একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই প্রচারণায় নেমে পড়েছেন প্রার্থীরা। সারাদেশে নির্বাচনী উত্তাপ-উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রচারণার প্রথম দিনেই হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি জেলায়। পরবর্তীতে প্রচারণায় অংশ নিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারর হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ, ড. আব্দুল মঈন খানসহ সিনিয়র নেতারা। তবে ঢাকার বাইরে নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লেও রাজনীতি যেন তার ব্যতিক্রম। প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও নৌকার প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করলেও চোখে পড়ছে না বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ধানের শীষের প্রার্থীদের প্রচারণা। সর্বত্রই নৌকার প্রার্থীদের পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেলেও ধানের শীষের পোস্টার লাগাতে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেছেন ঢাকার প্রার্থীরা। একইসাথে ধানের শীষের পক্ষে নেতাকর্মীরা প্রচারণায় নামলেই তাদের ওপর হামলা, গ্রেফতার করা হচ্ছে বলেও জানান তারা।
ঢাকার ২০টির মধ্যে ঢাকা-১, ২, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১১, ১২, ১৪, ১৬, ১৭ এই কয়েকটি আসন ঘুরে দেখা যায়, এসব আসনের অলিতে-গলিতে কিংবা মূল সড়কে নৌকার প্রার্থীর পোস্টার ঝুলছে। এর পাশাপাশি হাতপাখার প্রার্থীরও পোস্টার রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মূল এবং প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ধানের শীষের প্রার্থীর কোন পোস্টার দেখা যায় নি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিএনপির প্রার্থীরা কয়েকটি আসনে পোস্টারই লাগাননি। আর যে কয়টিতে পোস্টার লাগানো শুরু করেছিল সেখানে পোস্টার রেখে দিয়ে অন্যদের মারধর কিংবা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। আর যে আসনে পোস্টার লাগানো হয়েছিল তা ছিড়ে ফেলা হয়।
ঢাকা-১৬ আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান। নির্বাচনী প্রচারণার তিন দিনেও তার দৃশ্যমান কোনো প্রচারণা চোখে পড়েনি। নানা কৌশলে প্রচারণার কথা বললেও বাস্তবতায় মাঠে নেই হাসান সমর্থকরা। ঢাকা-১২ (তেজগাঁও-রমনা) আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নীরব। গ্রেফতার আতঙ্কে এখনো মাঠেই নামতে পারেননি তিনি। তার কিছু সমর্থক প্রথম দুইদিন প্রচারণার জন্য নামার চেষ্টা করলেও বাধা ও গ্রেফতারের মুখে ফিরে যান।
নির্বাচনী প্রচারণায় নেতাকর্মীদের বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সাইফুল আলম নীরব বলেন, পুলিশী অত্যাচারে আমার নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারছে না। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক রবিনকে মীরবাগ এলাকায় লিফলেট বিতরণকালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা দলের নেত্রী লাবনী, রোকসানা, নাজনীন, পারুল, রুবি সাবিনা, কুলসুম, সুফিয়াকে লিফলেট বিতরণকালে বাধা দেওয়া হয়েছে। নেতার্কীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ধানের শীষের লিফলেট নিয়ে যায়। ২৫ নম্বর ওয়ার্ড তেজগাঁও রেলস্টেশন কলার আড়তের সামনে মারধর করা হয় পারু বেগম, মুক্তা, রীতা, সায়মা ও আবুল হোসেনকে। এ ছাড়াও ২৫, ২৭, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে লিফলেট বিতরণকালে মারধর করা হয় শিরিন, ইয়াসমিন, সোহাগী, প্রিমা, সায়মনকে। বিএনপি কর্মী মো. হাসিবকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মহিলা দলের নেত্রী রীনার বাসায় পুলিশ তল্লাশি করে হয়রানি করেছে।
ঢাকা-১৭ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। শুক্রবার প্রথম তিনি প্রচারণায় নামেন। এদিন রাজধানীর বনানী এলাকায় প্রচারনা চালান বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়ালকে নিয়ে। তবে ওই আসনের কোথাও তার পোস্টার কিংবা কর্মীদের গণসংযোগ করতে দেখা যায়নি। জানতে চাইলে পার্থ বলেন, পোস্টার লাগাতে গেলে বাধা দেয়া হচ্ছে। লাগানোর পর তা ছিড়ে ফেলছে। কোন নেতাকর্মীকে তার বাসায় ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। ফলে তিনি এককভাবেই প্রচারণায় নেমেছেন।
একই অবস্থা ঢাকার অন্য আসনগুলোতেও। অনেকে চেষ্টা করেছেন প্রচারণায় নামার কিন্তু পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বাধার মুখে ব্যর্থ হয়েছেন। ঢাকা-১ আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাক। তিনি বুধবার সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো নিজ এলাকায় প্রচারণায় নামলে তাকে আটক করে পুলিশ। পরে অবশ্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আশফাক জানান, পুলিশ তার প্রচারণা চালানোর সময় আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তারা (পুলিশ) জানায় তার নিরাপত্তার জন্য নাকি তাকে আটক করা হয়।
ঢাকা-৮ আসনে দুই হ্যাভিওয়েট প্রার্থীর লড়াই হওয়ার কথা। একদিকে ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, অন্যদিকে বিএনপির মির্জা আব্বাস। তবে নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সর্বত্রই রাশেদ খান মেননের নৌকা প্রতীকের পোস্টার চোখে পড়লেও এখনো পোস্টার টানাতে পারেননি মির্জা আব্বাস। এমনকি তিনি প্রচারণার জন্য বাড়ি থেকে বেরই হতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি জানান, তার বাসার চারপাশে সার্বক্ষণিক সাদা পোষাকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তার কর্মী-সমর্থকরা আসলেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। এমনকি তার বাসায় আসা অতিথিদেরকেও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা-৯ আসনের প্রার্থী মির্জা আব্বাসের সহধর্মিনী ও মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস। বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এই তিনদিনই তিনি প্রচারণায় বের হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিদিনই বাঁধা পেয়ে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে বুধবার প্রচালনাকালে তার ও কর্মীদের ওপর দুই দফা হামলা চালানো হয়। গতকালও তিনি বাঁধা পেয়ে প্রচারনা স্থগিত করে ফিরে আসেন। ঢাকা-২ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের ছেলে ইরফান ইবনে আমান অমি প্রতীক পেয়ে ১১ ডিসেম্বর বিশাল শোডাউন দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকেই তাকে আর প্রচারণায় নামতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু নেই। আমরা প্রচারণা চালাতে পারছি না। পদে পদে আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার ছিড়ে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় আমার পোস্টার লাগাতে দিচ্ছে না। গত রাতে রাসেল ও হিরা নামে আমার দুই কর্মীকে পোস্টারসহ আটক করে নিয়ে গেছে। এখনো তাদের কোনো হদিস পাইনি। এভাবে একপেশে নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচন কমিশনারের কাছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির দাবি জানান তিনি।
ঢাকা-৩ আসনে আনুষ্ঠানিক প্রচারণার দ্বিতীয় দিনে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিশাল শোডাউন দিয়েছেন। ঢাকা-৪ আসনে সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ঢাকা-৫ আসনে নবীউল্লাহ নবীও প্রচারণা চালিয়েছেন। তবে তারা বাধা পাওয়ার কোন অভিযোগ করেননি। ঢাকা-১৮ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী দেওয়া হয়েছে শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপনকে। তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির। বৃহস্পতিবার তার প্রচারণায় অংশ নেন ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা জেএসডির আ স ম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা। তারা প্রচারণা শুরু করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে তারা ফিরে আসেন। শুক্রবার আর স্বপন প্রচারণায় নামেননি। ঢাকা-১১ আসনে লড়ছেন উত্তর শাখা বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ুমের সহধর্মিণী শামীম আরা বেগম। তাকে কোথাও কোথাও লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে। তবে বড় ধরনের কোনো শোডাউন দেখা যায়নি। বুধবার শামীম আরা বেগম যান ভাটারা থানা বিএনপির সিনিয়র সভাপতি মরহুম কফিল উদ্দিন আহমেদের বাসায়। মঙ্গলবার তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পরিবার ও বিএনপির অভিযোগ পুলিশ তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে। ঢাকা-১৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী আবদুস সালাম। তিনি এখনো মোহাম্মদপুর এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু করতে পারেননি। গতকাল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তার প্রচারণা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে হামলা হলে ড. কামাল হোসেন দিনের সব প্রচারণা কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। তবে আগের দুই দিন আব্দুস সালাম একা একা শ্যামলী, আদাবরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় প্রচারণা চালান। তিনি বলেন, ছেলেরা আমার সাথে বের হলেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। নির্বাচন কমিশনে গিয়েছি সেখান থেকেও তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এজন্য আমি তাদেরকে বলেছি আমার সাথে বের হওয়ার দরকার নাই, আমি একাই প্রচারণা চালাবো দেখি কি হয়?
ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক সাজু। তার নির্বাচনী এলাকায় এখনো বড় ধরনের কোনো শোডাউন করতে পারেননি সাজু। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বাধার কথা উল্লেখ করে সাজু বলেন, তিনি কর্মীদের নিয়ে প্রচারণায় নামলেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। কর্মীদেরকে ফোন করে করে হুমকি দেয়া হচ্ছে যাতে তারা প্রচারণায় অংশ না নেয়, না শুনলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সতর্ক করা হচ্ছে।
ঢাকা-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। গতকাল তিনি ওই এলাকায় প্রচারণায় নামলেও বাধা পেয়ে ফিরে আসার কথা জানিয়েছেন। সুব্রত চৌধুরী জানান, শুক্রবার তিনি গোপীবাগ মহিলা কলেজের সামনে থেকে প্রচার শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি গেন্ডারিয়া মসজিদের সামনে পৌছালে তাদের চারপাশে হকিস্টিক, ক্রিকেট ব্যাট, লাঠিসোটা নিয়ে কিছু যুবক জড়ো হয়। সুব্রত চৌধুরী এগুতে চাইলে তাদের বাঁধা দেয়া হয়। পরে সেখান থেকে তিনি কর্মীদের নিয়ে ফিরে আসেন এবং কালকের মতো প্রচারণা স্থগিত করে দেন। এছাড়া গতকাল ঢাকা-৭ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ও গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টুর প্রথম প্রচারণায় নামেন। তিনি আজিমপুরে ওই আসনে বিএনপির আগের প্রার্থী মরহুম নাসিরউদ্দিন পিন্টুর কবর জিয়ারতের মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করেন। তবে তিনি বাধা পাওয়ার কোন অভিযোগ করেননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন