৬ ফেব্রুয়ারি আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-এর ইন্তেকাল দিবস। বহুভাষাবিদ এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ অনন্য ব্যক্তিত্বের জীবনালেখ্য এ ক্ষুদ্র নিবন্ধে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। দৈনিক ইনকিলাবের ন্যায় অত্যাধুনিক ও অতি উচ্চমানের একটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করে তিনি যে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বিশেষ করে এদেশের আলেম সমাজ ও দ্বীনদরদি সকলের পরম গর্ব-অহংকারের বিষয়। এক সময় উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও প্রথম কাতারের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং বাংলায় মুসলিম সাংবাদিকতার জনক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯০৩ সালে প্রথম ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’, অতঃপর ‘মাসিক মোহাম্মদী’ এবং সর্বশেষ সুবিখ্যাত ‘দৈনিক আজাদ’ প্রকাশ করে ইসলাম ও মুসলমানদের এবং এদেশের সাধারণ মানুষদের যে মহান কল্যাণ সাধন করেছিলেন, বলা হয়ে থাকে, মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) তারই অনুসরণ করে মুসলিম সাংবাদিকতায় আরো বিস্ময়কর অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তারা দু’জনই ছিলেন মাদরাসা পড়ুয়া আলেম।
১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর কলিকাতা থেকে দৈনিক আজাদ প্রথম প্রকাশ করেছিলেন মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ এবং ’৪৭ পরবর্তীকালে তা ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। বিগত ৯০-এর দশক পর্যন্ত চালু থাকার পর আজাদ বন্ধ হয়ে যায়। মওলানা আকরম খাঁ প্রতিষ্ঠিত আজাদ দেশে যেসব সেরা সাংবাদিক সৃষ্টি করে, তাদের অনেকের পদচারণা আজো বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রত্যক্ষ করা যায় এবং বিভিন্ন জনের মালিকানা, পরিচালনা ও সম্পাদনা এবং বলতে হয়, নানা পত্রিকার আবির্ভাবও তারই ফসল।
অনুরূপভাবে ১৯৮৬ সালের ৪ জুন ঢাকা হতে মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে যে নবদিগন্তের সূচনা করেন, তা অল্প সময়েই সকলের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয় এবং নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তা এখন আজাদকেও বহু গুণে ছাড়িয়ে গেছে। ইনকিলাব মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-এর বিঘোষিত নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন অসংখ্য দক্ষ, যোগ্য, লেখক-সাংবাদিক সৃষ্টি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষা, জাতীয় কল্যাণ এবং ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য সংরক্ষণে নিরলস, নিরপেক্ষ এবং সত্যনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
মুসলিম সংবাদপত্র জগতের দুই দিকপাল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও মাওলানা এম. এ. মান্নানের কেউ অধ্যয়ন জীবনে কখনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেননি। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ অধ্যয়ন জীবনের প্রায় সকল স্তর কলিকাতা আলিয়া মাদরাসায় সমাপ্ত করেন। সে সময় মাদরাসা পাঠ্যসূচিতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের দাবিতে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে জোরালো ছাত্রআন্দোলন শুরু হলে তাকে কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়তে হয়েছিল এবং তিনিসহ আন্দোলনকারী ছাত্র অনেককে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। ১৯০১ সালে পাশ করে বের হওয়ার পর তিনি সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করা দরকার যে, দৈনিক আজাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ব্রিটিশ আগ্রাসন কবলিত পরাধীন কলিকাতায়। সে সময়কার বিদ্যমান আবহাওয়া, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং মুসলমানদের শোচনীয় অবস্থায় আজাদের ভূমিকা এবং ১৯৮৬ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হতে দৈনিক ইনকিলাবের আত্মপ্রকাশে যে মৌলিক তফাত বিদ্যমান, সে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এদুটি পত্রিকার মালিক পরিচালক দুই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে জন্ম গ্রহণকারী হলেও আদর্শের দিক থেকে দু’জনই ছিলেন অভিন্ন। বিশেষভাবে উপেক্ষিত আলেম সমাজকে সচেতন করার জন্য সংবাদপত্র প্রকাশে দু’জনের ভূমিকায় কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা গেলেও সংবাদপত্রসেবী হিসেবে দু’জনের অবস্থান স্ব স্ব স্থানে সমাদৃত ও স্বীকৃত।
মুসলমান পরিচালিত-সম্পাদিত বাংলা ভাষায় সংবাদপত্রের ইতিহাসে মাদরাসায় শিক্ষিত মওলভী-মওলানাদের অবিস্মরণীয় ভূমিকার দীর্ঘ ও চমৎকার ইতিহাস রয়েছে। তারা যুগ যুগ ধরে মাদরাসায় প্রচলিত আরবি, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় শিক্ষা লাভ করে এসব ভাষায় কিছু রচনা করার সুযোগ পেলেও নানা কারণে বাংলা ভাষাচর্চার অভ্যাস করেননি। অথচ এক সময় তারাই বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশে এগিয়ে আসেন। বস্তুতঃ তৎকালীন কলিকাতাই ছিল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংবাদপত্রের কেন্দ্রভূমি। কলিকাতাকেন্দ্রিক সংবাদপত্র শিল্প বিকাশ লাভ করলেও একই সময়ে কলিকাতার বাইরের বিভিন্ন শহরে সংবাদপত্র প্রকাশ ক্রমান্বয়ে বিকাশ লাভ করে। মুসলিম সম্পাদিত পত্রপত্রিকাগুলোর মালিক-সম্পাদক ছিলেন বিভিন্ন স্তরের লেখক, বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিক। কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমগণও তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এটি ছিল এমন এক সময়, যখন হিন্দু লেখক, বুদ্ধিজীবী সমাজ মুসলমান লেখকদের বাঁকা চোখে দেখতেন, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন এবং বলতেন যে, মুসলমানগণ বাংলা জানেন না। তারা মুসলমান লেখকদের প্রতি কটাক্ষ-বিদ্রুপ করতেন, মনে করতেন যে, সংস্কৃত ভাষা না জানলে বাংলা জ্ঞান হয় না। যেহেতু মুসলমানগণ সংস্কৃত জানেন না, তাই তারা বাংলা জানেন না। এসময় আলিয়া মাদরাসা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত এক দল আলেম বাংলাভাষায় কিছু কিছু পত্রিকায় লেখালেখি আরম্ভ করেন এবং কেউ কেউ পত্রিকাও বের করতে থাকেন। বেশ কিছু মৌলিক গ্রন্থেরও তারা অনুবাদ প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম হচ্ছে: মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, শেখ আবদুর রহিম, মুনশী মোহাম্মদ জমিরুদ্দীন, মওলানা ইসলামাবাদী। তাদের মাধ্যমে তখন নানা শাখায় একটা ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে যায়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে তাদের এ সাহিত্য খন্ডখন্ড/ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী নব জাগরণের এখান থেকেই সূত্রপাত বলে মনে করা হয়।
মুসলমান সাহিত্যিকদের এ নব উদ্যোগ দেখে হিন্দু নিন্দুক লেখকদেরও কান খাড়া হয়ে যায় এবং তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, মুসলমানগণও বাংলা জানেন, তাদের সাংবাদিকতার মান আছে। ‘সময়’ নামক একখানা হিন্দু কাগজের ভাষ্য: ‘অতি অল্পদিন পূর্বে মুসলমান বাঙালা হিন্দুর অপাঠ্য ছিল। কিন্তু শিক্ষার উন্নতি সহকারে এখন হিন্দু মুসলমানের লেখা প্রভেদ করা যায় না। মুসলমানগণ সংস্কৃত হিন্দুর ন্যায় খাঁটি বাংলা লিখিতেছেন, ইহা বঙ্গদেশের গৌরবের বিষয়। মুসলমান ভ্রাতাগণ বঙ্গভাষায় ক্রমশঃ বিশেষ অধিকার লাভ করিতেছেন দেখিয়া আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হইতেছি।’
উল্লেখ্য, ১৮৭৭ সালের ৪ জুন সর্বপ্রথম মাওলানা আবদুল খালেক মতান্তরে কাজী আবদুল খালেক সাপ্তাহিক ‘আখবারে মোহাম্মদী’ প্রকাশ করেছিলেন। এটি একযোগে উর্দু ও বাংলা উভয় ভাষায় প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় এর এক পৃষ্ঠায় দুইটি কলাম হতো। একদিকে উর্দু এবং অপর দিকে বাংলা ছাপা হতো। পরবর্তীকালে পত্রিকাটির মালিকানা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর হাতে আসে বলে জানা যায়। তিনি পত্রিকাটির নাম কিছুটা পরিবর্তন করে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ করেন। মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সরাসরি সাংবাদিকতা এখান থেকেই শুরু হয়। বস্তুতঃ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ও দৈনিক আজাদ প্রভৃতির সম্পাদনা-পরিচালনার মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী আলেম সমাজকে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেন। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) তারই দেখানো পথ অনুসরণ করে দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সৃষ্টির ধারায় গতি সঞ্চার করেন।
মাওলানা এম. এ. মান্নান ছিলেন দেশের একজন ক্ষণজন্মা ইসলামী ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ খতিব ও সুবক্তা। পীর পরিবারের এ কৃতি সন্তানের শিক্ষাজীবন সূফি দর্শনের ভিত্তিতে মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাপ্ত হয়। তার মহান পিতা মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইয়াছীন (রহ.) এবং নানা মাওলানা আবদুল মাজীদ (রহ.) উভয় ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর সাহেবের মুরীদ ও খলিফা এবং তাদেরই প্রতিষ্ঠানে মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তার শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর তিনি শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং তার মাদরাসাকে টাইটেল মাদাসায় পরিণত করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
মাওলানা এম. এ. মান্নান ইচ্ছা করলে একজন খাঁটি পীর হিসেবে গদীনশীন হতে পারতেন। কিন্তু তিনি এটা চাননি। কেননা পীর হিসেবে তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠার মনোভাব পোষণ করতেন না। তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল আরো মহান, আরো বিরাট। খাঁটি পীর-মাশায়েখের প্রতি তার গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা ছাড়াও তাদের সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তার অক্লান্ত শ্রম সাধনায় প্রতিষ্ঠিত মসজিদে গাওসুল আজম এবং কাদেরিয়া পাবলিকেশনস তার সেই ভক্তিভাজন মহান পীরেরই পবিত্র স্মৃতির উজ্জ্বল নিদর্শন। মাজহাবের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন খাঁটি হানাফী মতাদর্শের আলেম। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের আজীবন সভাপতি হিসেবে মাদরাসা শিক্ষায় বিস্ময়কর উন্নয়ন ও মাদরাসা শিক্ষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ও মর্যাদাবৃদ্ধি তার অসাধারণ অবদান। একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল তার দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন। এর সফল বাস্তবায়ন তিনি দেখে যেতে পারেননি। তারই সুযোগ্য পুত্র এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে কার্যকর আন্দোলন-সংগ্রামের ফল হিসেবে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-এর অবিস্মরণীয় কীর্তিমালার অন্যতম দৈনিক ইনকিলাব এদেশের আলেম সমাজের মুখপত্র হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী হোক, এ প্রত্যাশা রইল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন