শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিক্ষাঙ্গন

আমরা কি পারছি শিক্ষিত মানুষ গড়তে?

শিক্ষা: কিছু প্রশ্ন ও কঠিন বাস্তবতা!

রাজিয়া সুলতানা জান্নাত: | প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০১৯, ২:১৫ পিএম

আমাদের দেশের বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বলতে গেলে কিছুটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পূর্বে আমরা শিক্ষার স্তরকে তিনভাগে জানতাম। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক যেখানে অন্তর্ভূক্ত আছে মাদরাসা শিক্ষাও। বর্তমান বাস্তবতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে যে বিষয়টা দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা এখন প্লে, নার্সারি আর কেজি থেকে শুরু হয়। একটা সদ্য জন্মলাভ করা সন্তান যখনই কথা বলতে শেখে বাবা-মা উন্নত ভবিষ্যত এর চিন্তায় তাদেরকে নিয়ে হাজির হন কিন্ডারগার্টেন কিংবা চাইল্ড কেয়ার এর মতো নানান প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
 
শুরু থেকেই বাচ্চাদের বুঝানো হয় তোমাকে ১০০ তে ৯৯ পেতে হবে। প্রাথমিকের মোটামুটি শেষ পর্যায়ে শুরু হয় আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বুঝানো হয় তোমাকে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চান্স পেতেই হবে। তারপর পিএসসি। পেতে হবে গোল্ডেন জিপিএ-৫। না হয় বাবা মা সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না।
 
জেএসসি, এসএসসি আর এইচএসসিতেও একই। সৃজনশীলতা নিজের মাঝে তৈরি হওয়ার আগেই তাকে বুঝানো হয় তোমাকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেতেই হবে। পশের বাড়ির অমুকের ছেলে এর গতবছর জিপিএ-৫ পেয়েছে। তুমি যদি গোল্ডেন না পাও তাহলে আমরা মুখ দেখাতে পারব না। আর এভাবেই প্রচণ্ড চাপের মধ্যদিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্থর পার করতে হচ্ছে চাপ প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে। গোল্ডেন প্রতিযোগীতার বাজারে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে শিক্ষার্থীদের অসৎ উপায় অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। প্রশ্নফাঁশ! পিছিয়ে থাকেছে না অভিভাবক থেকে শুরু করে প্রাইভেট টিচার পর্যন্ত। 
 
অনেক সময় চাপ সামলাতে না পেরে রেজাল্ট খারাপ করে হরহামেশাই ঘটে চলেছে আত্মহত্যার ঘটনা। পরীক্ষার ফলাফলের দিনে খবরের পাতাজুড়ে আনন্দ উৎসবের চিত্রের পাশাপাশি আত্মহত্যার কলামটিও স্থান পাচ্ছে বেশ গুরুত্বের সাথে।
 
কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। প্রাথমিক, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থী ও পিছিয়ে নেই অসৎ উপায় অবলম্বনে। চলতি বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ঘ” ইউনিটের পরিক্ষা ছিলো বাস্তব প্রমাণ।
 
শুধু কি শিক্ষা অর্জন! শিক্ষক নিয়োগেও আজ দূর্নিতি। যা এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীকেও চাপিয়ে দেয়া হয় শীট, বই, মিডটার্ম আর সেমিস্টার এর মতো বিষয়গুলো।
 
সবমিলে প্রশ্ন একটাই। আমরা কি পারছি শিক্ষিত মানুষ গড়তে?
 
এখন আসি কিছু বাস্তবতায়। কোনো এক মনীষী বলেছিলেন, “তুমি যদি ২টি R শিখো Reading & writing তারপর যদি তৃতীয় R,- Religion  না শিখো তবে তুমি চতুর্থ  R- Rascal হতে বাধ্য”। 
 
আজ আমরা শিক্ষিত হচ্ছি ঠিকই। কিন্তু শিক্ষার সাথে নৈতিকতার সমন্বয় না ঘটার কারণে একটি ‘অসৎ শিক্ষিত’ জাতি হিসেবে উপস্থাপন করতে করতে হচ্ছে। আমরা জানি, কোনো ধর্মই মানুষকে অসৎ তথা অন্যায়ের দিকে ধাবিত হতে দেয় না। “এটাই ধর্মের ধর্ম”। যে যার ধর্ম যদি সঠিক ভাবে অনুশীলন তবে সে সৎ এবং বিনয়ী হতে বাধ্য। আর সত্যিকার শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী করে। কখনো অহংকারী করে তুলে না।
 
শিক্ষার সাথে নৈতিকতার সমন্বয় না থাকার ফলে দেখা যাচ্ছে, ঐশীর মতো মেধাবী ছাত্রীরা মাদক সেবন করে নিজের বাবা-মা কে খুন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। পরিমলের মতো শিক্ষকদের হাতে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে কোমলমতী শিক্ষার্থীদেরও।
 
আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী একটা ছোট্র বাচ্চাকে কাঁধ ভর্তি বই নিয়ে ক্লাসে যেতে হয়। সৃজনশীল কয়েকটি বিষয় থাকলেও ৯৫% শিক্ষার্থী পাশ করার জন্যে এ বিষয়গুলো পড়াশোনা করে। খুব কমই পারে নিজেদের মাঝে সৃজনশীলতা তৈরি করতে।
 
মুখস্থ বিদ্যায় বিশ্বাসী সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে সর্বক্ষণ বই নিয়েই পড়ে থাকে। খুব ভালো সিজিপিএ নিয়ে একদিন সে শিক্ষক হতে পারে ঠিকই।কিন্তু বইয়ের বাইরের পৃথিবী অনেকটাই অজানা থেকে যায় তাদের কাছে। এছাড়া ধর্ম নৈতিকতার সাথে সমন্বয় না থাকার কারণে সৃজনশীল রেজাল্ট তৈরি হচ্ছে কিন্তু সৃজনশীল মানুষ তৈরি হচ্ছে না।
 
স্বাধীনতার পর থেকে অনেক এগিয়েছি আমারা। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আজ মধ্যম আয়ের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বেড়েছে শিক্ষার হার। কিন্তু নৈতিক শিক্ষায় কতটুকু শিক্ষিত হয়েছি আমার?? প্রশ্ন থেকেই যায়।
 
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছোট থেকে শিশুদের গোল্ডেন জিপিএ-৫ এর স্বপ্ন না দেখিয়ে তাদের নিজেদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে হবে। সৃজনশীলতা তৈরির জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তাদের। কোন কাজ কে ছোট করে না দেখে বরং সবকিছুর সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার মতো করে ছোট থেকেই তৈরি করতে হবে শিক্ষার্থীদের।
 
শিক্ষার অন্যতম একটা উদ্দেশ্য হলো নিজেকে জানা। নিজেকে জানার মাঝে দেশপ্রেম ও অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেছিলেন “সোনার বাংলাকে গড়তে হলে প্রয়োজন সোনার মানুষ”। আর নিজেকে জানার মাধ্যমেই স্বদেশের প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে সোনার মানুষ। 
 
যারা পারবে সোনার বাংলাকে সত্য ও সুন্দর এর উপর প্রতিষ্ঠিত করতে।আর এটা তরুণদের মাধ্যমেই সম্ভব। তাই প্রয়োজন তরুনদের গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। অভিবাবকদের ও প্রয়োজন এ বিষয়ে সচেতন থাকা।
 
লেখক: রাজিয়া সুলতানা জান্নাত 
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ 

 

  1Attached Images
 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন