মরে গেলেও নির্বাচন বর্জন করব না : ড. কামাল হোসেন
‘ধানের শীষ’ প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে থাকা বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী, কর্মী ও সমর্থকদের অহেতুক হয়রানি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হুমকি, ধমকির পাশাপাশি মামলা ও গ্রেফতার করা হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা চালাচ্ছে নির্যাতন। প্রচারণায় বাঁধা এমনকি লিফলেট-পোস্টার লাগাতেও দিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এসব দেখেও নীরব ভূমিকা পালণ করছে। বার বার অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকারই মিলছে না। এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, মরে গেলেও আমরা নির্বাচন বর্জন করব না। প্রয়োজনে লাশ নিয়ে ভোট দিতে যাব। তবু ভোট কেন্দ্র ছাড়া হবে না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগী বলেন, আসলে এ ধরনের নির্বাচন কখনো দেখি নাই। বিরোধী দলের নেতাদের পুলিশ গণহাড়ে গ্রেফতার করছে। আর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা চালাচ্ছে নির্যাতন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এসব দেখেও নীরব ভূমিকা পালণ করছে। বার বার অভিযোগ দিলেও কোনো প্রতিকারই মিলছে না।
গত ১০ ডিসেম্বর থেকে থেকে তাদের জোটের নেতা–কর্মীদের ওপর হয়রানির মাত্রা বেড়ে গেছে। এই আট দিনে ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে ৯৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় তাদের ২ হাজার ২৪১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার হয়েছেন। একজননের মৃত্যুবরণ করেছে। এছাড়া প্রতিদিনেরই ইসিতে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করছে বিএনপি তবুও সাড়া মিলছে না।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে গতকাল সোমবার ইসির সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ তুলে ধরা হয়। এসময় ৩০টি জেলায় পুলিশি হয়রানি ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের নির্যাতনের ফিরিস্তি বৈঠকে উপস্থাপন কওে অতিদ্রুত এসবের প্রতিকার চাওয়া হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে অপর চার কমিশনার ছাড়াও নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের প্রধান ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, আ স ম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, নজরুল ইসলাম খান, ড. মইন খান, মোস্তফা মহসিন মিন্টু, জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ অংশ নেন। বিএনপির দেয়া তালিকার মধ্যে ঢাকা মহানগর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, জামালপুর, ঝিনাইদহ, ভোলা, চট্টগ্রাম, শেরপুর, ফরিদপুর, নেত্রকোনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ, ঠাকুরগাঁও, নোয়াখালী, রাজশাহী, যশোর, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, নরসিংদী, নাটোর, ব্রা²ণবাড়িয়া, জয়পুরহাট, মেহেরপুর, রংপুর, পাবনা, সাতক্ষীরা, ফেনী, সিরাজগঞ্জ ও হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতাকর্মী ও প্রার্থীদের প্রচারণায় বাধা ও হামলা করা হচ্ছে বলে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে দ্রæত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দাবি জানানো হয় বৈঠকে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ারও অনুরোধ জানান ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।
আট পৃষ্ঠার এই অভিযোগে বলা হয়, রোববার সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর কদমতলী বিএনপির সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সহ-সভাপতি মীর হোসেন মীরুর বাড়িতে গোয়েন্দা বিভাগের একজন সহকারী পুলিশের কমিশনারের নেতৃত্বে হানা দেয়। এসময় ধানের শীষের প্রচার চালানো যাবে না বলেও হুমকি দিয়ে যায় তারা। এছাড়া অন্য নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় পুলিশি তল্লাশির নামে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া আগামী নির্বাচনে ভোট থেকে বিরত রাখার জন্য পুলিশ অস্ত্র তুলে হুমকি দেয়। ঢাকা-৯ সংসদীয় আসনে ধানের শীষের প্রার্থী আফরোজা আব্বাস ১২ ডিসেম্বর জনসংযোগে বের হলে আকস্মিকভাবে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আক্রমন চালায় ও ধানের শীষের লিফলেট কেড়ে নেয়, এবং তার গাড়ি ভাঙচুর করে। তখন বিএনপি’র স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাক্তার রফিকুল ইসলাম বিএনপি নেতা রিপন ও সিরাজসহ অনেকেই গুরুতর জখম হয়। নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারীকে সাদা পোশাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়, এখন পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একইভাবে মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবদুল হামিদের বাসায় তল্লশির নামে পুলিশ হামলা চালায়। নির্বাচন কমিশন এসব দেখেও নীরব ভূমিকা পালন করছে। সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাসহ সব থানার ওসিদের প্রত্যাহার করলে নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে পাওয়া যাবে বলে অভিযোগে বলা হয়।
এদিকে দেশের বিভিন্ন জেলার চিত্র তুলে ধরে বৈঠকে জানানো হয়, রোববার চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার ধানের শীষের প্রার্থী আবদুল মান্নানসহ বিএনপি নেতাকর্মীরা গণসংযোগ শেষে ফেরার পথে পুলিশ বাধা দেয়, এমনকি তাদের গুলিও করা হয়েছে। কুমিল্লা শহরে বিএনপির নেতাকর্মীরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে শহরে বের হলে তাদের বাধা দেয় পুলিশসহ আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করায় ৫ জন বিএনপি নেতাকর্মী গুরুতর জখম হয়। এসময় তিনজন সমর্থকের দোকানে ভাঙচুর করা হয়। আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করা হলে, নৌকা মার্কা ছাড়া এলাকায় কেউ থাকতে পারবে না বলে পুলিশ সুপার অফিস থেকে জানানো হয়। জামালপুর-৩ আসনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলসহ নেতাকর্মীরা হযরত শাহ কামাল (র.) এর মাজার জিয়ারত করতে গেলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ১০-১২ জন নেতাকর্মীকে গুরুতর জখম করা হয়।
ভোলা-৪ আসনের প্রার্থী নাজিম উদ্দিন আলমের গাড়ি ভাঙচুর করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। সেখানে পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করলে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। চট্টগ্রামে রোববার সন্ধ্যায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বিএনপি’র প্রার্থী আসলাম চৌধুরীর বাড়িতে চলা নির্বাচনি সভা থেকে বের হওয়ার পর ২৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। চট্টগ্রাম-৭ আসনের বিএনপির প্রার্থীকে অবৈধ অস্ত্র ধরিয়ে গ্রেফতার করা হয়। শেরপুর জেলার শ্রীবর্দি উপজেলা বিএনপির নির্বাচনী পথ সভায় পুলিশ আক্রমণ চালিয়ে পন্ড করে। ফরিদপুর শহরে ৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। শহরের ২/৩ নং ওয়ার্ডে বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়।
বিএনপির চিঠিতে বলা হয়, গত ১০ ডিসেম্বর থেকে থেকে তাদের জোটের নেতা–কর্মীদের ওপর হয়রানির মাত্রা বেড়ে গেছে। এই আট দিনে ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে ৯৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় তাদের ২ হাজার ২৪১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার হয়েছেন। মামলা ও গ্রেফতারের সংখ্যা উল্লেখ করে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি তালিকা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে দেওয়া হয়। তালিকায় উল্লেখ করা হয়, ১০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের পর ৯৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার এজাহারে ১২ হাজার ১৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাগুলো করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে আরও ৯ হাজার ৭৩৩ জনকে আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে ২ হাজার ২৪১ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ইসিকে জানানো হয়, প্রতীক বরাদ্দের পর তাদের ২৪ নেতা–কর্মী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত হয়েছেন এবং ৪ জন মারা গেছেন।
বৈঠকে ইসিকে জানানো হয়, ১১ নভেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপিসহ ২০–দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১৫৮টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারে ২৩ হাজার ৫৩০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ২৪ হাজার ১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের ৬ হাজার ২৯১ জন গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের ১৩ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং ৩ জন মারা গেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন