উত্তর: ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবীর (রহ.) সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবী আবু হানীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন আলেমের শিক্ষায়তনে কি তোমার যাতায়াত আছে? আবু হানিফা সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরকম সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাবী আবু হানিফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম আবু হানিফা বলেন, ইমাম শাবীর (রহ) সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রে যাতায়াত শুরু করলাম। এ সময় আবু হানিফার (রহ.) বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর।
অল্প সময়েই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) পবিত্র কুরআন সুন্নাহর খিদমাত তার মেধা ও চিন্তাার ফলে মানুষের কাছে ইমাম হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর শিক্ষক হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমানের ইন্তেকালের পর তিনি উস্তাদের স্থলাভিষিক্ত হন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে তিনি ইলম চর্চা করে তার চিন্তাধারাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। তিনি ৪০ হাজার হাদীস থেকে বাছাই করে কিতাবুল আসার,আল ফিকহুল আকবার, আবসাত, মুসনাদু ইমাম আজম আবু হানিফাসহ অনেক কিতাব রচনা করেন। জীবনীকারগণ লিখেছেন, একমাত্র ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছাড়া আর কোন তাবিয়ী জীবদ্দশায় এত খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি পাননি।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন একজন ইবাদত গুজার মানুষ। তিনি জীবনভর নফল সালাত ও নফল সিয়ামে মশগুল ছিলেন। তিনি খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। একই সঙ্গে সত্যের ব্যাপারে, দ্বীনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন কঠোর এবং আপোষহীন। তাঁর প্রসিদ্ধ ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, ‘দ্বীন বিরোধী সব কিছু তিনি কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতেন। তিনি খুব পরহেযগার এবং আল্লাহভিরু ছিলেন। দ্বীনের বিষয়ে না জেনে তিনি কিছুই বলতেন না। তিনি দুনিয়াপ্রিয় মানুষদের এড়িয়ে চলতেন। তাঁকে যখন কোন প্রশ্ন করা হত, তিনি হাদিস কিংবা সাহাবিদের আমল থেকে ফতোয়া দিতেন। যখন হাদিস শরীফে অথবা সাহাবিদের আমলে দলিল পাওয়া না যেত, তখন তিনি কেয়াস করতেন। তিনি জ্ঞান ও সম্পদ মানুষের মাঝে অকাতরে বিলিয়ে দিতেন। (আখবারু আবু হানিফা : ৩১ পৃ.)।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর আপোষহীনতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হল, শত চাপাচাপি সত্যেও তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা নিতে অস্বীকার করেন। কারণ তিনি জানতেন, ওই সময় যদি ক্ষমতা নেয়া হত, তাহলে তিনি স্বাধীনও ও নিরপেক্ষভাবে বিচার-ফায়সালা করতে পারতেন না। রাবি ইবনে আসিম বলেন, উমাইয়া সরকারের গভর্ণর ইয়াযিদ ইবনে উমরের নির্দেশে তার কার্যালয়ে নিয়ে আসি। তিনি তাঁকে বায়তুল মালের দায়িত্ব নিতে বলেন। কিন্তু আবু হানিফা তা করতে অস্বীকার করেন। এ কারণে ইয়াযিদ ইবনে উমর তাকে ২০টি বেত্রাঘাত করেন। এরপর তাকে বিচারপতির দায়িত্ব নিতে বলা হলে তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যখন শেষ বয়সে পৌঁছান তখন ক্ষমতায় ছিলো আব্বাসীয় শাসক আল-মানসুর। খলিফা মানসুর ইমাম আবু হানিফাকে বাগদাদে নিজ প্রাসাদে ডেকে পাঠান। ইমামকে বলেন, আপনি আমার রাজ্যে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করুণ। এবারও ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ন্যায় বিচার করতে না পারার ভয়ে দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। খলিফার মুখের উপর অস্বীকারের অপরাধে তাকে কারাভোগ করতে হয়। এবং এ কারাগারেই তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর অন্যতম বৈশিষ্ট ছিলো, তিনি খুবই প্রশস্ত হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ্জ আদায় করেছিলেন। এ মহান ইমাম ৭০ বছর বয়সে ১৫০ হিজরি সনে শবে বরাতের রাতে বাগদাদের কারাগারে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদের খাইযুরান করবস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতের উচুঁ মাকাম দান করুন। আমিন।
উত্তর দিচ্ছেন ঃ মুফতি মাওলানা এহছানুল হক মুজাদ্দেদী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন