাখ একরের কাছাকাছি। রোদ বৃষ্টিতে হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে হাজার হাজার চাষী লবণ উৎপাদন ও লবণ খাতে দেশকে স্বনির্ভর করতে চেষ্টা চালিয়ে আসছে যুগের পর যুগ। দেশে উৎপাদিত লবণ দিয়েই দেশের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। বিদেশ থেকে লবণ আমদানির প্রয়োজন হয় না। এতে দেশ লবণ খাতে হবে স্বনির্ভর।
কিন্তু ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীক পরিতোষ গংদের ‘সিক্সমিল সিন্ডিকেট’ সরকারকে ভুল বুঝিয়ে এবং দেশে কৃত্রিম লবণ সংকট দেখিয়ে ভারত থেকে লবণ আমদানি করে আসছিল প্রতিবছর। এতে নিজেরা লাভবান হলেও দেশের স্বনির্ভর লবণ খাতকে বিপর্যস্ত করে রাখে তারা। চলতি লবণ মৌসুমে সরকার বিষয়টি শক্ত হাতে হেন্ডেল করে লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতেকরে এপর্যন্ত সেই সুবিধা ভোগী সিন্ডেকেট সফল হয়নি। এতে উৎসাহিত হয়েছে লবণ চাষীরা। লবণের ন্যায্য মূল্য পেয়েছে তারা।
দেখা গেছে, গত কয়বছর লবণের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে চাষীরা লবণ চাষ ছেড়ে দিয়েছিল। চলতি মৌসুমে সরকারের লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণায় খুশী হয়েছে কক্সবাজারের লবণ চাষীরা। নতুন উদ্দম ও প্রেরণায় মাঠে নেমেছে প্রায় ৬০ হাজার লবণ চাষী। মৌসুমের এই পর্যন্ত তারা সফল হয়েছে। এই পর্যন্ত যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে এতে ধরে নেয়া যায় মৌসুমের বাকি সময় আবহাওয়া অনুকূল থাকলে লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ লবণ উৎপাদন হতে পারে। তাতে আমদানির প্রয়োজন তো হবেই না বরং উদ্ধৃত্ত লবণ রপ্তানী করা যাবে। তবে একাধিক চোরাচালান সিন্ডিকেট কৌশলে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিসিকের কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবসার উদ্দিন জানান, চলতি লবণ মৌসুমে ৬০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। এতে ৪০ হাজার চাষী লবণ উৎপাদনে নেমেছে। তিনি আরো জানান, এবারে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে চাষীরা মাঠে নেমেছে। এপর্যন্ত (২৯ এপ্রিল) ১৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ায় প্রতিদিন গড়ে যে পরিমাণ লবণ উৎপাদন হচ্ছে এতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সার্ফেলাস লবণ উৎপাদন হতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এপর্যন্ত জেলা প্রশাসক আলী হোসেন লবণ উৎপাদনের বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে লবণ চাষীদের কল্যাণে বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়, জনপ্রতিনিধি ও লবণ চাষী সমন্বয়ে একাধিক সভা হয়েছে। এতে লক্ষমাত্রা পূরণে যথাযথভাবে তদারকী ও চাষীদের সহায়তা দানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় বলে জানা গেছে।
এখন চাষীরা মাঠে প্রতিমণ সাদা লবণের মূল্য পাচ্ছে ৩ শত পঞ্চাশ টাকা থেকে ৪ শত টাকা। এতে তারা বেজায় খুশী। সরকারের লবণ আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে লবণ চাষীরা সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি লবণ আমদানিকারক চক্রগুলোর চক্রান্ত এখনো থামেনি বলে জানিয়ে তা বন্ধ করার দাবী জানান তারা।
লবণের ব্যাপক চাহিদার কারণে উৎপাদিত লবণ পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬০টি লবণ মিল-কারখানা। এসব মিলের মধ্যে শুধু কক্সবাজার সদরের বিসিক শিল্প নগরী ইসলামপুর কেন্দ্রিক ৪০ মিলসহ জেলায় ছোট বড় মিলে গড়ে উঠেছে অন্তত ৫০টি লবণ কারখানা। এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে অন্তত ৫ লক্ষাধিক কৃষক ও ব্যবসায়ী পরিবার। কিন্তু উৎপাদিত লবণ ও লবণের মিল-কারখানাগুলো দেশের ৬টি রাঘব বোয়াল মিলারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে তাদের অভিযোগ। সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না কৃষকের রক্তঝরা ঘামের।
বাংলাদেশ লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী, সম্পাদক কায়সার ইদ্্িরস, ইসলামপুর মিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আযাদ, চাষী আব্দুল গফুর সওদাগর ও কাজী আবুল মাসুদ এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ লবণ খাত রক্ষায় লবণ আমদানি না করার প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে স্বাগত জানান। পাশাপাশি লবণ খাত ধ্বংসে পরিতোষ গং সিন্ডিকেটের ভারত থেকে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র বন্ধ করারও দাবী জানান। তারা অরো অভিযোগ করেন সরকারের একজন উপসচিব পরিতোষ গংদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। তারা অরো জানান, প্রতি কেজি প্যাকেট করা লবণ তারা ১৫ টাকার মধ্যে সরবরাহ করতে পারবেন। অথচ ৬ মিল সিন্ডিকেট পরিতোষ গংরা প্রতি প্যাকেট লবণের দাম নিচ্ছে ৩০/৩৫ টাকা।
বাংলাদেশ লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, চলতি মৌসুমে ১৬ লাখ ৫৮ হাজার মে.টন হলেও ইতোমধ্যে তা পূরণ হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন দেড় লাখ মে.টন লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। আর দু’সপ্তাহ আবহাওয়া অনুকূল থাকলে কোন ধরনের ঘাটতি থাকবে না। তিনি আরো বলেন, ২২ এপিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত সামান্য বৃষ্টির কারণে উৎপাদন কিছুটা বিঘœ হয়েছিল। কিন্তু ঘাটতির পর্যায়ে যাওয়ার মত হয়নি।
এদিকে বিসিকের হিসাব মতে, প্রতি কেজি লবনে আয়োডিন প্রয়োজন হয় .০৯ গ্রাম। প্রতি কেজি ৪ হাজার ৭০০ টাকা হিসাবে এর দাম পড়ে ৪২পয়সা। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ, শ্রমিক, প্যাকেজিংসহ আনুষাঙ্গিক খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ২ টাকা ৫০ পয়সা। সব মিলিয়ে এক কেজি প্যাকেটজাত লবন উৎপাদনে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৭ টাকা। কোম্পানী ভেদে এ খরচ আরো কম। যদিওবা খরচ আরো কিছুটা বেশি বলে হিসাব দিচ্ছে ট্যারিফ কমিশন। কিন্তু পরিতোষ গংদের লবণ সিন্ডিকেট বাজার থেকে প্রতিকেজি প্যাকেট লবণের মূল্য নিচ্ছে ৩০/৩৫ টাকা। মাঠ থেকে সাদা লবণ ৫-৫.৫০ টাকায় ক্রয় করে তারা ৬গুণ বেশী দামে বিক্রি করে মানুষের পকেট কাটছে।
২০১০-১১ সালের দিকে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বলা হয়, উৎপাদন থেকে শুরু করে আয়োডিন মেশানো, প্যাকেজিং ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসাব করলে প্রতি কেজি লবণের দাম ৮ টাকার বেশি হওয়ার যৌক্তিকতা নেই। তার পরও কিন্তু বাজারে ৩০-৩৫ টাকায় লবণ বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত দামে লবণ বিক্রির দায়ে গত বছরের এপ্রিলে এসিআই সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইউনাইটেড সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, পূবালী ভ্যাকুয়াম ইভ্যাপোরেটেড সল্ট প্ল্যান্ট, ডায়ানা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড ও মোল্লা সল্ট (ট্রিপল রিফাইন্ড) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের পাঁচটি কোম্পানির আমদানি সনদ বাতিল করে সরকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন