বাংলাদেশের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা গুলোর মধ্যে রক্ত স্বল্পতা অন্যতম। কোনো ব্যক্তির বয়স, এবং পুরুষ মহিলা ভেদে যে পরিমাণ হিমোগেøাবিন স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে থাকা প্রয়োজন তার চেয়ে পরিমাণে কম থাকলে সেই ব্যক্তির রক্ত স্বল্পতা আছে বলে ধরা হয়। রক্ত স্বল্পতা বা রক্ত শূন্যতা বা অ্যানিমিয়া মানে রক্ত কমে যাওয়া নয়। আমাদের শরীরের রক্তের উপাদান লোহিত কণিকায় হিমোগেøাবিনের পরিমাণ কমে গেলেই দেহে রক্ত শূন্যতা বা রক্ত স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া বলা হয়। এই রক্ত স্বল্পতা বা রক্ত শূন্যতার কারণে দেহ সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারে না। ফলে দেহে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী রক্তস্বল্পতা রোগে ভুগে। আমাদের দেশের বিশেষ করে কিশোরী যাদের বয়স ৯ বছর থেকে ২০ বছরের মধ্যে তারাই এ রোগে ভুগে বেশি। কারণ মেয়েদের প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার পর যে পরিমাণ রক্ত দেহ থেকে বের হয়ে যায় উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণের অভাবে সেই পরিমাণ রক্ত দেহে তৈরী হয় না। ফলে আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলের বেশির ভাগ মেয়েরা সঠিক স্বাস্থ্য নিয়ে গড়ে উঠতে পারে না। দ্বিতীয়ত বড় সমস্যায় ভুগে গর্ভবতী মহিলা ও বুকের দুধ প্রদানকারী মায়েরা। তাদের মধ্যে অনেকেই জানেনা যে মাস থেকে তিনি মা হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাবে তার ৩/৪ মাস থেকে লৌহ সমৃদ্ধ খাবার বা আয়রণ বড়ি খেতে হয়। গর্ভকালীন অধিক মৃত্যুর হারের অন্যতম কারণ রক্ত শূন্যতা। আমাদের বাংলাদেশে এ রক্তশূন্যতার হার অত্যন্ত বেশী। এ রক্ত শূন্যতার কারণে গর্ভবর্তী মায়েরা নানা ত্রæটিযুক্ত সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। অভিভাবক এবং প্রত্যেক মাকে এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
রক্ত শূন্যতা কী ঃ বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী রক্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণ হিমোগেøাবিন পরিমাণ কমে গেলে তাকে বলা হয় রক্ত শূন্যতা। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের রক্তে হিমোগেøাবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ প্রতিডেসিলিটার রক্তে ১৩-১৮ গ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলাদের রক্তে প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১১.৫-১৬.৫গ্রাম এবং শিশুদের ৫মাস থেকে ৫৯ মাস বয়স পর্যন্ত রক্তে প্রতিডেসিলিটার রক্তে ১১ গ্রাম থাকা প্রয়োজন।
রক্ত শূন্যতার কারণ ঃ বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে জনগন রক্ত শূন্যতায় ভুগেন। এর মধ্যে অপুষ্টি, অজ্ঞতা, ঘনঘন গর্ভধারণ, মাসিক, কৃমি সংক্রামন, রক্তে ক্যান্সার ও পাকস্থলির বিভিন্ন অসুখ। তবে উল্লেখযোগ্য কারণ গুলো হলোÑ * দৈনন্দিন খাবার গ্রহণের মধ্যে লৌহ জাতীয় খাবারের অভাবজনিত কারণে। * রক্তে লৌহের ঘাটতির কারণে রক্তে লোহিত কণিকার উৎপাদন ব্যহত হলে। * রক্তের কোষগুলো বেশি পরিমাণে মারা গেলে বা রক্তে লোহিত কণিকা বেশি ভেঙে গেলে, সাধারণত এটি হয় থ্যালাসেমিয়া রোগ হলে। * দেহে লৌহ ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন সি অথবা ফলিক এসিডের অভাব দেখা দিলে। * থ্যাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ বা লিভারের অসুখ যেমনÑ লিভার সিরোসিস রোগ হলে। * দেহ থেকে অতিরিক্ত রক্ত বেরিয়ে গেলে যেমনÑ সন্তান জন্মদান, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্ত ¯্রাব হলে, রক্তক্ষরণজতিন রোগ হলে যেমনÑ পেপটিক আলসার, অর্শ্ব রোগ ও ক্যান্সার। * পেটে কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হলে এ সমস্যাটি বেশি দেখা দেয়। * শিশুকে স্তন দানের সময় প্রয়োজনীয় আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার মা না খেলে এ সমস্যা দেখা দেয়। * পাকস্থলী অন্ত্রে ক্যান্সার হলে। * দেহে কোন কারণে অপারেশন হলে। * ঘনঘন সন্তান নিলে। * প্রসবের সময় রক্ত বেরিয়ে যাবার কারণে। * তাছাড়া যেকোন খাবার গ্রহণে দেহে লৌহ শোষণে বাধা দেওয়ার কারণে, যেমনÑ চা, কফি। শিশু খাবারে প্রয়োজনমত আয়রণ না থাকলে। * প্রয়োজনমত প্রোটিন জাতীয় খাবার না খেলে।
দৈনিক চাহিদা ঃ প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন আয়রনের প্রয়োজন ২৪মিলিগ্রাম। প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার প্রতিদিন আয়রণের প্রয়োজন ৩২ মিলিগ্রাম এবং গর্ভাবস্থায় ৪০ মিলিগ্রাম। শিশুকে বুকের দুধদান কালে ৩২ মিলিগ্রাম, শিশুর ২০-২০ মিলিগ্রাম।
রক্ত শূন্যতা বুঝার উপায় ঃ অল্প ও মাঝারি রক্ত শূন্যতায় তেমন কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। তবে রক্ত পরীক্ষা করলে রক্ত স্বল্পতা ধরা পড়ে। সাধারণত রক্ত শূন্যতা একটু বেশী দেখা দিলে নানা লক্ষণ শরীরে ফুটে উঠে। যা দেখে বুঝা যায় লোকটি রক্ত শূন্যতায় ভুগছে। লক্ষণ গুলো হলো: অবসাদ, দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, সামান্য পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, চোখে ঝাপসা করা, হাত পায়ে ঝিমঝিম করা, মাথা ব্যথা করা, হাত পা সহ পুরো শরীর ফ্যাকাশে হওয়া, অলসতা বেড়ে যাওয়া, মুখে ঘা, জিহŸায় ঘা, গিলতে অসুবিধা ভুগ করা, নখ ভঙ্গুর বা চামচের মত হওয়া। তাছাড়া চামড়ার ভাড়, নখ, ঠোঁটের ভিতরের অংশ শরীর এবং মুখের চামড়ার রং ফ্যাকাশে হওয় যাওয়া এবং নাড়িরগতি বেড়ে যাওয়া। মেয়েদের মাসিকে সমস্যা কিংবা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া অথবা পেটে নিচ তলায় অসহ্য ব্যথা অনুভব করা এবং মাসিক না হওয়া অথবা প্রাপ্ত ব্যথাসহ মাসিক হওয়া। কম পরিমাণে মাসিক হওয়া অথবা রক্ত¯্রাব বেশি হওয়া। রক্তে অনুচক্রিকার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে সঙ্গম করার চাহিদা কমে যাওয়া।
যা যা করণীয় ঃ বাড়িতে বসেই রক্তশূন্যতা সম্পর্কে মোটামোটি ধারণা পাওয়া যায়। লক্ষনগুলো সামান্য প্রকাশ পেলেই লৌহ জাতীয় খাবার নিয়মিত খেতে হবে। উদ্ভিদজ ও প্রাণিজ খাদ্যে উভয়টাই আয়রণ পাওয়া যায়। যেমনÑ কলিজা, মাংস, মাছ, ডিম, সয়াবিন, কলা, মটরশুটি, শিমের বিচি, সবুজ ও লাল শাক সবজি, ফুলকপি, ডাল, বাদাম, কিসমিস, খেঁজুর, কুল (বরই), ধনেপাতা, পাকা তেতুল, ছোলা, আটা, শালগম, চিড়া, কালো জাম, শুটকি মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ আছে এসব খাবার কিশোর কিশোরী মহিলা মা এবং শিশুকে প্রতিনিয়ত পরিমাণমত খেতে হবে। উদ্ভিদ খাদ্যে ফাইটেট, অক্সালেট নামক উপাদান থাকায় আয়রণ শরীরে ভালভাবে শোষিত হতে পারে না। তবে প্রাণিজ আয়রণ উদ্ভিদ আয়রণ শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই আয়রণযুক্ত উদ্ভিদজ খাবারের সাথে মাছ, মাংস খাওয়া ভালো। তবে মনে রাখবেন সবজি সারারাত ফ্রিজে রাখলে আয়রণের মাত্রা মারাত্মকভাবে কমে যায়। আয়রণ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর চা বা কফি খাবেন না। চা বা কফিতে যে ট্যানিন নামক উপাদান থাকে তা রক্তে আয়রণ শোষণের মাত্রা কমিয়ে দেয়। গর্ভবতী মাকে গভধারণের ৩/৪ মাস থেকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং আয়রণ টেবলেট ৬০ গ্রাম এবং ৫০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড খাওয়া উচিত। তবে মনে রাখবেন দেহে রক্ত শূন্যতা বেশি দেখা দিলে অবশ্যই একজন রেজিষ্ট্রার চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কোন অবস্থায়ই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ধরনের ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না। নিজে নিজে কোন ট্যাবলেট বা সিরাপ গ্রহণ করবেন না। আপনার শরীরের জন্য কোন ঔষধ প্রয়োজন তা চিকিৎসকই বুঝে দিবেন। অপুষ্টি, দরিদ্রতা, পরিবারের অধিক সদস্য সংখ্যা, কুসংস্কার এ রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। অপরদিকে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এ রোগ প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। আসুন আমরা সকলে খাদ্য গ্রহনে সচেতন হই পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করি সুস্থ জীবন গড়ি।
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন