বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ঢাকার ফুটপাতে

প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : সন্ধ্যা হলেই রাজধানীর ফুটপাতে জ্বলে ওঠে কয়েক লাখ বৈদ্যুতিক বাল্ব। স্থানীয় প্রভাবশালী ও একশ্রেণির দালাল এসব বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ দিয়ে চুটিয়ে অবৈধ ব্যবসা করছে। পকেট ভরছে ডিপিডিসির একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রভাবশালী ও মাস্তানদের। সূত্রমতে, শুধু ঢাকা শহরেই ডিপিডিসির (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ অবৈধ বিদ্যুতের অধিকাংশই ব্যবহার করা হচ্ছে রাতের বেলায় ঢাকার ফুটপাতে। ঢাকার কয়েক লাখ হকার ফুটপাতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তার পুরোটাই অবৈধ সংযোগ বলে বিবেচিত। ফুটপাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য মিটারের ব্যবস্থা নেই। তাই কতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে তার কোনো হিসাবও নেই। যদিও ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) রমিজ উদ্দিন সরকার দাবি করেছেন, ঢাকার ফুটপাতে এখন আর কোনো অবৈধ সংযোগ নেই। গতরাতে দৈনিক ইনকিলাবকে তিনি বলেন, ঢাকার প্রতিটি এলাকার ফুটপাতে আলাদা আলাদা মিটার বসানো হয়েছে। ডিপিডিসির লাইনম্যান, ইঞ্জিনিয়ার এবং টাস্কফোর্স প্রতিনিয়ত এসব এলাকা মনিটরিং করছে।
জানা গেছে, ১ হাজার ৫২৯ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফুটপাত। এসব ফুটপাতে সন্ধ্যা হলে লাখ লাখ বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলে ওঠে। চলে রাত ১১টা পর্যন্ত।  অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফুটপাতের বেশিরভাগ সংযোগই অবৈধ। তবে  কিছু কিছু বৈধ সংযোগও রয়েছে। অবৈধ সংযোগের জন্য ঢাকার কয়েকটি এলাকায় দালাল নিয়োগ করা আছে। তারাই নিজ নিজ এলাকার ফুটপাতের বৈদ্যুতিক সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এজন্য তাদেরকে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিতে হয়। যেমন, একটি ২০ ওয়াটের এনার্জি সেভিং বাল্ব রাতে পাঁচ ঘণ্টা জ্বললে মাসে দুইশ টাকার বেশি বিল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ফুটপাতে জ্বালানোর জন্য প্রতিদিন দিতে হয় বাল্বপ্রতি ৩০ টাকা। অর্থাৎ মাসে ৯শ টাকা। এই বাড়তি টাকা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দালাল, প্রভাবশালী, বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় মাস্তানদের পকেটে। রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান ও জুরাইন এলাকার ফুটপাতের হকারদের সাথে কথা বললে কয়েকজন হকার জানান, মিটার আছে কি নাই তা তাদের জানা নাই। বাল্বপ্রতি ৩০ টাকা করে তারা প্রতিদিন বিল দেন। রাস্তার হকাররা একটি এবং ফুটপাতের হকাররা তিনটি থেকে পাঁচটি লাইটও ব্যবহার করে। দালালকে সেই হিসাবেই টাকা দিতে হয়।  
রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর, সোনালী ব্যাংকের পেছনে, আলিকো ভবন থেকে মধুমিতা সিনেমা হল, দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ফকিরেরপুল, বিমান অফিসের আশেপাশে, রাজউক ভবনের সামনে, সড়ক ভবনের সামনে ও স্টেডিয়ামের গেটের দু’দিকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক হাজার দোকান বসে। এসব দোকানে সন্ধ্যা হলেই হাজার হাজার বাল্ব জ্বলে। দোকানগুলোর আশপাশের মেইন লাইন থেকে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া। কয়েকজন হকার জানান, মতিঝিল এলাকার বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের দায়িত্বে আছে একসময়কার তিন তাসের ওস্তাদ জলিলের ছেলে নুরু। হকাররা জানান, ঢাকার গুলিস্তানসহ বিভিন্ন ব্যস্ততম এলাকায় একসময় তিন তাস খেলার নামে মজমা জমিয়ে পাবলিককে বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতো জলিল ও তার সিন্ডকেট। সে কারণে জলিলকে প্রতারণামূলক তিন তাস খেলার ওস্তাদ বলা হয়। এই এলাকার বিদ্যুত সংযোগের দালাল নুরু হলো সেই জলিলের পুত্র। প্রায় তিন হাজার সংযোগের মালিক নুরুর মাসিক আয় কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা। এই অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে সে এখন কোটিপতি। তার পক্ষ হয়ে কাজ করে মতিঝিল এলাকার কয়েকজন লাইনম্যান। তারাই নামমাত্র কয়েকটি মিটার দেখিয়ে সেখানে মাস শেষে কয়েক হাজার টাকা বিল জমা দেয়। বাকী টাকা যায় নুরুসহ দুর্নীতিবাজদের পকেটে। প্রভাব অব্যাহত রাখার জন্য নুরুর পক্ষে কয়েকজন স্থানীয় মাস্তানও আছে।
গুলিস্তান এলাকার ফুটপাতের বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করে মোঃ হানিফ ওরফে খাজা। গুলিস্তান এলাকায় ডিসিসির তালিকাভুক্ত হকার আছে ২৫০২ জন। এর বাইরে রাস্তায় বসে আরও কমপক্ষে আড়াই হাজার হকার। এসব হকারদের দোকানে যে সব বাল্ব জ্বালানো হয় সবই খাজার দেয়া বলে জানান একাধিক হকার। প্রতিটি বাল্ব ৩০ টাকা করে প্রতিদিন হানিফ খাজার লোক এসে টাকা নিয়ে যায়। এভাবে হানিফ খাজা প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ মহাজার টাকা বিল তোলে। মাস শেষে তার পকেটে যায় কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, এ খাত থেকে কোনো টাকা থানা পুলিশ পায় না। মোটা অঙ্কের টাকা পায় বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় লোকজন, স্থানীয় মাস্তান ও প্রভাবশালী দুজন রাজনৈতিক নেতা। হকাররা জানান, হানিফ খাজা প্রতি সপ্তাহে গুলিস্তান মাজারে একটা শিন্নির ব্যবস্থা করেন। সেখানেও কিছু টাকা খরচ হয়।
গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া অংশে বিদ্যুতের দায়িত্বে আছেন লতিফ নামে এক দালাল। সুন্দরবন স্কোয়ার থেকে শুরু করে কাপ্তানবাজার হয়ে বিসিবি রোড এমনকি বনগ্রাম পর্যন্ত বিদ্যুত সরবরাহ করে এই লতিফ। তার অধীনে কমপক্ষে দুই হাজার দোকান রয়েছে। একজন হকার বলেন, লতিফকে অনেক আগে থেকেই দেখে আসছি। শুধু চোরাই বিদ্যুতের কারবার করে এখন সে কোটিপতি। টাকার কোনো অভাব নেই তার।
পল্টনে বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশপাশের এলাকা জ্বলে ভুয়া মন্ত্রীর বিদ্যুৎ সংযোগে। এখানকান হকাররা বলেন, বিদ্যুতের মালিক যিনি তাকে আমরা সবাই মন্ত্রী নামেই চিনি। এক সময় কোনো এক মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে এখানকার অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ চালু হয় বলে দালালরূপী ওই ব্যক্তি নিজেকে মন্ত্রী নামেই জাহির করেছেন। এখনও তিনি ওই নামেই পরিচিত। হকাররা জানান, ভূয়া সেই মন্ত্রীর অধীনে কমপক্ষে তিন হাজার দোকান চলে। ফার্মগেই এলাকার বিশাল স্থান জুড়ে ফুটপাতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলেও সেখানে কোনো মিটারের অস্তিত্বের ককথা জানা নেই সেখানকার হকারদের। কয়েকজন হকার জানান, সন্ধ্যা হলে তারা বাতি জ্বালান। এজন্য যুবলীগ নেতা শাহ আলমের লোকজনকে বাল্ব হিসাবে টাকা দিতে হয়। এখানে দুই হাজারের মতো দোকান থেকে শাহ আলমের লোকজন প্রতিদিন অর্ধ লক্ষাধিক টাকা তুলছে প্রতিদিন। রাজধানীর জুরাইন এলাকায় হাবিব উল্যাহ মার্কেট, বুড়িগঙ্গা মার্কেট ও আলম মার্কেটের সামনে সড়ক ও জনপদের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল হকার্স মার্কেট। এর বাইরেও ফুটপাতে রয়েছে কয়েকশ’ দোকান। এ ছাড়া জুরাইন রেল লাইনের দুপাশে, বিক্রমপুর প্লাজার সামনে, জুরাইন টাওয়ারের দুই দিকে বসে বিশাল বাজার। এখানকার দুই সহ¯্রাধিক দোকানে বিদ্যুতের কোনো বৈধ সংযোগ নেই। অবৈধ সংযোগ নিয়ে দাকানদারদের কাছে থেকে ভাড়া তোলে খায়রুল ও মোশাররফ। এই টাকার ভাগ পায় স্থানীয় বিদ্যুত অফিসের প্রকৌশলী, মিটাররিডার ও স্থানীয় প্রভাবশালী দুজন নেতা। এখানকার হকাররা জানান, হকার্স মার্কেট কিছুদিন আগে সানজিদা গ্রুপের দখলে ছিল। তখনও খায়রুল ও  মোশাররফই অবৈধ সংযোগের কারবার করতো। এখনও তারাই আছে। পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকায় কয়েক হাজার দোকানের অবৈধ সংযোগের ব্যবসা করছেন সেখানকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর রহমান মিয়াজি। এখানকার হকাররা জানান, প্রায় তিন হাজার দোকান থেকে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালানোর জন্য টাকা তোলে কাউন্সিললের লোকজন। তাদেরকে টাকা না দিয়ে কেউ একটি বাল্বও জ্বালাতে পারে না। নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের অবৈধ বিদ্যুত সংযোগের ব্যবসার সাথে জড়িত স্থানীয় ছাত্রলীগের কয়েক নেতা। ঢাকা কলেজের চাত্রলীগের একটি গ্রুপও রয়েছে এদের সাথে। এমনিভাবে ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, শাহজাদপুর, বনশ্রী, সবুজবাগ, বাসাবো, কমলাপুর এলাকায় প্রভাবশালী ও দালালচক্র বিদ্যুতের অবৈধ ব্যবসা করে ফুটপাতের দোকানগুলোকে আলোকিত করে রেখেছে।
ডিপিডিসি সূত্র জানায়, অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে জরিমানার বিধান আছে। আবাসিক, বাণিজ্যিক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, স্ট্রিট লাইটের জন্য ৫শ’ টাকা, সেচ সংযোগ-৫ হাজার টাকা, শিল্প কারখানা (৪৫ কেভিএ পর্যন্ত)-৭ হাজার ৫শ’ টাকা, শিল্প কারখানা (৪৫ কেভিএ থেকে ৭৫ কেভিএ পর্যন্ত) শিল্প কারখানা (৭৫ কেভিএ-এর ঊর্ধ্বে) ১৫হাজার টাকা। কিন্তু ফুটপাতের ক্ষেত্রে এসব বিধান শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। জানতে চাইলে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) রমিজ উদ্দিন সরকার বলেন, আগের মতো অবৈধ সংযোগ এখন আর নেই। টাস্কফোর্স রাতদিন কাজ করছে। এখন দিনের পর দিন অবৈধ সংযোগ চালানো সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন