শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ঢাকায় অপ্রতিরোধ্য বায়ুদূষণ

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর হিসাব অনুযায়ী, গত ১৯ ও ২০ জানুরারি বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল ‘এক’ নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নয়াদিল্লি। বিশ্বের প্রায় বেশির ভাগ শহরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দূতাবাস ও কার্যালয়ে বায়ুমান পর্যবেক্ষণ যন্ত্র রয়েছে। ওই যন্ত্রে শহরগুলোর বায়ুমান প্রতি বছর, এমনকি প্রতি ঘণ্টায় হালনাগাদ করা হয়। উপরোক্ত তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে করা। এছাড়াও সম্প্রতি ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ ২০১৯ সালের ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। গত বছর সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। ঢাকার বায়ুদূষণের এই চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের নিজেদের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকার বায়ুমান ছিল মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর।
পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দুষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? ঢাকা কেন বারবার দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? ধুলা-বালি, শ্বাস কস্ট, শিশুসহ নিরিহ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী দেশের কতিপয় ধান্দাবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীনরা ও সেবাদানকারী নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। রাস্তা কাটলেই টাকা! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারোরই কারোর সাথে কাজের কোনো সমন্বয় না থাকায় একই রাস্তা বছরে ২/৩ বার কাটা হয়। গবেষণায় যখন আসে, ‘বায়ুদূষণে এক নম্বরে ঢাকা’ তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে; সিটি কর্পোরেশন কি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে? রাজধানীর সড়কগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন সকালে দুই সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সংস্থা দুটি তা সঠিকভাবে করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। গবেষণায়ই প্রমাণ হয়, পরিবেশ রক্ষায় সিটি কর্পোরেশনের কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই। এর প্রতিকার কার কাছে আছে? কে দেবে সমাধান?
ঢাকায় বায়ু দূষণের বরাবরই যে কারণে হয়ে থাকে, তা হলো, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সঙ্গে যোগ হওয়া। ঘরের বাইরে তো বটেই, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠেও ভর করছে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নগরবাসী, বিশেষ করে শিশুরা। যাতে শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ নানা রোগবালাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রায় ২০ বছর ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করছেন। অধ্যাপক আবদুস সালাম ও পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমান ঢাকার রাস্তার ধুলায় ভারী ধাতুতে স্বাস্থ্যঝুঁকিবিষয়ক গবেষণাটি যৌথভাবে করেছেন। গবেষক দল ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার রাস্তা, ফুটপাত, নর্দমার পাশের মাটি ও গর্ত থেকে ৩০০ গ্রাম করে ধুলার নমুনা সংগ্রহ করে। এসব এলাকা থেকে সংগৃহীত নমুনা পরে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে রাজধানীর ৮৮ এলাকার সবখানেই কমবেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে জিপিও এলাকায় সবচেয়ে বেশি ভারী ধাতু (ক্যাডমিয়াম, সিসা, নিকেল, আর্সেনিক, কপার ও ক্রোমিয়াম) শনাক্ত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল, যানজট ও বেশ কিছু ধাতু গলানোর কারখানার দূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ঢাকার সড়ক ও ঘরের ভেতর বায়ুদূষণ বিষয়ে দুটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। গবেষণা দুটি যথাক্রমে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ এবং ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলুশন রিসার্চ’-এ চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি সংস্থা পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা দুটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ।
গবেষণায় ঢাকার রাস্তার ধুলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাটিতে যে মাত্রায় ক্যাডমিয়াম থাকার কথা, ধুলায় তার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আর নিকেল ও সিসার মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটি ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের ঝুঁকি আগেই ছিল, এবার ঢাকার রাস্তার ধুলার মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এসব ভারী ধাতু কণার আকার এতটাই সূ² যে, তা মানুষের চুলের চেয়ে ২৫ থেকে ১০০ গুণের বেশি ছোট। ফলে খুব সহজেই এসব সূ² ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসছে; শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে।
গবেষণায় জিপিও, বঙ্গভবন ও রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকার ধুলায় ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ মাটির স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। কারওয়ান বাজারের এফডিসি রেলক্রসিং, বাংলামোটর ও জিপিও এলাকার ধুলায় উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়াম শনাক্ত করেছে গবেষক দল। ঢাকা শহর ও এর কাছাকাছি গড়ে ওঠা অনেক ট্যানারি ও ডাইং শিল্প মূলত এই উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়ামের উৎস। মাটি থেকেও সীমিত পরিমাণে এই ভারী ধাতু এসে নির্দিষ্ট সময় পরে ধুলায় যুক্ত হচ্ছে। যানবাহন ও কারখানার দূষণে যা আরও বাড়ছে। এছাড়াও ফার্মগেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, আসাদ গেট থেকে কল্যাণপুর এবং মহাখালী থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় দস্তার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করে চিকিৎসকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কাজী রাকিবুল ইসলাম বলেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূ² বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। পাঁচ বছর ধরে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা গভীর উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ নগর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা: দেশের পরিবেশগত বিশ্লেষণ-২০১৮’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ।
পানি দূষণ আধুনিক সভ্যতার আরেক অভিশাপ। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে চটকল, কাপড়কল, কয়লা ধোলাইকল, চিনিকল, কাগজকল, ভেষজ তেল তৈরি ও চামড়া পাকা করার কারখানা ইত্যাদি। বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল থেকে ক্ষার, অ্যামোনিয়া, সায়ানাইড, ন্যাপথালিন, ফিনল ও বিবিধ রাসায়নিক পানিদূষক উপাদান এসে মিশছে। দূষণের কবলে বাংলাদেশের প্রায় সব নদীর পানি। ফসলের ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার ও কলকারখানার বর্জ্য নদীতে মিশে পানি দূষিত হয়। পানি দূষণের কারণে ডায়েরিয়া, টাইফয়েড, কলেরা, প্যারাটাইফয়েড জ্বর, বেসিলারী আমাশয়, জন্ডিস, পোলিওমাইলিটিস হেপাটাইটিস, অ্যামোবিক আমাশয়সহ বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পানির অপর নাম জীবন। মানুষের শরীরের ৬৫ ভাগ পানি। পৃথিবীর ৭১ ভাগ পানি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণমূলক নানাবিধ অপরিণামদর্শী ক্রিয়াকলাপের কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ বিশুদ্ধ পানির সংকটে থাকে।
কোনো দেশে দ্রুত উন্নয়ন হতে থাকলে প্রচুর নির্মাণকাজ ও শিল্পায়ন হয়, এর প্রভাব পরিবেশের ওপর পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পকারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশগত সুরক্ষার ন্যূনতম বিষয়গুলো মানা হয় না। এটা দুঃখজনক। এগুলো দেখার জন্য সরকারি সংস্থা আছে। তারা সঠিকভাবে যে দায়িত্ব পালন করছে না, দূষণের রেকর্ডেই সেটা বলে দেয়। সামগ্রিকভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্ব ও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এখনই যদি জরুরি কাজ হিসেবে দূষণ নিয়ন্ত্রণকে না দেখা হয়, তাহলে সামনে আরো বড় পরিবেশ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন