বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

খালে পরিণত নদী

অর্ধশতাধিকের অস্তিত্ব বিলীনের পথে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানি সঙ্কট

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সাথে বলিষ্ঠ ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে নদ-নদীর। রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বাংলাদেশের নদী ধাবমান। নদীই জীবন। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার পানি প্রাপ্তি। জীবন-জীবিকার সমস্যার সমাধান এবং সামগ্রিক উন্নয়নে নদ-নদী বাঁচানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সেটি সম্ভব হচ্ছে না ফারাক্কার কারণে। দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নির্ভরশীল পদ্মা ও গড়াইএর শাখা নদী মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ইছামতি, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা ও অভিন্ন নদী ইছামতি ও কোদলাসহ অর্ধশতাধিক নদ-নদীর অবস্থা শোচনীয়। কার্যত মৃত্যুমুখে পড়ছে নদ-নদী। শুকিয়ে পরিণত হয়েছে মুমূর্ষ খালে। প্রায় সব নদ-নদীর অবস্থা কোথাও স্রোতহীন, কোথাও পানিশূন্য। নদ-নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ার স্বাভাবিক ধারা হয়েছে অস্বাভাবিক।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর মোঃ সাইবুর রহমান মোল্যা গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়া বা নাব্য হারানোর কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশের উপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। নদী, খাল ও বিলের সংযোগ এবং পানি প্রবাহ না থাকলে বায়োডাইভারসিটি ও ইকেবা সিস্টেম নষ্ট হয়। মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি হয় জীবন-জীবিকার ব্যবস্থাপনায়। তাই যেভাবেই হোক বৃহত্তর স্বার্থে নদ-নদী বাঁচাতে হবে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, শুধুমাত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার ২২ হাজার ৭শ’৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় সব নদ-নদী পদ্মার শাখা-প্রশাখা। নদীর প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় পলি জমে ভরাট হয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ছাড়াও ভূমি গঠনের পরিবর্তন ঘটছে। পৃথিবীর অনন্য সম্পদ সুন্দরবনের বনভ‚মি বিপদের আশঙ্কা কাটছে না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলসহ বিশাল এলাকার অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে অভিন্ন নদী শাসনে। ক্রমাগতভাবে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ছে। জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর উপকূলীয় অঞ্চলে জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। নদী ভাঙনে উদ্বাস্তু হচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে প্রজেক্ট) অস্তিত্ব বিপন্ন। মংলা সমুদ্রবন্দর ও নওয়াপাড়া নদী বন্দর মারাত্মক সংকটে। নাব্যের অভাবে নৌ যোগাযোগ হচ্ছে বিপর্যস্ত। আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন ঘটছে ষড়ঋতুর। মারমুখী ও বিপজ্জনক হচ্ছে পরিবেশ। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, উদ্ভিদ, প্রাণীকুল, জলজ, বনজ ও মৎস্য সম্পদের অপুরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। লবনাক্ততা গ্রাস করায় উপক‚লীয় বিস্তীর্ণ এলাকা হচ্ছে বিরাণভূমি। খরা ও মরুকরণ প্রক্রিয়া হচ্ছে মারাত্মক। প্রতিমুহূর্তে খেসারত দিতে হচ্ছে নানাভাবে বিশাল জনগোষ্ঠীকে।
সংশিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কথা, নদ-নদী বাঁচানো এবং জীবন-মরণ সমস্যার সমাধানের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে এর আগে অসংখ্যবার সরকারকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অতীতের মতোই বিষয়টি ‘ওভারলুক’ করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। একটি নদের কাহিনী থেকেই নদ-নদীর অবস্থা কতটা করুণ তার চিত্র পাওয়া যাবে। সেটি ঐতিহ্যবাহী ভৈরর নদ। পদ্মার শাখা মাথাভাঙ্গা নদীর বৃত্তকার বাঁক থেকে ভৈরব নদের উৎপত্তি। ভৈরব নদ কোটচাঁদপুর, বারোবাজার, বারীনগর, যশোর, শিল্পশহর নওয়াপাড়া হয়ে চলে গেছে খুলনায়। ভৈরব নদকে ঘিরেই যশোর, নওয়াপাড়া ও খুলনা শহর গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠিত হয় শিল্প কল কারখানা। নদ-নদীকে ঘিরেই ম‚লত এলাকার কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, মৎস্য ও বনজ সম্পদ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। রক্ষা হয় পরিবেশ। সেই ভৈরব নদটি এখন প্রায় মৃত। থেমে থেমে চলে দখলের পর দখল। কোথাও কোথাও নদের অস্তিত্ব একেবারেইা মুছে গেছে। যশোরের কিছু অংশে এখন নদ খনন করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তাতে পুরো নদ বাঁচবে এবং নাব্য ফিরে পাবে এটি বলা যাচ্ছে না। নদপাড়ের বাসিন্দা ডাকাতিয়া গ্রামের বৃদ্ধ ইজাহার আলী জানালেন, ভৈরবের যে গর্জন আমরা দেখেছি তা এখন নতুন প্রজন্মের কাছে শোনালে কল্পকাহিনী মনে হবে। নদটি চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল। ভৈরবের মতোই প্রায় সব নদী আস্তে আস্তে খালে পরিণত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি, কৃষি সম্প্রসারণ ও হাইড্রোলজি বিভাগ স‚ত্র বলেছে, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ পানি সংকট দেখা দেয় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ভূপৃষ্ঠে পানি পাওয়া হয় কঠিন। এবারও ভরা শুষ্ক মৌসুমে এই অঞ্চলে পানি সঙ্কট হবে ভয়াবহ এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন বোরো মৌসুম শুরু হচ্ছে, বুক কাঁপছে কৃষকের। নদী বিশেষজ্ঞদের কথা, সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূলভিত্তি নদ-নদী। অথচ এর প্রাণ রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বরাবরই অনুপস্থিত থাকছে। স্বাধীনতার পর বহুবারই সকল নদ-নদী ড্রেজিং, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প ও পানির রিজার্ভার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে পরিকল্পনা কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। যার জন্য সিংহভাগ নদ-নদী শুকিয়ে মুম‚র্ষ খালে পরিণত হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন