বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

খরায় পুড়ছে উত্তরাঞ্চল

প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ শামীম শিরাজী : একটানা খরা, গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ, পানির স্তর আরো নিচে নেমে যাওয়া, এ জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকায় ডিজেল সঙ্কট, হাজার হাজার সেচযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়াসহ পামড়ি পোকার আক্রমণে কৃষকেরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতির ভয়াবহতা সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি মহলকে রীতিমতো উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। উত্তর জনপদের ১৬টি জেলা খরার ব্যাপকতায় ফসলি ক্ষেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। চলনবিল অঞ্চলে প্রায় ৮-১০ ফুট গর্ত খুঁড়ে শ্যালোমেশিন বসিয়ে পানি পাওয়াও দায় হয়ে পড়েছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ, দীর্ঘ অনাবৃষ্টি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ে রূপ নিয়েছে। খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে গেছে। ক্ষেতের ফসল পানি পাচ্ছে না, পাটের জমি তৈরি করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি পাবার একমাত্র মাধ্যম টিউবওয়েল নষ্ট ও পানি না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। সেচনির্ভর ইরি-বোরো ফসল মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ জনপদের বৃহত্তর নৌবন্দরে শ্রমিক ও মালিকদের কর্মবিরতি, ধর্মঘটের কারণে বাঘাবাড়ী পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সেলস ডিপো থেকে ডিজেল ও কেরোসিন সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। চরের কারণে অনেক তেলবাহী কার্গো জাহাজ কূলে ভিড়তে পারছে না। সবকিছু মিলিয়ে টানা খরায় উত্তরাঞ্চলে মরু প্রক্রিয়ার অশনি সঙ্কেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দেশের শস্যভা-ার নামে খ্যাত উত্তর জনপদের ১৬টি জেলায় প্রায় তিন সহস্রাধিক গভীর নলকূপ অকেজোসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে লাখ লাখ একর জমির ফসলহানির তীব্র আশঙ্কা বিরাজ করছে। অপর দিকে প্রচ- খরতাপ, ধূলিঝড় ও লু-হাওয়ার জন্য এ অঞ্চলে মরু প্রক্রিয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এসব এলাকার পানির স্তর ক্রমে নাগালের বাইরে চলে গেছে। অধিকাংশ গভীর নলকূপ এবং হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে ১৬ জেলায় ইরি-বোরো, পাট, শস্য পুড়ছে।
পানির অভাবে সেচ সঙ্কট প্রখর থেকে প্রখতর হচ্ছে। নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক হ্রাস পেয়ে বিশাল-বিশাল চর জেগে ওঠায় নদীবক্ষে এখন ঘোড়াগাড়ি, ভ্যানগাড়ি ও সাইকেল চলচল করছে। দুরন্ত ছেলেরা ধু-ধু বালুচরে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলছে। যমুনা নদী মানুষ এখন হেঁটেই পার হচ্ছে। নৌযানের প্রয়োজন পড়ছে না। খাল-বিলে বিন্দুমাত্র পানি নেই। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষকেরা এখন হা-হুতাশ করছেন। দু’চোখে তারা সরষের ফুল দেখছেন। প্রচ- খরায় সেচ কমে যাওয়ায় মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
তথ্য সূত্রের প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় ৩ হাজার ৫৯৭টি গভীর নলকূপ বিকল হয়ে পড়ায় চলতি মৌসুমে প্রায় ৩ লাখ একর জমিতে ইরি-বোরো জমিতে সেচ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রাজশাহী বরেন্দ্র এলাকায় ১৯০টি গভীর নলকূপ বিকল থাকায় ১৫ হাজার ৪৯০ একর জমির বোরো ধান, নওগাঁ বরেন্দ্র এলাকায় ১৫০টি গভীর নলকূপ বিকল থাকায় ১৫ হাজার একর বোরো ধানের জমিতে সেচ সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
অনুরূপভাবে বৃহত্তর সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলের ২১২টি, বগুড়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ২৮৭টি, জয়পুরহাটে ১৫০টি, দিনাজপুরে ১৯০টি, নাটোরে ৭৫টি, নীলফামারীতে ৭১টি, লালমনিরহাটে ৫৫টি, পঞ্চগড়ে ৫০টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪৫টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৫টি গভীর নলকূপ বিকল হয়ে পড়ায় বগুড়ায় ২৫ হাজার ৯৯০ একর, সিরাজগঞ্জ ৫০ হাজার একর, রংপুরে ১৫ হাজার ৮৫ একর, গাইবান্ধায় ১৫ হাজার ৪৭০ একর, দিনাজপুরে ১৫ হাজার ৯৬০ একর, জয়পুরহাটে ১২ হাজার ১০ একর, পাবনায় ১০ হাজার ৮৭৫ একর, নাটোরে ৬ হাজার ৭ একর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১ হাজার ৫০০ একর আবাদি জমির বোরো ধান সেচের অভাবে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া উত্তরাঞ্চলে গত মাসে দুই-দুইবার ডিজেল সঙ্কট দেখা দেয়ায় অবস্থা আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাঘাবাড়ী নদী বন্দরে চর জেগে ওঠায় তেলবাহী জাহাজ কূলে না ভেড়ায় তেল সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তেমনি মালিক-শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণে এ অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তর নৌবন্দর বাঘাবাড়ী পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সেলস ডিপো থেকে ডিজেল ও কেরোসিন সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। গত ২৭ এপ্রিল থেকে নৌ-মালিক সমিতির ১৫ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা ধর্মঘটের কারণে বন্দরে মাল নিয়ে আসা প্রায় শতাধিক পণ্যবাহী জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করা সম্ভব হয়নি। বাঘাবাড়ী বন্দর লেবার হ্যান্ডেলিং ঠিকাদার আব্দুস ছালাম বলেন, নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে সাতদিন জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে পারেনি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নৌযান মালিকদের ধর্মঘটের কারণে ১০ দিন জাহাজ থেকে সারসহ কোনো ধরনের পণ্য খালাস করতে না পারায় তাদেরকে প্রতিদিন তিন লাখ টাকা করে লোকসান গুণতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, এ ধর্মঘটের কারণে বন্দরে প্রায় ৮০০ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।
ফলে এ দুর্বলতাকে পুঁজি করে উত্তর জনপদের বিভিন্ন  জেলাগুলোতে পেট্রোল পাম্পে জ্বালানি তেল ডিজেল থাকা সত্ত্বেও কালোবাজারে অধিক মূল্যে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে অনেক প্রান্তিক কৃষক উচ্চমূল্যে তেল কিনতে না পারায় অনেক স্থানেই ইরি-বোরো সেচকার্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও প্রচ- খরার কারণে এ জনপদে মরু প্রক্রিয়ার পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গরম বাতাস আর লু-হাওয়া বইছে সর্বত্র। নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষকেরা মরিয়া হয়ে উচ্চমূল্যে ডিজেল কিনে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে কূল পাচ্ছেন না। মুহূর্তের মধ্যে মাটি পানি চুষে নিচ্ছে। গত মার্চ মাস থেকে শুরু করে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ জনপদের অধিকাংশ জেলায় বৃষ্টিপাত হয়নি। মে মাসেও বৃষ্টি-বাদলের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে।
এদিকে জেলায় জেলায় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে ইশতিসকার নামাজ পড়া হলেও বৃষ্টিপাতের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। গ্রাম-গঞ্জে দল বেঁধে আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে গীত গেয়ে পানি মাটিতে ফেলে কাদামাটিতে গড়াগড়ি করেও কোনো সুফল মিলছে না। এ ব্যাপারে ইসলামী চিন্তাবিদরা জানান, মানুষের মধ্যে কোনোরূপ আত্মশুদ্ধির কাজ নেই। মিথ্যার সাগরে ক্রমেই নিমজ্জিত হচ্ছে মুসলমান। পোশাকী মুসলমানের কথা আল্লাহপাক শোনেন না, এ জন্যই কবি নজরুল বলেছেন, দাড়ি-টুপি-জুব্বা দেখে ইয়া ইলাহী ভুলবে না। মানব মনের কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গদুয়ার  খুলবে না। মহান স্রষ্টার কাছে চাইতে হলে মুখ আর জিহ্বা পরিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ মিথ্যা পরিহার করতে হবে। তবেই মহান স্রষ্টা বান্দার কথা শুনবেন এবং রহমতের বৃষ্টি দান করবেন। এ জন্য মানুষের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা জাগ্রত করা উচিত। নইলে প্রকৃতি এর মধুর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।
























 








































 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন