বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজধানীর বায়ুদূষণের ভয়াবহতা ও করণীয়

আবু আফজাল মোহা. সালেহ | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

গত চার বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে ঢাকার বাতাসে দূষণ ও বিপদের মাত্রা, সেই সঙ্গে তাৎক্ষণিক করণীয়ও জানান দিয়ে আসছে। ইন্টারনেটে এটি রিয়াল টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) যেটাকে বাংলায় ‘সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচক’ হিসাবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর বায়ুর দূষণহার নিয়ে। বিশ্বে নির্ভরযোগ্য এ যন্ত্রের সূচকে দেখা ঢাকার বাতাসে দূষণ বা বিষের অবস্থা মারারত্মক অবস্থায়। চব্বিশ ঘণ্টায়ও ইতিবাচক সবুজ সূচকে আসছে না। বেশিরভাগ সময় বায়ুতে অতি বিপদজনক উপাদানের উপস্থিতির দেখাচ্ছে। এ নির্ভরযোগ্য যন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় দশ হাজার শহরের বায়ুমান পরীক্ষা করা হয় বলে বিভিন্ন পত্রিকাসূত্রে জানা যায়।
বায়ুতে কয়েকটি রং ও বাতাসে ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণার (যেমন ওজোন গ্যাস, হাইড্রোজেন সালফাইড, সিসা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড) উপস্থিতির পরিমাণ দিয়ে। বায়ুমান ভালো হলে সবুজ, মোটামুটি ভালো হলে হলুদ, কারো কারো জন্য অস্বাস্থ্যকর হলে কমলা, সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর হলে লাল, অতি অস্বাস্থ্যকর হলে বেগুনি আর বিপজ্জনক হলে খয়েরি রং দিয়ে সূচকে চিহ্নিত করা হয়। ভাবার বিষয় হচ্ছে, দুপুরের পর থেকেই ঢাকা বাতাসে বিপদজনক উপাদানের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এমনকি ছুটির দিনেও সবুজ সংকেতে আসছে না।
বাতাসে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫। ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে কম ব্যাসের অতিক্ষুদ্র এসব বস্তুকণার সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম। যদিও ঢাকার বাতাসে পাওয়া গেছে এর চেয়ে বেশি মাত্রায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকার বাতাসে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর মাত্রা গত বছরের চেয়ে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের উপস্থিতিও। বায়ুর মান পরীক্ষায় নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (সিএএসই) প্রকল্পের আওতায় ঢাকা (৩টি), গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশালে কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন (সিএএমএস) স্থাপন করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। তার ভিত্তিতে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে অধিদপ্তর। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের শেষ কয়েক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দূষণের মাত্রা বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
ঢাকা শহরের ছয়টি বিদ্যালয়ের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ে ২০১৬ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব। ফলাফলে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোর ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না। তাদের ফুসফুস ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করছে। কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার উপরে রয়েছে। ক্ষতিকর বস্তুকণার এ উপস্থিতি না কমে উল্টো বাড়ছে।২০১৭ ও ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে অতিসূত্র বস্তুকণার পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিশু, রুগী আর বৃদ্ধরা। শুধুমাত্র বায়ু দূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা শহরের ৬ লাখ মানুষ এখন সিসা দূষণের কবলে। ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ু দূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ইট ভাটাগুলো বায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা ৩৪ ভাগ এবং মোটরযান ১৮ ভাগ দায়ী বলে উল্লেখিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ঢাকাতেই এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারাদেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার। পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর।
স্বাস্থ্যবিদদের অভিমত হচ্ছে, বায়ুতে থাকা সিসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটা বিষয়। সিসার উপস্থিতির প্রভাবে মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম নেয়। বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতিসূত্র এ বস্তুকণা স্বল্প মেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধির জন্য দায়ী বলে জানান চিকিৎসকরা। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তারা। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি শ্বাসতন্ত্রের রোগ হয়। হাঁপানি রোগী হলে তাদের হাঁপানি বেড়ে যায়। আবার অনেকে নতুন করে হাঁপানি, শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি, হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত হয়। যক্ষার মতো রোগগুলো বায়ুদূষণের কারণে বেড়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেড়ে যায় নবজাতক ও শিশুদেরও। ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী বায়ুদূষণ।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউ বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা, সড়কের ধুলা, যানবাহন এবং বায়োগ্যাস পোড়ানোকে দায়ী করে তারা। ঢাকার বায়ুদূষণে ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের ধোঁয়া ১০ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণ ৬ শতাংশ দায়ী বলে জানানো হয়। ঢাকা মহানগরীর আশপাশে অনেক এলাকায় ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার কারণে বাতাসে সূ² নানা ধরনের ধূলিকণা মিশে যায়। নির্মাণকাজের সময় নিয়ম না মেনে মাটি, বালুসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা, রাস্তার দু’পাশে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা সর্বোপরি যানবাহনের কালো ধোঁয়া বাতাসকে দূষিত করে তোলে। ফলে বাড়ছে সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা। এ অবস্থায় নাজুক অবস্থায় পড়ে শিশু আর রুগীরা।
ইট প্রস্তুতের ধরন ও আগে-পরের বিষয়/পদ্ধতি নিয়ে পূর্বের ইট প্রস্তুত আইন ২০১৩ সংশোধন করা হয়েছে। ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক পদ্ধতিকে যাতে প্রমোট করা হয়, আইনের বিভিন্ন ধারায় তা সংযোজন করা হয়েছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো পদ্ধতি ব্লকের দিকে যেতে হবে। এ জন্য আইনটি ব্যাপকভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু বড় চিন্তার জায়গা হলো নির্মাণকাজ। যে যেভাবে পারছে নির্মাণ কাজ করছে। এজন্য যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র ও ‘যে যেভাবে পারে’ নির্মাণ কাজে থেকে বিরত থাকার জন্য প্রশাসনকে বা কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র মুনাফার কথা না ভেবে মালিক/সমিতি/ডেভেলপারেদের দেশ ও ভবিষ্যতের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে। শুধুমাত্র বিবেককে জাগ্রত করলেও সরকারের কঠোর তদারকি লাগবে না। অবশ্য এ ব্যাপারে মালিক-সরকারি কর্তৃপক্ষকেই বিবেক জাগ্রত করতে হবে।
বেশ কিছু উন্নত দেশ (এমনকি ভারতেও) বায়ু বিপজ্জনক বা অস্বাস্থ্যকর হলেই স্কুল-কলেজ ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। অনেক দেশের বায়ুমান বিপজ্জনক, এমনকি অস্বাস্থ্যকর দেখালেই ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। শহরের উন্নয়নকাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও মানা হয় পরিবেশ সম্পর্কিত সব আইন-কানুন। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম চিন্তাভাবনা নেই বা খুব কম। এমনকি বায়ুদূষণে অতিবিপদজনক অবস্থায় থাকা খোদ রাজধানীর বাসিন্দাদেরও খুব কম উদ্যোগ/কর্মসূচি রয়েছে। মিডিয়াতেও আলোচনা খুব কম হয়। এখন কিছুটা আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সেটাও পর্যাপ্ত নয়। দেখা যাচ্ছে, সরকার-জনগণ-প্রচারমাধ্যম সব জায়গাতেই বিপদজনক এ পরিস্থিতি তুললনামূলক খুব কম আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়ে তদারকি করলে কিছুদিনেই অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।
ঢাকার অবস্থা খারাপ তা প্রায় সবাই জানেন। তবে অতিমাত্রায় যে খারাপ ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে ঢাকাবাসীর খুব কম লোকই জানেন। গণমাধ্যমকে বেশি পরিমাণে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের দুর্দিনে গণমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক ভ‚মিকা থাকে। এ বিষয়েও উচ্চকিত হবে দেশের গণমাধ্যম তা আমরা আশা করি। ভয়াবহতার অবস্থা তুলে ধরে সচেতনতার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সাথে সাথে করণীয় কী কী তা তুলে ধরতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টিই পারে বিভিন্ন রকমের দূষণের ভয়াবহতা কমাতে। আইনও দরকার। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। নগরায়নে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। সবুজ বিপ¬ব দরকার। বনায়ন দরকার। পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা স্থাপন করতে হবে। প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের আবাসস্থল আমাদের প্রিয় রাজধানী শহরকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন