আজকের কলামটি লেখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির কয়েকটি অতি সাম্প্রতিক বক্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি লেখার জন্য উৎসাহিত হয়েছি। নিজের মনের ভেতর তাগাদা অনুভব করেছি। কলামে কিছু কথা প্রিয় এবং কিছু কথা অপ্রিয় হতেই পারে। আলোচনাটি দীর্ঘ হতে পারে। এমনকি পরবর্তী কলামেও সম্প্রসারিত হতে পারে।
গত ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর মিডিয়ার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। পরের দিন কয়েকটি পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে যে শিরোনাম ছিল, সেগুলো হুবহু উদ্ধৃত করছি। যুগান্তরের শিরোনাম ছিল, ‘জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ: বিভেদ ভুলে জাতীয় ঐক্যের ডাক’। ইনকিলাবের শিরোনাম, ‘জাতির উদ্দেশে ভাষণে শেখ হাসিনা: এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য’। যুগান্তর পত্রিকা থেকে আবার খবরের অংশ উদ্ধৃত করছি, ‘প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি’। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দু’টি ভিন্ন অংশ থেকে (অর্থাৎ মাঝখানের অনেক কথা বাদ দিয়ে) আরো কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। ‘আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে হিংসাবিদ্বেষ হানাহানি থাকবে না। সব ধর্ম বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সবাই নিজ নিজ ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করতে পারবেন ... আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়-পরিজনকে হারিয়ে আমি রাজনীতি করছি শুধু জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য; এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। এ দেশের সাধারণ মানুষেরা যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারে, উন্নত সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হতে পারে, তা বাস্তবায়ন করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।’ এ ভাষণ শুনে বা পড়ে আমি যতটুকু বুঝলাম, সরকারের অগ্রাধিকারগুলো এরূপ: এক. সরকার সব নাগরিকের জন্যই কাজ করবে। দুই. সরকারি সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিন. জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখা হবে। চার. দুর্নীতি দমন করা হবে। পাঁচ. ১.৫ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর পুরো ভাষণের মধ্যে এই অংশটুকু অধিকতর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
বুধবার ৩০ জানুয়ারি অপরাহ্ণে,একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে রেওয়াজ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিয়েছেন। সেই ভাষণ থেকে কিছু কথা ৩১ জানুয়ারি প্রধান পত্রিকাগুলোতে হুবহু উদ্ধৃত করা হলো। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় শিরোনাম ছিল, ‘সংসদ ভাষণে রাষ্ট্রপতি: জাতীয় ঐকমত্য চাই সব বিষয়ে’। যুগান্তরে শিরোনাম ছিল, ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য চাই জাতীয় ঐকমত্য’। ইনকিলাবের শিরোনাম ছিল, ‘সব বিষয়ে চাই জাতীয় ঐকমত্য’। পত্রিকার ভাষ্যমতে, রাষ্ট্রপতির কথাগুলো ছিল এরূপ: ‘জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ পেতে পারে না। গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাই।’ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বক্তব্য থেকে যে কথাগুলো উদ্ধৃত করেছি, সেই কথাগুলোর প্রেক্ষাপটে, আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।
জাতীয় ঐক্যের আহ্বান আরো বহুবারই দেয়া হয়েছে। প্রায় আড়াই বছর আগে যখন ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান নামক রেস্টুরেন্টে মারাত্মক সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছিল, সেই সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তথা বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার এটিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেনি। আনুমানিক দেড় বছর আগে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এ দেশে আগমন শুরু, তখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া জাতীয় ঐক্যের তথা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমস্যা মোকাবেলার আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক সরকার এবারো সেটিকে আমলে নেয়নি। দুই-দুইবার কেন আমলে নিলেন না সেই প্রশ্ন আলোচনার দাবি রাখে; কিন্তু আজ সে আলোচনা করব না স্থানের অভাবে। কিন্তু এবার ২৯-৩০ ডিসেম্বরের বিতর্কিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর যখন আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটকে এবং দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র প্রেসিডেন্ট এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ‘ট্রিটমেন্ট’ (চিকিৎসা) দিচ্ছে, সেখানে হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি উভয় কর্তৃক জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানোর প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কোনো প্রকার অনাকাক্সিক্ষত সন্দেহ পরিহার করার জন্য আমি বলে রাখছি, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বা জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে প্রশ্ন করছি না; এই আহ্বানকে আমি সমর্থন করি। প্রশ্ন করছি আহ্বান জানানোর প্রেক্ষাপটকে। নয়-দশ দিন আগে, প্রথম আলো পত্রিকার ৯ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি কলাম ছাপা হয়েছিল। কলামটির শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ নিয়ে চীনের ভাবনা ও দুর্ভাবনা।’ মূলত ২৯-৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরপরই রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিকভাবে চীন কর্তৃক বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে গিয়ে লেখক অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ চীন বাংলাদেশকে কোন কূটনৈতিক দৃষ্টিতে দেখছে, কোন অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখছে, কোন ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখছে এবং চীন তার বহুমুখী লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন ধরনের রাজনৈতিক সরকার এবং কোন ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ কামনা করে ইত্যাদি বিষয়ে ওই কলামে আলোচনা করা হয়েছে। কলামের লেখক হলেন ডক্টর খলিল উর রহমান; যিনি জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের নির্বাহী অফিসে অর্থনৈতিক-সামাজিক ও উন্নয়নবিষয়ক বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান। মূল কলামটি ছিল ইংরেজিতে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে বাংলা অনুবাদ; নিঃসন্দেহে এটা প্রাঞ্জল ও স্বচ্ছ। অন্যান্য বিশ্লেষক তাদের মতামত অবশ্যই দেবেন, আমার দৃষ্টিতে ওই কলামের মধ্যে অনেক কিছুই বলা হয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে মিলে যাচ্ছে। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় অর্থাৎ জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির প্রেরণাও চীনের কাছ থেকে এসেছে বলে আমার মনে হয়। কারণ, চীনের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ওইরকমই একটি সরকার দরকার যে রকম শেখ হাসিনা অতি সম্প্রতি তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন এবং উপস্থাপিত সরকার তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে যদি নিরঙ্কুশ, আপদ-বিপদহীন ও নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বাদানুবাদ, তর্কবিতর্ক, মতপার্থক্য ইত্যাদি মিনিমাইজ করতে তথা জিরো টলারেন্সে আনতে হবে। সেজন্যই জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে আপাতত দৃষ্টিতে যেমন প্রয়োজনীয় ও নির্মোহ মনে হচ্ছে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক তথা সরকার ব্যবস্থা কোন দিকে যেতে পারে, তার ইশারাও প্রকাশ পাচ্ছে।
আমি জাতীয় পর্যায়ে অনেক উচ্চস্তরের রাজনৈতিক নেতা নই। রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয় সেটি মোতাবেক, আমি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। বিনীতভাবে বললে, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী। আমার রাজনৈতিক পরিচয় শুরু হয়ে হয়েছে ৪ ডিসেম্বর ২০০৭। কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা এবং রাজনৈতিক লেখালেখির শুরু ১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে। এরকমই, আমার উপস্থাপিত একটি জাতীয়-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও আহ্বানের প্রসঙ্গ আনছি। ১০ এপ্রিল ১৯৯৯, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ নামক একটি প্রাইভেট থিংক ট্যাংকের উদ্যোগে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছিল। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’। ওই সভায় মূল প্রবন্ধ বা কী-নোট পেপার উপস্থাপন আমি করেছিলাম। পরের দিন ১১ এপ্রিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এই আলোচনা সভার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদ প্রকাশের সময় প্রবন্ধটির একটি ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদ প্রায় সব বড় পত্রিকা হুবহু উদ্ধৃত করেছিল। ওই ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদটি এখানে আবার উদ্ধৃত করছি।
উদ্ধৃতি শুরু। এখন সময়ের ডাক হচ্ছে জাতীয় সমঝোতার। সব ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠির অংশ যার যার ভুলগুলো স্বীকার করুক। প্রয়োজনে এই ভুলের জন্য ক্ষমা চাক। এরপর আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে আগামী শতাব্দীতে প্রবেশ করব। কারণ মানুষেই ভুল করে। ভুলের জন্য অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনায় কোনো লজ্জা নেই। এখন থেকে সাড়ে ১১ মাস পূর্বে যে নতুন শতাব্দীর কথা বলছিলাম, আমরা সেই নতুন শতাব্দীর প্রায় এক বছর শেষ করছি। কিন্তু জাতীয় সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই। আমি নিজেও বুঝি- সমঝোতা অর্জন কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তথাপি এই ধারণাকে বা উদ্যোগকে ফেলে দিলে চলবে না। উদ্ধৃতি শেষ। যে কথাগুলো এই অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত করলাম, একই কথাগুলো তথা ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদ আমি ১৪ ডিসেম্বর ২০০১ সালে দৈনিক ইনকিলাবে ঈদ ও বিজয় দিবস সংখ্যার ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপানো আমার একটি কলামে উদ্ধৃত করেছিলাম। ওই কলামের শিরোনাম ছিল, ‘আত্মসমালোচনা ও সমঝোতার আহ্বান’। অর্থাৎ ১০ এপ্রিল ১৯৯৯ যে কথাগুলো সিরডাপ মিলনায়তনে বলেছিলাম, যে কথাগুলো ১১ এপ্রিল ১৯৯৯ বড় বড় পত্রিকার সংবাদের মাঝখানে উদ্ধৃত হয়েছিল, যে কথাগুলো ১৪ ডিসেম্বর ২০০১ পুনরায় লিখে ব্যাখ্যা করেছিলাম, সেগুলোই আজ পুনরায় উদ্ধৃত করলাম এবং পরবর্তী পাঁচশ’-ছয়শ’ শব্দের মধ্যে তার একটু ব্যাখ্যাও দেবো। এত কথা লিখতাম না, এত ব্যাখ্যাও দিতাম না, যদি প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি জাতীয় ঐক্যের কথা বা জাতীয় ঐকমত্যের কথা উচ্চারণ না করতেন।
প্রধানমন্ত্রী গত ২৫ তারিখের ভাষণে বলেছেন, এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তার ভাষণে তিনি নিজেই ‘জাতীয় ঐক্যের যোগসূত্র’ হিসেবে পাঁচটি আঙ্গিক উল্লেখ করেছেন; যেগুলো এই কলামেরই উপরের একটি অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত করেছি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উল্লিখিত পাঁচটি যোগসূত্রের মধ্যে প্রথমটিই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তৃতীয় আঙ্গিক হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, চতুর্থ আঙ্গিক হলো সাম্য ও ন্যায়বিচার। অতএব মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রেক্ষাপটে, জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে বিশ্লেষণ করা যুক্তিসঙ্গত। পরবর্তী দীর্ঘ অনুচ্ছেদে এটি আছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই বিচ্ছিন্ন কোনো এক দিনের ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রথম ঐতিহাসিক তারিখ ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি। আমাদের বয়সীরা যখন মায়ের কোলের শিশু, সেই সময় তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সৃষ্ট বিতর্কই স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম প্রেক্ষাপট। আজ সমগ্র বিশ্ব স্বীকার করছে ২১ ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য। ১৯৫২ সালের পরে আরো বহু ঘটনা ঘটেছে। তদানীন্তন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্তান নামক প্রদেশের জনগোষ্ঠির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানিরাই ছিল শাসকের ভূমিকায়। তারা দেশের শাসনকার্য কল্যাণমূলকভাবে মোটেই করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠি তথা বাঙালিদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও দাবি আদায়ের আন্দোলন ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিশেষত ১৯৬০ সালের পর থেকে এই আন্দোলন ধীরে ধীরে গতি অর্জন করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সাল থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব এসে যায় তৎকালীন আওয়ামী লীগের হাতে। ১৯৬৮ সাল থেকে এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে চিহ্নিত হন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা (ও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিবুর রহমান। পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো মহৎ অর্জনের পেছনে সুদীর্ঘ সংগ্রামের পটভূমি আছে। অনুরূপভাবে, বাংলাদেশের সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট হিসেবে ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সালকে অনায়াসে চিহ্নিত করা যায়। এই সময়কালের শেষাংশে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, যদিও সে আমলের অন্যতম প্রধান জাতীয় নেতা হিসেবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও উজ্জ্বল ছিলেন। কিন্তু যেকোনো কারণে বা পরিস্থিতিতেই হোক, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখের প্রথম প্রহরে সৃষ্ট মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রথম ঘটনা রাজধানী ঢাকাতে ঘটেনি এবং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেও হয়নি। এটি ঘটেছিল বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।
৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ কার্যত সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল; কিন্তু স্বাধীনতার যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক বা প্রত্যক্ষ ঘোষণা তাতে ছিল না। তবে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চাকরিরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালিদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বা মাঝারি পর্যায়ের অফিসাররা যেমন ছিলেন সতর্ক, তেমনি ছিলেন সক্রিয়। বহু দিনের লালিত স্বাধীন দেশের চিন্তা, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উজ্জীবনী প্রেরণা ইত্যাদির ফলে তারা তখন নিজেদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বহু গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন এবং আলোচনা চালাতেন। তখনকার পরিস্থিতি ছিল গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে যেন একটি উত্তপ্ত বারুদের স্তূপ, বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য শুধু একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি ও স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটেই, ১৯ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকা মহানগরের অদূর উত্তরে অবস্থিত জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং স্থানীয় জনগণ সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। এই প্রেক্ষাপটেই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ সর্বত্র একযোগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং যুদ্ধ শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটে, তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, জ্যেষ্ঠতম বাঙালি অফিসার তথা উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে, ২৫ মার্চ দিনের শেষে অর্থাৎ ২৬ মার্চ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ২৫ তারিখ দিনের শেষে রাতে, প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেননি অথবা তিনি ঘোষণা করে থাকলেও সেটা সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছেনি। অনুরূপভাবে, চট্টগ্রামের ষোলোশহর, ঢাকার জয়দেবপুর, কুমিল্লায়, উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর, চুয়াডাঙ্গায়, যশোর ইত্যাদি এলাকায় সেনাবাহিনী বা তৎকালীন ইপিআরের বাঙালি বা পুলিশ সদস্যরা যে বিদ্রোহ করেছিলেন তথা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, সেই সংবাদ দেশব্যাপী সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছেনি। এই প্রেক্ষাপটেই ২৭ মার্চ ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণা আসে রেডিওর মাধ্যমে এবং সেটি আসে চট্টগ্রাম মহানগরের কাছে অবস্থিত কালুরঘাট বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে। তিনি প্রথমে নিজের নামে ঘোষণা দিয়েছিলেন, পরে সুবিবেচিত ও সংশোধিত ভাষ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসাররা।
এ কথাও ঠিক যে, পূর্ববর্তী ২০ বছরের (১৯৫২-৭০) সংগ্রামী প্রেক্ষাপট যদি না থাকত, তাহলে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও বা মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানালেও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতো কি না কিংবা স্বাধীনতা আসত কি না সেই কথাটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এ প্রসঙ্গে একটি সাংসারিক উদাহরণ দেয়া যাক। কোনো কিছু ভাজার আগে তাওয়া বা সসপেন অবশ্যই গরম করে নিতে হয়। রুটি সেঁকার আগে তাওয়া গরম না করলে রুটি কাঁচা থেকে যাবে। গরম তাওয়ায় রুটি দিলে ভালো সেঁকা হবে এবং রুটি ফুলে উঠবে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ সময়কালে ‘তাওয়া’ যথাযথভাবে গরম হয়েছিল বলেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ সকালে রুটি সেঁকা সহজ হয়েছিল। অন্য দিকে তাওয়া যদি অধিককাল গরমই হতে থাকে, এতে কোনো কিছু সেঁকা না হয়, তাহলে ধোঁয়া উঠতে শুরু করবে। পেঁয়াজু বা বেগুনি ভাজার আগে তেল গরম করে নিতে হয়। যদি সময়মতো কাঁচা পেঁয়াজু বা কাঁচা বেগুনের টুকরো তেলের মধ্যে না দেয়া হয় তাহলে অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কারণে তেল পুড়ে ধোঁয়া বেরুবে। ২৪, ২৫, ২৬ বা ২৭ মার্চের সময়টি ছিল ওই মাহেন্দ্রক্ষণ, যে সময় উত্তপ্ত তেল সেদ্ধ হচ্ছিল। সেই উত্তপ্ত তেলে কাঁচা পেঁয়াজু বা কাঁচা বেগুনের টুকরো দিতেই হবে। না দিলে রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভরে যাবে তথা জনগণের সব আশা-ভরসা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান তথা পরবর্তী পরিচয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, আসলে ঠিক সেই গুরুদায়িত্বই পালন করেছিলেন; অর্থাৎ উত্তপ্ত তেলে বেগুনের টুকরো ঢেলে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, যখন সমগ্র বিশ্ববাসী এবং দেশবাসী প্রকাশ্য ঘোষণার জন্য আকাশপানে তাকিয়ে আছে, এই ঘোষণা শোনার জন্য অন্তর ছটফট করছে কিন্তু ঘোষণা আসছিল না, ঠিক তখনই তৎকালীন মেজর জিয়া ঘোষণাটি বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেন। ওই ঘোষণাটির রণকৌশলগত এবং রাজনৈতিক কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যের জন্য যে যোগসূত্র উল্লেখ করেছেন, সেখানে সর্বপ্রথমে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই চেতনা এখন পর্যন্ত এমন কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি যেটা শতভাগ আলোচনার বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গেও আলোচনা আসবে। তাই যে আলোচনা আজ শুরু করলাম সেটা আগামীতেও করার ইচ্ছা করছি।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
mgsmibrahim@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন