বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আচরণবিধি লংঘন রুখতে হবে

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আচরণবিধি লঙ্ঘনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে দেশজুড়ে। অনেক প্রার্থীই নির্বাচনে নিয়ম-কানুন মেনে চলেন না। মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন শোডাউন নিষিদ্ধ থাকা সত্তে¡ও পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, অনেক এলাকায় ব্যাপক শোডাউন করে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিরাট লটবহর নিয়ে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এসেও ফিরে যাওয়ার পথে মিছিল করছেন। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শুরু থেকেই নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি প্রতিপালনে ইসি’র এ ধরনের নির্লিপ্ততা কাম্য নয়। এতে জনসাধারণ আগামী দিনগুলোতে সংঘর্ষের আশঙ্কায় আছে। নির্বাচনী আচরণবিধি কারা, কেন লঙ্ঘন করেন, বিবেকবান মানুষ তা জানেন ও বোঝেন। এজন্য সংশ্লিষ্টদের আচরণবিধির সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। ঘটনা ঘটামাত্র যথাবিধি ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ইচ্ছা করলেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। নির্বাচনী কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ দৃঢ়ভাবে ন্যায়ের পক্ষে থাকলে কোনো প্রার্থী উল্টাসিধা করতে পারেন না। নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়া যেমন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, তেমনি নির্বাচন কমিশনের নিয়ম মেনে চলাও রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের কর্তব্য। ইসিকে হতে হবে কঠোর, যেন- ‘হাকিম নড়বে, তবু হুকুম নড়বে না’। মানুষ আইন মান্য করে শাস্তির ভয়ে। তাই যারা যত প্রভাবশালী ব্যক্তি হোক না কেন, নির্বাচনে নিয়ম-নীতিগুলো ভেঙে ফেললে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে বিচার করতে হবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দল অংশগ্রহণ করছে, এটা খুশির খবর। এখন নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে, এটাই মানুষের আশা। বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতেই পারে। তিরস্কার, জরিমানা, কারাদণ্ড, প্রার্থিতা বাতিল, যা-ই হোক, ব্যবস্থা দ্রুত নিতে হবে। আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে নির্বাচন কমিশনকে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির নিরপেক্ষ ও আন্তরিক ইচ্ছা দরকার। কোনো পক্ষপাত করা চলবে না। অভিযোগ পাওয়া গেলে তিনি যে দলেরই হোন, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। নিয়ম ও আইন মানতে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। যারা জনপ্রতিনিধি হবেন, সংসদে জনগণ ও দেশ নিয়ে কথা বলবেন তারা যদি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন তাহলে নির্বাচনে জয় বা পরাজয়ের পরও তারা আইন লঙ্ঘন করতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। পরবর্তীতেও সব ক্ষেত্রে তারা বিধি লঙ্ঘন করবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, অশান্তি সৃষ্টি হবে। আচরণবিধি লঙ্ঘনকারী প্রার্থী দেশ ও জাতির জন্য বিপজ্জনক। ভোটারদেরও এসব প্রার্থীদের বর্জন করতে হবে। প্রতীক বরাদ্দের আগে কোনো দল বা প্রার্থী সভা-সমাবেশ বা প্রচারণা চালাতে পারেন না। অথচ এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে, ছলে-বলে-কৌশলে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে সভা-সমাবেশ ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এভাবে আচরণবিধির লঙ্ঘন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি নির্বাচন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও তত্তাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন আইনের আওতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ক্ষেত্রে স্বাধীন। এপরও ব্যর্থ হলে কমিশনকে অবশ্যই জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে শক্ত অবস্থানে থেকে সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সহিংসতামুক্ত, পেশিচর্চার প্রবণতামুক্ত, সন্দেহহীন একটি নির্বাচন জাতি আশা করে। নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ভূমিকায় সৎ ও যোগ্য মানুষ নির্বাচিত হয়ে আসবে, এটাই শান্তিপ্রিয় সর্বসাধারণের কামনা।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। কোনো ধরনের পক্ষপাত করা যাবে না। আইন সবার জন্য সমান, এটা মনে রাখতে হবে। সব দলের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সব দলের এজেন্টকে বিনা বাধায় প্রবেশ ও দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। যেকোনো প্রভাব ও গোলযোগ হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখন থেকেই জোড়ালে কার্যক্রম দরকার। শুধু ভোটের দিন নয়, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট না হওয়া পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সক্রিয় থাকতে হবে। কোথাও অনিয়ম বা অবৈধ কর্মকাণ্ড দেখার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক ও শারীরিক দণ্ড দেওয়া উচিত। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কঠোর শাস্তি দিলে অন্যরা ভয়ে ভালো হতে চেষ্টা করবে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলে থাকে, তারা জনগণের সেবায় নিবেদিত। কিন্তু তাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ উল্টোমুখী। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলাই হবে আদর্শ মনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির পরিচয়। প্রতিদ্ব›দ্বী যে দলের, যে মতেরই হোন না কেন, নির্বাচন কমিশনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ মেনে চলে তিনি যদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন, তাহলে জনমানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। নির্বাচন কমিশনকে অবহেলা করে এবং নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রচার অব্যাহত রাখলে জনমানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কমতে বাধ্য। রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতির স্বার্থে নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে সুনাগরিকের ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণস্বরূপ সহনশীল আচরণ করতে হবে প্রার্থীদের। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন নতুন ঘটনা নয়। কোনো কোনো প্রার্থী ধারণা করছেন, ৫/৭ কোটি টাকা ও পেশিবলেই তাদের ভোটের হিসাব-নিকাশ হবে। নির্বাচন কমিশন বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘন না করার জন্য অনুরোধও জানায়। কিন্তু কোনো কোনো প্রার্থী এমন ভাব দেখান যে, তিনিই দেশসেরা ক্ষমতাবান, তার ওপরে আবার কে! এই ধরনের ভাব দেখানোরাই আচরণবিধি লঙ্ঘন করে থাকেন বারবার। এখনই এদের রশি টেনে না ধরলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। যারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন তারা যদি একটু বিবেকবান হতেন, আদর্শবান কিংবা সৎ হতেন, তাহলে লঙ্ঘনের ধৃষ্টতা দেখাতেন না।
নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে কোনো প্রার্থীই সাধু নয়। ক্ষমতার নেশায় সুযোগ পেলেই আচরণবিধি লঙ্ঘন করা মানুষের সহজাত অভ্যাস। নির্বাচন ব্যবসা নয়, পুঁজি বিনিয়োগ নয়, নির্বাচন মানে জনসেবা করার জন্য জনগণের রায় নেয়া। এ কথা মানলে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা কম ঘটবে। জনপ্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সব রাগ-অনুরাগ বা ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশ ও জাতির হিতাকাক্সক্ষী এবং সত্যিকার দেশপ্রেমিক প্রার্থীদের সাধারণ জনগণ বিশেষ করে তরুণরা ভোট দিতে চায়। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনোভাবে পক্ষপাতিত্ব চলে আসে তাহলে তা দেশের শান্তি বিনষ্ট করবে। শুধু প্রার্থী নয়, নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবাই আচরণবিধি রক্ষা করে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধি জনগণকে উপহার দেবে বলে আশা করি।
ইসির পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীসহ প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরি। অপরাধের বিচার না করা মানে অপরাধীকে উৎসাহ দেওয়া। মাঝেমধ্যে এমনও ঘটে, জনগণ তো দূরের কথা, প্রার্থী নিজের ভোট নিজে দিতে পারেন না, তারপরও কিছু কিছু গণমাধ্যমে প্রচার করে থাকে শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। এমন পক্ষপাতদুষ্ট খবর প্রচারকারীদের সতর্ক হতে হবে। এখন সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখতে হবে কেউ কোনো দিক থেকে গুজব ছড়িয়ে শৃঙ্খলা নষ্ট করে কি না। কমিশনের কোনো বিতর্কিত পদক্ষেপ বা কোনো সদস্যের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য যাতে নির্বাচনী পরিবেশকে বিতর্কিত করতে না পারে, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে।
নির্বাচনকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য নির্বাচনের আগে ও পরে সারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। একদিকে নির্বাচনী বিধি-বিধান, আর অন্যদিকে হলো স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ। দুই বিষয়ই একটি আরেকটির পরিপূরক। সব প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার কাজ আইনের মধ্যে থেকেই করতে হবে। প্রতিহিংসা বন্ধ করতে হবে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৩০ ডিসেম্বর বিরাট চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন