শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

কিডনী রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা

মোঃ জহিরুল আলম শাহীন | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আমরা প্রতিদিন যে খাবার গ্রহণ করে থাকি তা শরীরের ব্যবহৃত হওয়ার পর বর্জ্য পদার্থ জমা হয়ে তা প্রধানত কিডনী দিয়েই বের হয়ে আসে। কিডনী মানব শরীরের দুটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। মানবদেহের উদর গহবরে পেছনের অংশে মেরুদন্ডের দুই বক্ক পিঞ্জরের নিচে পিঠ সংলগ্ন মেরুদন্ডের দুই পাশে দুইটি বৃক্ক বা করফহবু অবস্থিত। প্রতিটি বৃক্ক দেখতে শিমের বিচির মত এবং রং লালচে বর্ণের একটি পরিণত বৃক্কের দৈর্ঘ্য ১০-১২ সে.মি. প্রস্থ ৫-৬ সে.মি. এবং পুরুত্ব ৩ সে.মি। প্রত্যেকটির ওজন পুরুষের ১৫০-১৭০ গ্রাম এবং মহিলাদের ১৩০-১৫০ গ্রাম। বাম কিডনীটি ডান কিডনী অপেক্ষা সামান্য বড় এবং কিছুটা উপরে থাকে। বৃক্কের গাঠনিক এবং কার্যকরী একককে বলা হয় নেফ্রন। প্রতিটি বৃক্কে ১০/১২ লক্ষ নেফ্রন থাকে। প্রতিটি নেফ্রন প্রায় ৩ সে.মি. লম্বা। এ হিসাবে প্রত্যেক বৃক্কের নেফ্রনের নালিকা গুলো যোগ করলে দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৩৬ কি.মি. লম্বা। একজন স্বাভাবিক মানুষ প্রতিদিন ১৫০০ মিলিলিটার মূত্র ত্যাগ করে। প্রতিদিন কিডনী প্রায় ২০০ লিটার রক্ত শোধন করে ২-৩ লিটার রেচন পদার্থ মূত্র থলিতে জমা করে। যা মূত্রাকারে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কিডনী তার নেফ্রন বা ছাঁকনির মাধ্যমে রক্তকে পরিশোধিত করে অপ্রয়োজনীয় দূষিত পদার্থ মূত্রের মাধ্যমে বের করে দিয়ে আমাদের শরীর সুস্থ ও সবল রাখে। যদি কোন কারণে কিডনী রক্ত থেকে সেই দূষিত পদার্থ অপসারণ করতে না পারে তবেই শরীরে নানা রোগ ও কিডনী ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তখন কিডনীতে নানা রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। মূত্রে প্রায় ৯০ ভাগই পানি। অন্যান্য উপাদান হলো ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন, সোডিয়াম, অ্যামোনিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরাইড, ফসফেট। মূত্রে ইউরোক্রোম নামক এক ধরনের রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতিতে মূত্রের রং হালকা হলুদ হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনী রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর এই কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। এ দেশের মানুষের অসচেনতা, অসতর্কতা ও অবহেলার কারণে অতি নীরবই দেহে বাসা বাঁধে কিডনী রোগ। বেশির ভাগ কিডনী রোগ শুরুতে প্রকাশ পায় না বিধায় অনেকেই দেহে কিডনী রোগ আছে বলে বুঝতে পারে না। যখন কিডনীর সমস্যা শুরু হয় তখন ৭০-৭৫ শতাংশই কিডনীর কার্যকারীতা নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগটি নীরবই মানুষের মূল্যবান জীবন কেড়ে নেয়। তাই সচেতন ও সতর্ক হয়ে যদি প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনী রোগ সনাক্ত করা যায় তাহলে আংশিক বা পুরোপুরি বা ৬০ শতাংশ কিডনী রোগ নিরাময় করা সম্ভব বলে কিডনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মত প্রকাশ করে আসছেন। যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনী রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না তাই মাঝে মধ্যে কিডনী সুস্থ আছে কি না তা জানার জন্য প্রত্যেক মানুষকে বছরে একবার হলেও কিডনী পরীক্ষা করা উচিত। রক্তচাপ থাকলে নিয়মিত পরীক্ষা করা। ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানা থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা। প্র¯্রাবের সাথে অ্যালবুমিন এবং মাইক্রো অ্যালবুমিন আছে কিনা এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। একজন সুস্থ্য পুরুষের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৪ মিলিগ্রাম, মহিলার শরীরে ১.৩ মিলিগ্রাম সমান বা তার চেয়ে কম থাকা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়।
কিডনীর কাজ ঃ * রক্ত পরিশ্রæত করে দূষিত পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয়। * শরীরের পানির সমতা বজায় রাখে। * রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। * হাঁড় ও মজ্জাকে সবল রাখে। * লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি করার জন্য হরমোন তৈরি করে। * কিডনী আমাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম এর সমতা রক্ষা করে। * রক্তে এসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। * রক্ত থেকে সেবনকৃত ঔষধ অপসারণ করে। * কিডনী এসিড ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করে হরমোন এরিথ্রোপোয়েটিন ও এনজাইম রেনীন নিঃসরণ করে।
কিডনী রোগের কারণ ঃ কিডনী রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ বলা কঠিন। তবে কিছু কিছু কারণে কিডনী রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা নি¤েœ উল্লেখ করা হলোঃ
* পর্যাপ্ত পানি পান না করলে শরীরের বর্জ্য পদার্থ এবং লোহিত রক্ত কণিকার ভারসাম্য রক্ষা পায় না ফলে কিডনীতে রক্ত প্রবাহ কমে যায় এবং শরীরে দূষিত রাসায়নিক পদার্থ জমা হয়। * দীর্ঘক্ষণ প্র¯্রাব না করলে কিডনীর ভিতরে চাপ পড়ে এ থেকে ডাইভারটিকিউলোসিসের মতো জটিল রোগ হতে পারে ফলে কিডনীর কার্যকারীতা কমে যেতে পারে। * নানা প্রকার কোমল পানিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে। বিলাসিতা বা তৃষ্ণা নিবারণ যাই হোক না কেন অতিরিক্ত কোমল পানীয় খাওয়ার ফলে অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরে রক্ত চাপ বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত রক্তচাপ কিডনীর উপর চাপ পড়ে ফলে কিডনীতে সমস্যার সৃষ্টি করে। * শরীরে যেকোন বিষ ব্যাথার জন্য ব্যাথা নাশক ঔষধ কথায় কথায় খাওয়া খুবই ক্ষতিকর। সব ব্যাথা নাশক ঔষধেরই পাশর্^প্রতিক্রিয়া থাকে। সব ব্যাথা নাশক ঔষধই কিডনীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। * লবণ আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজন এবং সোডিয়ামের অভাব পূরণ করে। কিন্তু অতিরিক্ত লবণ দেহের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি কিডনীর জন্য খুবই ক্ষতিকর এতে কিডনীর প্রতি চাপ পড়ে বেশি এবং কিডনী নানা রোগে আক্রান্ত হয়। * বেশি বেশি প্রাণিজ প্রোটিন সমৃদ্ধ জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত নয় অতিরিক্ত প্রোটিন কিডনীর জন্য ক্ষতিকর তাই লাল মাংস গরু বা ছাগলের মাংস বেশি খাওয়া উচিত নয়। * ধূমপান কিডনীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপানে যে নিকোটিন থাকে তা কিডনী সহ্য করতে পারে না। তাই অবশ্যই সুস্থ্য কিডনীর জন্য ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। * রাত জেগে দেরিতে ঘুমানো আমাদের অনেকেরই অভ্যাস। অধিক রাত জেগে ঘুমানোর অভ্যাস তৈরি হলে তা ধীরে ধীরে কিডনীর উপর চাপ বাড়ে এবং কিডনীর কাজ করার ক্ষমতা বাঁধা গ্রস্থ করে। ঘুমের মাধ্যমে আমাদের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন বিশ্রাম পায় তেমনি শরীরের কাজ কর্ম সুন্দরভাবে সমাধান করতে পারে। * দেহে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এরোগ দুইটি কিডনীর ছাঁকনি ধ্বংস করে দেয় ফলে অকেজো হয়ে যায় কিডনী। * যারা অ্যালকোহল পান করেন তাদের জন্য কিডনীর সমস্যা বেশি থাকে। অ্যালকোহলের টক্সিন শরীর থেকে দূর করতে কিডনীর মারাত্মক সমস্যা হয়। তাই মদ পান সুস্থ্য কিডনীর জন্য ছেড়ে দিতে হবে। * অতিরিক্ত ডায়রিয়া, বমি, রক্তক্ষরণ আকস্মিক কিডনী বিকল হতে পারে। * মেয়েদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ পরবর্তী পর্যায়ে কিডনী রোগের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। * অপ্রয়োজনীয় অন্টিবায়টিক গ্রহণ কিডনী রোগের জন্ম দিতে পারে।
কিডনী রোগের লক্ষণ ঃ বিশেষজ্ঞ কিডনী চিকিৎসকদের মতে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখে বুঝে নিতে পারেন আপনার কিডনী রোগ আছে কিনা।
* প্র¯্রাবে সমস্যা ঃ কিডনী মূত্র তৈরী করে এবং যখন কিডনী রোগে আক্রান্ত হয় তখন-
* রোগের বড় লক্ষণ হলো প্র¯্রাবে পরিবর্তন। * প্র¯্রাবের পরিমাণ বেশি বা কমে যাওয়া। * রাতের বেলা প্র¯্রাব বেশী হওয়া। * প্র¯্রাবের রং গাঢ় হওয়া। * প্র¯্রাবে রক্ত যাওয়া বা লাল বর্ণের হওয়া। * প্র¯্রাব ধীরে অসম্পূর্ণ বা ব্যথাযুক্ত বা কিছুক্ষণ পর প্র¯্রাব হওয়া। * ফেনাযুক্ত প্র¯্রাব হওয়া এর কারণ প্র¯্রাবে অ্যালবুমিন নামক প্রোটিনের উপস্থিতিতে এরকম হয়। এতে প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন বেরিয়ে যায়।
* শরীর ফুলে যাওয়া ঃ কিডনী শরীরের বর্জ্য এবং অতিরিক্ত পানি বের করে দেয়। কিডনীতে সমস্যা দেখা দিলে বাড়তি পানি শরীর থেকে বের হতে পারে না। অতিরিক্ত পানি জমে শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে যায়। যেমন: পায়ের পাতা, গিরা, দুই পা, চোখের পাতার নিচ, পেট, বুক ইত্যাদিতে পানি জমতে পারে।
নিয়মিত কিডনী পরীক্ষা করার ঃ যারা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন তারা অন্তত ৬ মাস পর পর কিডনী পরীক্ষা করান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন। অপরদিকে সব প্রাপ্ত বয়স্করাই নিয়মিত কিডনীর কার্যকারীতা সঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করান। তাছাড়া শিশুদের গলা ব্যথা, জ¦র, ত্বকে খোসপাসড়া দেখাদিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এ গুলো থেকে কিডনী প্রদাহ বা নেফ্রাইটিস রোগ দেখা দিতে পারে। ডায়রিয়া, বমি, রক্ত আমাশয়ের কারণে রক্ত গিয়ে এবং দেহ থেকে পানি বের হয়ে গিয়ে কিডনী বিকল হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন প্রকার এন্টিবায়টিক সেবন করবেন না। অপর দিকে দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনী রোগ আছে কিনা এবং একটি সহজ সমীকরণের মাধ্যমে কিডনীর শতভাগের মধ্যে কত ভাগ কাজ করছে তা জানা যায়। একটি প্র¯্রাবে অ্যালবুমিন বা মাইক্রো অ্যালবুমিন যায় কিনা। অপরটি রক্তের ক্রিয়েটিয়েটিনিন পরিমান জেনে। এসবই চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন। সচেতন হোন সতর্ক হোন কিডনী রোগ প্রতিরোধ করুন।

শিক্ষক, কলাম ও স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন