শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়ি ঢাকার রাজপথে

প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : ফিটনেস নাই তবুও রাজপথে আছে। চলার যোগ্য নয় তারপরেও চলছে। রাজধানীতে চলাচলরত এরকম লক্কর-ঝক্কর মার্কা যানবাহনের প্রকৃত সংখ্যা কতো তার সঠিক হিসাব বিআরটিএ-তে নাই। তবে গত বছর আগস্ট মাসে অভিযান শুরুর পর ফিটনেস করানো এবং অভিযানে আটক গাড়ির সংখ্যা হিসাব করলে এ সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি হবে। গত বছর হাইকোর্ট যখন ফিটনেসবিহীন মোটরযান চলাচল বন্ধের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন তখন রাজধানীতে এর সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। হাইকোর্টের নির্দেশের পর ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বিআরটিএ। মাসখানেক এই অভিযানে গতি থাকলেও পরবর্তীতে তা ঝিমিয়ে পড়ে। অভিযান শুরু হলে লক্কর-ঝক্কর মার্কা গাড়ি চলাচল আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। সে ধাক্কা সামলিয়ে এখন সেগুলো আবার রাজপথে। এসব গাড়িই রাজধানীর গলার কাঁটার মতো প্রতিনিয়ত ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি করে চলেছে। আইনের তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলাচলের অযোগ্য এসব গাড়ি দিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে এক শ্রেণীর পরিবহন মালিক। সেবা তো তো দুরের কথা যাত্রীরা সামান্যতম নিরাপদ নয় এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সাথে ভোগান্তিতো আছেই। এরকমের ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় চলাচলের কারণে শুধু দুর্ভোগই নয়, ক্ষতির মুখে পড়ছে ঢাকার পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে সৌন্দর্যও। ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশের সামনেই অবাধে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চললেও নেওয়া হচ্ছে না যথাযথ ব্যবস্থা। বিআরটিএ-এর সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী দাবি করেছেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত আছে। সাপ্তাহিক ছুৃটি বাদে প্রতিদিনই অভিযান চলছে। ফিটনেসবিহীন ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ধরা হচ্ছে। জরিমানা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে গণ পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. শামসুল হক বলেন, সারাদেশে পরিবহন সেক্টরে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। রাজধানীর অবস্থা আরও খারাপ। ঢাকায় চলাচলরত লক্কর ঝক্কর মার্কা গাড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকার যানজটের প্রধান উৎস এ ধরণের সব গাড়িরই যে ফিটনেস নেই তা কিন্তু নয়। অভিযানে নামলে দেখা যাবে যে গাড়িকে আমরা আনফিট বলছি তারও ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে। তার অর্থ হলো, এগুলোকে না দেখেই ফিটনেস দেয়া হয়েছে। আবার কোনো কোনো গাড়ি ফিটনেস নেয়ার পর রাস্তায় চলতে গিয়ে ‘মল্লযুদ্ধ’ করে গায়ে আঁচড় লাগছে, হেড লাইটটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এটাকে সময়মতো আর মেরামত করা হচ্ছে না। এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পরিবহন সেক্টরের এই বিশৃঙ্খলা দুর করার জন্য বাস রুট ফ্রাঞ্চাইস (বিআরএফ) পদ্ধতির বিকল্প নেই। এই পদ্ধতিতে সীমিত সংখ্যক বাস কোম্পানীর তত্বাবধানে সীমিত সংখ্যক বাস রুট চালু করলে যাত্রী সেবার মানও বাড়বে, বিশৃঙ্খলাও দুর হবে।
বিআরটিএ’র সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী জানান, বর্তমানে সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২৪ লাখ ৮১ হাজার। এর মধ্যে মোটর সাইকেল ১৩ লাখ ৯২ হাজার। মোটর সাইকেল বাদ দিলে মোট যানবাহনের সংখ্যা ১০ লাখ ৮৯ হাজার। জানা গেছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় দেড় লাখ ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলরত ছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও মিডিয়াতে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর দেশের সব ধরনের সড়কে ফিটনেসবিহীন মোটরযান চলাচল বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। গত বছরের ৩ আগস্ট বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত দেশের প্রায় ১৯ লাখ গাড়িচালকের ‘ভুয়া’ লাইসেন্স জব্দ ও তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের এই আদেশের পর নড়েচড়ে বসে বিআরটিএ ও পুলিশ প্রশাসন। শুরু হয় অভিযান। ভূয়া লাইসেন্সও জব্দ করা হয়। এসময় লক্কর-ঝক্কর মার্কা বহু গাড়ি রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়। অভিযানে আটক হয় খুবই সামান্য। বিআরটিএ এর কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন ওই অভিযানের পর গাড়ির ফিটনেস করানোর প্রবণতা অনেকাংশে বেড়ে যায়। মাস দুয়েক এই প্রবণতা অব্যাহত ছিল।
আগস্টের পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ফিটনেস করানো যানবাহনের সংখ্যা ৫০ হাজারের কিছু বেশি হতে পারে বলে বিআরটিএ এর একজন কর্মকর্তা জানান। তবে সচিব মোহাম্মদ শওকত বলেন, এর সঠিক হিসাব দেয়া কঠিন। কারন একেক গাড়ির ফিটনেসের তারিখ একেক দিন। একটা গাড়ি এক বছরের জন্য ফিটনেস করে। বিগত ৫ মাসের হিসাবে তা স্পষ্ট হবে না।
বিআরটিএ-এর হিসাবে যাই থাক বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। রাজধানীর যে কোনো রুটে লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাস বা মিনিবাস চোখে পড়বে। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচলকারী ‘৮ নম্বর’ বাসের অবস্থা সবারই জানা। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মৌচাক মোড়ে যানজটে আটকে থাকা এরকম একাধিক বাস দেখা গেছে। এসব বাসের কোনটির গ্লাস ভাঙা, কোনোটির লুকিংগ্লাস নেই, কোনোটির সামনে ও পেছনের বাম্পার খোলা, কোনোটির জানালার কাঁচ অর্ধভাঙ্গা হয়ে ঝুলে আছে, কোনোটির বডি দুমড়ানো-মুচড়ানো। সদরঘাট টু গাজীপুর রুটের ‘সুপ্রভাত পরিবহনের’ একাধিক বাসের এরক অবস্থা দেখা গেছে। যাত্রীঠাসা কোনো কোনো বাসের পেছনের সীটে বসা যাত্রীদের পা বাইরে থেকে দেখা যায়।
যাত্রাবাড়ী থেকে গাজীপুর রুটেরও একই অবস্থা। ডাইরেক্ট বা বিরতিহীন লেখা অনেক বাসের ভিতরে সীট আলগা। বডি ভেঙ্গে বাঁকা হয়ে আছে। সামনে পেছনে বাম্পার নেই। পরিবহন মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর বিআরটিএ’র অভিযান যখন জোরদার ছিল তখন এসব গাড়ি ঢাকার আশপাশে পাঠানো হয়। অভিযান গতি হারানোর পর এগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে প্রবেশ করে। এজন্য ট্রাফিক পুলিশের সাথে মালিকপক্ষের ‘অলিখিত চুক্তি’র কথাও বলেছেন কেউ কেউ। তবে ট্রাফিক পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
শুধু যাত্রাবাড়ী-গাজীপুর রুটের বাস নয়, রাজধানীর প্রায় সব রুটের বেশিরভাগ কোম্পানির বাসের অবস্থা একই রকম। উত্তরা টু আজিমপুর রুটের ‘ফাল্গুন’ পরিবহন, আব্দুল্লাপুর টু যাত্রাবাড়ী রুটের ‘সালসাবিল’-‘অনাবিল’-‘তুরাগ’ পরিবহন, গাবতলী টু যাত্রাবাড়ী এবং গাবতলী টু সদরঘাট রুটের অধিকাংশ কোম্পানির বেশিরভাগ গাড়িই লক্কর-ঝক্কর মার্কা। এতে ভোগান্তি, শঙ্কা আর বিড়ম্বনা নিয়েই পথ চলতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাস্তায় চলাচল করার যোগ্য প্রমাণের পর বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়ার নিয়ম। গাড়িতে রক্ষিত কাগজপত্র, গাড়ির ধোঁয়া নির্গমণ ও কাঠামোগত (বডি কনফিগারেশন) অবস্থার ভিত্তিতে রাস্তায় চলাচল করা গাড়ির ফিটনেস নির্ধারণ করা হয়। যে সমস্ত গাড়ি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফি জমা দিয়ে বিআরটিএ’র কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেয়নি সেগুলোকেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি বা ফিটনেস খেলাপি গাড়ি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব নিয়ম কমই মানা হয়। গাড়ি না দেখেই ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয় বিআরটিএ’র এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। এমন অভিযোগ বহুদিনের পুরনো। তবে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা অনেকটাই পাল্টে যেতে বাধ্য হন। ঘুষ বন্ধ হয়ে যায় মিরপুর ও কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া বিআরটিএ অফিসে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সে অবস্থা আবার পাল্টে যেতে শুরু করেছে। মিরপুর বিআরটিএ অফিসে ফিটনেস করাতে এখন আবার তিন থেকে চার হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয় বলে জানান কয়েকজন মালিক। এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ’র সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী বলেন, কারও বিরুদ্ধে এরকম সুনির্দ্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, কেউ যদি দালালের মারফত ফিটনেস করাতে গিয়ে দালালকে ঘুষ দেয় তার দায়দায়িত্ব বিআরটিএ নেবে না। কিন্তু দালালের সাথে কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ পাওয়া গেলে তাকে কোনোভাবে ছাড় দেয়া হবে না বলে সচিব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন