বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

তাইওয়ানকে একীকরণে চীনের ধৈর্য ফুরিয়ে এসেছে

দি নিউইয়র্ক টাইমস | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের ধৈর্য্য অবশেষে ফুরিয়ে এসেছে। চীন এখন তাইওয়ানকে মূল ভ‚খন্ডের সাথে একীভ‚ত করার চ‚ড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তারই প্রকাশ ঘটেছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর কথায়। বুধবার তিনি বলেছেন, তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ লাভের দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় তিনি অগ্রগতি দেখতে চান। তবে তার এ ইচ্ছা চীনের মূল ভ‚খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন স্বশাসিত দ্বীপটির জনগণের মন জয় করেছে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, তাদের সামনে রয়েছে হংকং-এর পরিণতির কথা।
বিতর্কিত তাইওয়ান বিষয়ে তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যে শি প্রকাশ করেছেন যে চীনের জাতীয় পুনরুজ্জীবনের যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন তাতে তাইওয়ানের সাথে চীনের একীকরণের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি সক্রিয় গণতান্ত্রিক তাইওয়ানকে একটি ঐতিহাসিক ভুল, এমন একটি ভ‚খন্ড হিসেবে দেখে যা কখনোই চীনের নিকট থেকে স্বায়ত্তশাসন পায়নি। এবং একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী হিসেবে প্রেসিডেন্ট শি তাইওয়ানের পৃথক মর্যাদাকে বিশেষ পীড়াদায়ক হিসেবে দেখেন।
তাইওয়ানকে অধিভুক্ত করার জন্য শি কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করেন নি, কিন্তু বেইজিংয়ের মনোভাব যথেষ্ট কঠোর। প্রেসিডেন্ট শি তার প্রেসিডেন্ট মেয়াদের সপ্তম বছরের কাছাকাছি এসে আভাস দিয়েছেন যে তার ধৈর্য্যরে সীমা আছে। তিনি তাইওয়ানকে তাইওয়ানকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে চীনা কক্ষপথের আরো কাছে আনতে চান।
গ্রেট হল অব পিপলে দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতায় শি বলেন, প্রণালির দু পারে দুপক্ষ এখনো পূর্ণভাবে একীভ‚ত হয়নি যা ইতিহাসে চীনা জাতির জন্য ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যেকার রাজনৈতিক বিভক্তি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্থায়ী হতে পারে না।
তবে কথার মধ্যে জরুরি ভাব দেখালেও এক চীন নীতির আওতায় তাইওয়ানকে আনার তার মনোবাঞ্ছা তাইওয়ানের বেশিরভাগ মানুষের মনে সাড়া জাগাতে পারেনি যদিও তাইওয়ানের স্বাধীনতার পক্ষের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন নভেম্বরের নির্বাচনে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি বেইজিংয়ের ভীষণ অপছন্দের পাত্রী ছিলেন।
একদিকে প্রেসিডেন্ট শি হুমকি দিয়েছেন যে তাইওয়ানের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তিনি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবেন। অন্যদিকে তিনি বলেছেন, তাইওয়ান যদি চীনের সাথে একীভ‚ত হতে সম্মত হয় তাহলে তিনি এক দেশ দু ব্যবস্থা কাঠামো নিশ্চিত করবেন যা বেইজিং হংকংএর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্ক গবেষণাকারী হংকং-এর ব্যাপ্টিস্ট বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর জাঁ-পিয়েরে ক্যাবেস্টান বলেন, কিন্তু হুমকি বা প্রতিশ্রæত পুরস্কার কোনোটিই চীনের দাবির বিরোধিতা করা থেকে তাইওয়ানিদের দুর্বল করতে পারেনি।
তিনি বলেন, শি জিনিপিংয়ের ইচ্ছা তিনি একটি বড় লাঠি ব্যবহার করবেন ও গাজরকে আরো মিষ্টি করবেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন কর্তৃক হংকং-এর স্বায়ত্তশাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার ঘটনা দেখে বহু তাইওয়ানিই শি জিনপিংয়ের মনোভাবের ব্যাপারে সন্দেহপরায়ণ হয়ে উঠেছে।
১৯৯৭ সালে চীনের আওতায় আসার পর এক দেশ দু ব্যবস্থা কাঠামোর আওতায় হংকং আইনগত ভাবে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে এবং এ নগরীর অধিবাসীরা চীনের বাকি যে কোনো জায়গার চেয়ে ব্যাপকতর স্বাধীনতা ভোগ করে। কিন্তু সম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রকাশনা, সংবাদ মাধ্যম ও গণতন্ত্রপন্থী কর্মকান্ড থেকে হংকং সরে গেছে যার মধ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
তাইওয়ানের রাজনীতি নিয়ে গবেষণাকারী ব্রিটেনের নটিংহ্যাম বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক জনাথান সুলিভান বলেন, তাইওয়ানের ভোটদাতাদের কোনো অংশই কার্যত এক দেশ দু ব্যবস্থাকে আকর্ষণীয় হিসেবে দেখে না। তাইওয়ান হংকং-এর মত কোনো কলোনি নয়। চীনা প্রস্তাবে রাজি হলে তার হারানোর সব কিছুই আছে, পাওয়ার কিছুই নেই।
সুলিভান বলেন, শি তাইওয়ানকে একীভ‚ত করার কাজ করছেন, এটা প্রদর্শনের মধ্যে তার রাজনৈতিক মতলব আছে। জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা অনুযায়ী একীকরণ চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির জন্য প্রয়োজনীয়। পার্টির অস্তিত্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জাতীয়তাবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রথমটি যেহেতু অনেক কঠিন সেহেতু দ্বিতীয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে শি’র বক্তব্য তাইওয়ান নিয়ে বিরোধে জ¦ালানি যোগাবে। এর সাথে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই-এর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।
চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে বিরোধের শুরু ১৯৪৯ সালে। মাও জে দং-এর বিপ্লবী সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে জেনারেল চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন কুওমিন্টাং বাহিনী এ দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। তারপর থেকে কোনো কোনো সময় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বাধার উপক্রম হয়েছে। বেইজিং-এর ভয় যে তাইওয়ান পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারে।
ওয়াশিংটনে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ -এর চায়না পাওয়া প্রজেক্টের পরিচালক বর্নি এস. গেøসার বলেন, সাই ও শি উভয়েই তাদের অবস্থান আঁকড়ে আছেন। শি’র এ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের পর চীন-তাইওয়ান সম্পর্কে কোনো উন্নয়ন ঘটার কম কারণই আছে। সে সাথে সংকট সৃষ্টিরও কারণও কমই।
শি’র এ বক্তব্য এসেছে রিপাবলিক অব তাইওয়ানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিবর্তন ও চীনের কম্যুনিস্ট সরকারের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৪০তম বার্ষিকীতে।
সোমবার এক বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট সাই বলেন, তাইওয়ানের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ তাদের স্ব-শাসন অব্যাহত রাখতে চায়। তিনি সাম্প্রতিক নির্বাচনে তার দল ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির পরাজয়কে এ নীতির প্রতি জনগণের প্রত্যাখ্যান ভাবা ভুল বলে তিনি সতর্ক করে দেন। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী কুওমিন্টাং পার্টি ত্ওায়ানের সবচেয়ে জনবহুল ৩টি নগরীর মেয়র পদ হস্তগত করে।
মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট সাই এক দেশ দু ব্যবস্থার ভিত্তিতে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
প্রেসিডেন্ট শি’র বক্তব্যের জবাবে তিনি তাইপেতে সাংবাদিকদের বলেন, আমি আবারো বলছি তাইওয়ান কখনোই এক দেশ দু ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। তাইওয়ানি জনগণের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জীবনধারা কাক্সিক্ষত।
তাইওয়ানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও প্রেসিডেন্ট শি’র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এক ইমেইলে মন্ত্রণালয় বলে যে চীন সরকার ইতিমধ্যেই হংকংকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করেছে যা এক দেশ দু ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত।
প্রেসিডেন্ট শি সাধারণ ভাবে তাইওয়ানিদের চীনের সাথে একীভ‚তকরেেণর পক্ষে বলে আখ্যায়িত করেন। তবে গত আগস্টে ন্যাশনাল চেংচি বিশ^বিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ তাইওয়ানি চীনের সাথে একীকরণের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ১২.৫ শতাংশ বর্তমান স্থিতাবস্থা ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পুনরেকীকরণ চান বলে জানান।
শি তার বক্তৃতায় ইঙ্গিত দেন যে চীনের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে তিনি প্রলম্বিত রাজনৈতিক খেলা চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, প্রণালির দু পারের দেশপ্রেমিকরা একই পরিবার। এক চীন নীতি গ্রহণ করলে তাইওয়ানের কোনো রাজনৈতিক দল বা গ্রæপের আর আমাদের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় আর কোনো বাধা থাকবে না।
শি বলেন, চীন সরকার তাইওয়ানের রাজনীতিক ও প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করতে আগ্রহী যতক্ষণ না তারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করে ও বেইজিংয়ের এক চীন ফরমুলা মেনে নেয়। তিনি চীনের বিশাল ও বিকাশমান অর্থনীতিতে তাইওয়ানের প্রবেশের কথা বলেন। তাইওয়ানের বাণিজ্যের ৩০ শতাংশই চলে চীনের সাথে। প্রতিশ্রæত সম্পর্ক তাইওয়ানের কিছু শহরকে দ্রুত প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত করবে।
তাইওয়ানের কুওমিন্টাং দলের এক আইন প্রণেতা জেসন সু বলেন, তাইওয়ানি ভোটাররা চীনা প্রস্তাবে সরাসরি প্রভাবিত হবেন বলে মনে হয় না, তবে তারা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আগ্রহী।
তিনি বলেন, অধিকাংশ তাইওয়ানি ভোটাররা রয়েছে মাঝখানে। তারা সমৃদ্ধি ও আন্তঃপ্রণালি সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশী আগ্রহী।
বিশ্লেষকরা শি’র প্রস্তাব এবং চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি চীন, হংকং ও ক্রমবর্ধমান ভাবে বিদেশে সম্ভাব্য সরকার বিরোধীদের বিভক্ত, বশীভ‚ত ও দলে টানার জন্য যে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নীতি গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে সাদৃশ্য দেখছেন।
প্রফেসর ক্যাবেস্টান বলেন, বক্তব্যের পিছনে রয়েছে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য যার লক্ষ্য যুক্তফ্রন্টের কাজ জোরদার , যোগাযোগ বহুমুখী করা ও চীনের মূল ভ‚খন্ডে নির্ভরতার বন্ধন তৈরি করা। যে হংকং-এ বাস করে তার জন্য এখানে যেসব ঘটছে তার বিপুল প্রতিধ্বনি তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, তাইওয়ানের বিভক্ত ভোটার, অর্থনীতি ও রাজনীতি চীনের ‘ডিভাইড অ্যান্ড কন্ট্রোল’ কৌশলকে এখানে সফল করে তোলা অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট সাই বলেন, তাইওয়ানের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য স্থানীয় রাজনীতিক ও গ্রæপগুলোকে পক্ষে টানার চীনের যে কোনো চেষ্টার তিনি বিরোধিতা করবেন।
তিনি প্রেসিডেন্ট শি’র বক্তব্যের জবাবে বলেন, বিভক্তি সৃষ্টি ও প্রলোভন প্রদর্শনের মাধ্যমে তাইওয়ানের জনগণের নির্বাচনে নাক গলানোর কোনো চেষ্ট বরদাস্ত করা হবে না। তিনি বলেন, কোনো আলোচনা করলে তা সরকার বা সরকার অনুমোদিত কোনো সরকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন