নতুন বছর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে সমুদ্র বন্দরের অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন হতে যাচ্ছে। যার সূচনা হয় বিদায়ী ২০১৮ সালে। উন্নয়ন কাঠামোর অন্যতম দিক হচ্ছে বহুল আলোচিত বে-টার্মিনাল। এটি নির্মিত হবে গভীর সমুদ্র বন্দরের আদলে নতুন এক আধুনিক বন্দর। সক্ষমতা ও আকার-আয়তনে বেড়ে যাবে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম। এরফলে পোর্ট-শিপিং সার্কেল ও বৈদেশিক বাণিজ্যে আশার আলো ফুটে উঠেছে। বে-টার্মিনালকে বলা হচ্ছে ‘আজ এবং আগামীর বন্দর’।
বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন কাজে অগ্রগতি হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল জুলফিকার আজিজ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, প্রকল্পস্থলে ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা কেটে গেছে। বন্দরের অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ক্ষতিপূরণে ব্যয় মেটানো হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, বে-টার্মিনাল জাতীয় অর্থনীতিতে যুগান্তকারী উন্নতি বয়ে আনবে। বে-টার্মিনাল বন্দরের দক্ষতা, সক্ষমতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। সেখানে দ্বিগুণ সাইজের এবং দ্বিগুণ সংখ্যক জাহাজবহর ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে বিশেষ করে পণ্যসামগ্রী রফতানির ক্ষেত্রে বর্তমানে জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম (গড় অবস্থানকালের সূচক) ২ দশমিক ৬ দিনের স্থলে মাত্র ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় নেমে আসবে। এরফলে বন্দর-ব্যয় এবং সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার খরচ (কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস) অনেকাংশে হ্রাস পাবে। রফতানি সহজতর হয়ে উঠবে, পণ্য রফতানির খরচও আগের তুলনায় কমে যাবে। যার সুফল ভোগ করবে সমগ্র জাতি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিশেষজ্ঞগণ জানান, বিদ্যমান চট্টগ্রাম বন্দরের স¤প্রসারণের মাধ্যমেই গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন আরেক বন্দর বে-টার্মিনাল। পতেঙ্গা ও হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগে বিস্তীর্ণ ভূমি এবং সাগরঘেঁষে নির্মিত হচ্ছে বে-টার্মিনাল। এটি সমুদ্রবন্দর অবকাঠামো তৈরির জন্য উপযোগী বলেই ইতোমধ্যে সম্পন্ন হওয়া কারিগরি সমীক্ষা প্রতিবেদন ও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বড়সড় আকৃতির জাহাজ ভিড়ানো, ঘোরানোর জন্য পর্যাপ্ত ড্রাফট (জাহাজের নিচের অংশের গভীরতা), মালামাল লোডিং-আন লোডিং করা এবং বেশিসংখ্যক জাহাজ নোঙর সুবিধার সমন্বয় থাকবে। বে-টার্মিনাল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। বন্দরের তহবিল থেকে অর্থায়ন ছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগের কয়েকটি প্রস্তাব এসেছে।
বে-টার্মিনাল নির্মাণে বড় বাধা ছিল ভূমি অধিগ্রহণ। সেই জট খুলেছে। ভূমি বন্দোবস্তির জটিলতা পরিহার করে মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিস্তীর্ণ ভূমি কিনে নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকা ভূমির মালিকদের হাতে তুলে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের প্রতিবছর মুনাফালব্ধ নিজস্ব তহবিল থেকেই ভূমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরণে অর্থায়ন করা হচ্ছে। ‘আজ এবং আগামীর বন্দর’, ‘খোলা সমুদ্রবন্দর (ওপেন সী-পোর্ট)’ হিসেবে বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে হাজার বছরের চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। এটি হবে বন্দরের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অবকাঠামো। দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের চাহিদা ও চাপ সামাল দিতে সক্ষম হবে বে-টার্মিনাল। একে ঘিরে বন্দর ব্যবহারকারী, আন্তর্জাতিক শিপিং মহলে আগ্রহ ও আশাবাদ তৈরি হয়েছে।
বন্দর সূত্র জানায়, বিদ্যমান বন্দরের সঙ্গে প্রায় লাগোয়া পতেঙ্গা-হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগে বে-টার্মিনাল স্থাপনে ৯০৭ একর ভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। ভূমির অধিগ্রহণ এগিয়ে চলেছে। ভূমি বন্দোবস্তি নেয়ার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ শুরুতে উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মামলা-মোকদ্দমা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে হোঁচট খেতে হয়। ইতোমধ্যে অধিগ্রহণের মাধ্যমে ভূমি ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি মালিকানার ৬৮ একর ভূমি বন্দরের আয়ত্তে এসেছে। ভূমির ক্ষতিপূরণ মূল্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। আরও ৮শ’ ৩৯ একর সরকারি মালিকানার ভূমির দাম মিটিয়ে অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এরজন্য বন্দরের ব্যয় হবে প্রায় ১৫শ’ কোটি টাকা। শিগগিরই ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করে ইয়ার্ড এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বে-টার্মিনালের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘শেলহর্ন এইচপিসি কেএস জেবি’ গত ২০১৭ সালে কারিগরি সমীক্ষা প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে। এতে বলা হয় বিদ্যমান বন্দর সংলগ্ন পতেঙ্গা-হালিশহর উপকূলভাগ বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত কারণে বেশ উপযোগী। সেখানে জাহাজ ভিড়তে হলে জোয়ার-ভাটার সময়সূচির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে না। সাগরের মোহনায় গত প্রায় তিন দশকে জেগে ওঠা টেকসই চরের ৯০৭ একর ভূমি নিয়ে নির্মিত হবে বে-টার্মিনাল। যার দৈর্ঘ্য হবে ৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ৬শ’ মিটার। তীরভূমির ৮শ’ মিটার ব্যবধানে সাগর মোহনায় একটি নেভিগেশনাল চ্যানেল সৃষ্টি হয়েছে। এর গভীরতা ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত।
সেখানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে বড় আকারের জাহাজ ভিড়ানো ও ঘোরানোর সুযোগ তথা অবকাঠামো প্রসারিত করা সম্ভব। জোয়ার কিংবা ভাটার সময়ে ১২ মিটার ড্রাফট সম্পন্ন (পানির ভেতরে থাকা জাহাজের অংশ) জাহাজবহর সেখানে ভিড়তে পারবে। বে-টার্মিনালে ভিড়তে সক্ষম হবে ৫ হাজার কন্টেইনার ভর্তি জাহাজ। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলের সীমাবদ্ধতার কারণে জেটি-বার্থে ভিড়তে পারছে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের, ১৯০ মিটার দীর্ঘ এবং প্রায় দুই হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ। বে-টার্মিনালে একই সঙ্গে ভিড়তে পারবে ৩৫টি জাহাজ।
বন্দর কার্যক্রম পরিচালিত হবে (অপারেশনাল এরিয়া) বর্তমান বন্দরের তুলনায় তিনগুন বড় আয়তনে। যা ধাপে ধাপে ছয় গুণে উন্নীত করা সম্ভব হবে। এরজন্য সমুদ্র উপকূলভাগে নতুন ভূমি ধারণ ও চর সৃজন করা সম্ভব হবে। এরফলে বে-টার্মিনাল আগামী ৫০ থেকে একশ’ বছর বন্দর কার্যক্রমের চাপ বা চাহিদা পূরণে সমর্থ হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতি বছর ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ হারে আমদানি-রফতানিমুখী কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ২৮ লাখ টিইইউএস অতিক্রম করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন