আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনে দলের বিপুল বিজয়ের পর দলীয় নেতাকর্মীদের বিজয় মিছিল না করতে, বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকতে এবং বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন না চালাতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার এই সময়োপযোগী দিকনির্দেশনা বিভিন্ন মহলে উচ্চ প্রশংসা লাভ করলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন কমই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দলের এক শ্রেণীর উগ্রবাদী ও বেপরোয়া নেতাকর্মী তার নির্দেশনা থোড়াই কেয়ার করে ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতনের এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা তো বটেই, এমন কি সাধারণ মানুষও তাদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের ফলে গোটা দেশেই ভয়-আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। বিরোধীদলের নেতাকর্মী বিশেষত, বিএনপির নেতাকর্মীরা তাদের প্রধান টার্গেট। নির্বাচনের আগে বিরোধীদলের নেতাকর্মী, যারা ভয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে গিয়েছিল, এখনো বাড়ি ঘরে ফিরতে পারছেনা না বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যারা শত হুমকি-ধমকির পরও এলাকায় ছিল এবং নিজেদের দলের পক্ষে যৎসামান্য কাজ করেছে কিংবা ভোট দিয়েছে, তাদের বিপদের কোনো সীমা নেই। তাদের বেছে বেছে বের করে নানাভাবে ‘শায়েস্তা’ করা হচ্ছে। পত্রিকান্তরে ‘গ্রামটির একটাই দোষ, তাই বিচ্ছিন্ন’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। রাজশাহী-১ আসনের এই গ্রামটির নাম কলমা। গ্রামটির ভেতর দিয়ে বাস চলতো। নির্বাচনের পর আর চলছে না। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে গ্রামটির টিলিভিশন স্যাটেলাইট সংযোগ। গ্রামের অটোরিকশা চালকদের গ্রামের বাইরে যেতে বারন করে দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে গ্রামের বাইরের গাড়িগুলোও গ্রামের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারছে না। কার্যত গ্রামটিকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। গ্রামটির বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের একটাই দোষ আর সেটি হলো, গ্রামের ভোটকেন্দ্রে নৌকার চেয়ে ধানের শীষে বেশি ভোট পড়েছে। নৌকায় ভোট পড়েছে ৬৫৩টি আর ধানের শীষে ভোট পড়েছে ১২৪৯ টি। গ্রামবাসীরা জানিয়েছে, গভীর নলকূপগুলোও আওয়ামী লীগের লোকজন দখলে নিয়েছে। তাদের আশংকা, এবার হয়তো সেচের পানিও তারা পাবেনা।
ধানের শীষে ভোট দেয়ার ‘অপরাধে’ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে চার সন্তানের জননী এক গৃহবধূর কী ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে, দেশের মানুষ ইতোমধ্যেই তা অবগত হয়েছে। দেশটা কি তাহলে এমনই নৈরাজ্যের শিকার হয়ে গেল, যেখানে ক্ষমতাবানরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে? আরো একটি লোমহর্ষক নির্যাতনের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই খবরে জানা গেছে, ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ড উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে টেলিভিশন চুরির অভিযোগে এক যুবককে গাছের সঙ্গে পা ওপরে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের একজনসহ দু’জনকে এর মধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্বাচনের পর বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও সহিংসতার তাণ্ডব চালানের খবর প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের বাড়ি ঘরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা বাড়ছে ছাড়া কমছে না। নির্বাচন পরবর্তী সংহিসতা আমাদের দেশে নতুন নয়। প্রতি নির্বাচনের পরেই সহিংস ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এসব ঘটনায় প্রধানত পরাজিত দলের নেতাকর্মীরাই শিকার হয়। এবার যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সেজন্য বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই সতর্ক ছিল বলে দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তা সত্তে¡ও দেশজুড়ে আতংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারলো কেন, সে প্রশ্ন মোটেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। দলীয় দিকনিদের্শনা এক শ্রেণীর নেতাকর্মী বেতোয়াক্কা করার সাহস কীভাবে পাচ্ছে তা দলকেই খতিয়ে দেখতে হবে। তারা যা করছে তাতে দলীয় ভামর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে, দল বিতর্কিত হচ্ছে। কোনোক্রমেই এটা হতে দেয়া যায় না। দল এক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব ও ভূমিকা নেবে, প্রয়োজনে শুদ্ধি অভিযান চালাবে বলে দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে।
এও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন যখন চলছে, সহিংসতার ঘটনা ঘটছে কিংবা হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ হচ্ছে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরব কিংবা নিম ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। এক্ষেত্রে ব্যতয় ঘটলে মানুষ কোথায় নিরাপত্তার আশ্বাস বা নিরাপদ আশ্রয় পাবে? দল ও আইনশৃংখলা বাহিনী আন্তরিক হলে সব ধরনের জুলুমের দ্রুতই অবসান ঘটতে পারে, দেশের মানুষ এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। একথা সকলেরই স্মরণ রাখা দরকার, মজলুমের আর্তনাদ সরাসরি আল্লাহপাকের দরবারে পৌঁছে যায়। রাসূলেপাক সা: বলেছেন, মজলুমের আর্তি ও খোদার আরশের মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না। এটি সরাসরি তার কাছে পৌঁছে যায়। তিনি আরো বলেছেন, জুলুমের প্রতিকার আল্লাহ অবশ্যই করবেন, কিছুটা বিলম্ব হলেও। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই জালেমরা তাদের অপকর্মের প্রতিফল যথাসময়ে দেখতে পাবে। অতএব, মজলুমের বদদোয়ার ব্যাপারে সকলেরই সাবধান হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি সবার প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচনের পর দেশ ও জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব আরো বেড়ে গেছে। তার একথাগুলো দলের নেতাকর্মীদের উপলদ্ধি করার বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রীসহ দলের নীতিনির্ধারকদের অভিপ্রায় অনুযায়ী দলীয় নেতাকর্মীদের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমেই দেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন