শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

বাম্পার ফলনেও হাসি নেই কৃষকের মুখে

প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অভ্যন্তরীণ ডেস্ক
সাতক্ষীরা ও বগুড়ার গাবতলীতে পুরোদমে শুরু হয়েছে ধান কাটা-মাড়াই। এ বছর ফলন ভালো হলেও ধানের দাম না পাওয়ায় হাসি নেই কৃষকের মুখে। এ সংক্রান্ত আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট-
আবদুল ওয়াজেদ কচি, সাতক্ষীরা থেকে জানান, ‘সাড়ে ৪শ’ টাকার নিচে ধান কাটা শ্রমিক পাইনি। বিঘা প্রতি গড়ে সাড়ে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ। ফলন ১৭ থেকে ১৮ মণ। কিন্তু বাজারে দাম নেই। চিকন চালের বস্তা প্রতি (৬০ কেজি) সর্বোচ্চ দাম এক হাজার ৪০ টাকা। আর মোটা চাল সর্বোচ্চ ৭শ’ চল্লিশ টাকা। আমরা তো আর পারছি না। গত মৌসুমেও লাভের মুখ দেখিনি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না।’ সাতক্ষীরায় চলতি বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম না পাওয়ায় এভাবেই হতাশার কথা ব্যক্ত করছিলেন সদর উপজেলার তুজলপুর গ্রামের কৃষক ফারুক আহমেদ। সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার ৭৩ হাজার ৭৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ ও ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ৪২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আবাদের আওতায় আসে ৭৩ হাজার ৪৪৫ হেক্টর জমি। জেলার তালা উপজেলায় জলাবদ্ধতার কারণে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও বাম্পার ফলন হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু দাম নিয়ে রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছে কৃষকরা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার হরিশপুর গ্রামের কৃষক ইউনুস আলী বলেন, গত বছর নিজের আট বিঘা জমিতে ধান করে ২৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিল। তাই এ বছর এক বিঘা রেখে বাকি জমি ভাগে দিয়ে দিয়েছি। ওই এক বিঘা করতেই নিজের শ্রমসহ ১১/১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে দাম নেই। ধান বিক্রি করবো না। বাড়ি খাওয়ার জন্য রেখে দেব। এভাবে চলতে থাকলে কৃষক বাঁচবে না। কৃষক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সরকার ২৩ টাকা দরে ধান কিনবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। যদি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনে তাহলে হয়তো মোটা ধান চাষিরা কিছুটা হলেও বাঁচতে পারবে। আর তা না হলে সেই লাভবান হবে মধ্যস্বত্বভোগীরা। কিন্তু চিকন চালের ধান চাষিদের বাঁচার পথ নেই। কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা গ্রামের কৃষক জিয়াদ আলী জানান, তিনি ১০ বিঘা জমিতে ব্রি-৫৫ জাতের বোরো ধান চাষ করছিলেন। জমি নিজের হওয়ায় তার বিঘা প্রতি ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধান পেয়েছেন ১৪ থেকে ১৫ বস্তা করে। নিজের পারিশ্রামিক ধরলে লাভের মুখ দেখা যাবে কিনা- সে বিষয়ে সন্দিহান তিনি। একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় এ বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বোরো ধানের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এছাড়া পোকার আক্রমণও কম ছিল। পাকা শুরু হলে কিছু কিছু এলাকায় ধান গাছ শুয়ে পড়েছিল। তাতে তেমন ক্ষতি হয়নি। এজন্য আশানুরূপ ফলন পেয়েছে কৃষকেরা। তবে, দাম নিয়ে হতাশ সকলেই। এদিকে, বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডেজিনাস নলেজের (বারসিক) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত বোরো মৌসুমে উৎপাদনের যাবতীয় খরচ ও নিজের শ্রমমূল্য বাদ দিয়েও প্রত্যেক কৃষককে ২শ’ টাকা করে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে পেশা হিসেবে ‘কৃষি’ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ কাজী আব্দুল মান্নান জানান, চলতি মৌসুমে জেলার ৩ লক্ষাধিক কৃষক বোরো ধানের আবাদ করেছিল। ফলনও খুবই ভালো। কৃষকরা ইতোমধ্যে কোন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই ধান কেটে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। দু, একটি মাঠ বাদে সব ধান ঘরে উঠে গেছে। আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হবে। কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজার দরের বিষয়টি নিয়ে আমাদের করার কিছু নেই। তবে, এবার শুনছি খাদ্য বিভাগ সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে, সেটা হলে হয়তো কৃষকরা লাভবান হবেন।
আল আমিন ম-ল, গাবতলী (বগুড়া) থেকে জানান, বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলায় পুরোদমে শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটা-মাড়াই। ফলে কৃষকের ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। ফলন ভালো হলেও ধানের দাম কমে যাওয়ায় চিন্তিত কৃষক পরিবার। জানা যায়, চলতি মৌসুমে উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন’সহ পৌরসভায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার ৫শ মেট্রিক টন (ধান)। এরমধ্যে উপসী জাতের ১৪ হাজার ৯শ ৫০ হেক্টর জমিতে ও হাইব্রিড জাতের ৩ হাজার ২শ হেক্টর জমিতে ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ইতোমধ্যে অর্জিত লক্ষ্যমাত্রা হয়েছে ১৮ হাজার ১শ ৫০ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের চেয়ে ১শ ৫০ হেক্টর বেশি জমিতে ধান চাষ করা হয়েছে। কৃষি বিভাগ আশা করছেন এ বছরে বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। ফলে উপজেলার গ্রামাঞ্চলে বোরো ধান সংগ্রহে কৃষক-কৃষানিরা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দিনমজুর সংকটসহ মূল্যেবৃদ্ধি পেলেও কৃষক পরিবারগুলো এখন দম ফেলানোর সময় নেই। কৃষকের আঙ্গিনাজুড়ে এখন মৌ-মৌ গন্ধে মুখরিত। নবান্ন উৎসবে মেতে উঠেছে কৃষক পরিবার। সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, এখন কৃষকরা বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কাগইল কৈঢোপ গ্রামের কৃষক আলমগীর, নজরুল, হিজলী গ্রামের আইযুব জানান, এ বছরে পরিবেশ অনুকূল ও ধান ক্ষেতে পোকা মাকড়ের আক্রমন কম থাকায় বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শে বোরো ধান চাষ ও উৎপাদন বেড়েছে। ধানগাছে পোকা থেকে রক্ষা করতে পাচিং ও আলোক ফাঁদ পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন কীটনাশক ছাড়াই পোকা দমন করা সম্ভব হয়েছে। পীরপাড়া গ্রামের কৃষক বুলু, দড়িপাড়া গ্রামের রফিকুল ও আমজাদ জানান, প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২৪ মণ ধান পেয়েছি। এখন ধানের ন্যায্যমূল্য পেলেই আমরা খুশি। তাই তারা বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কৃষি অধিদপ্তরের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। গাবতলী উপজেলা কৃষি অফিসার আ. জাঃ মুঃ আহসান শহীদ সরকার জানান, কৃষি বিভাগের পক্ষে থেকে সার্বক্ষণিক পরামর্শের ফলে এ বছরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছেড়ে যাবে। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাগণ ধান গাছের রোগবালাই দমনে কৃষকদের তথ্য ও পরামর্শ দিচ্ছেন। আশাকরছি আগামীদিনে বোরো ধান চাষ ও উৎপাদন আরো বাড়বে। এছাড়াও কৃষক ধানের বাম্পার ফলনের জন্য ক্ষতিকারক পোকা নিধনে আলোক ফাঁদ ও পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নাজমুল হক ম-ল জানান, উপজেলাজুড়ে পুরোদমে কৃষকরা বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছে। এ বছরে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। কাগইল ইউনিয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাহেদুর রহমান জাহিদ ও জান্নাতুন মহল তুলি জানান, কৃষি বিভাগের সহযোগীতায় আমরা সবসময় কৃষকদের পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে আসচ্ছি। ফলে গাবতলীতে বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। গাবতলী উপজেলা উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. জুলফিকার হায়দার ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম ও ডিএস তনশ্রী জানান, সারের সংকট ছিল না। এছাড়াও গাবতলী ইছামতি নদীতে জেগে উঠা জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। ফলে এ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে কৃষক বোরো ধান চাষ করেছে। এখন কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন