শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বছরে বেকার বাড়ছে ৮ লাখ

সিপিডির সেমিনারে বক্তারা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় প্রতিবছর নতুন করে আট লাখ বেকার তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে প্রবৃদ্ধির সুবিধা সমানভাবে বিতরণ না হওয়ায় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। একই সঙ্গে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে পাশাপাশি গড়ে উঠছে প্যারালাল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। স্কুলের বাইরে কোচিং সেন্টার, গাইড পড়ে শিক্ষাগ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। আর চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালের পরিবর্তে ক্লিনিকে সেবা নিতে বাধ্য করছেন। এগুলোর লাগাম টানতে হবে। এসবক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নে নতুন সরকারের প্রাধিকার’ শীর্ষক সংলাপে বক্তারা এসব কথা জানান। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত এ সংলাপে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সিপিডির চেয়ারপার্সন ড. রেহমান সোবহান, সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সংলাপের মূল প্রবন্ধে বলা হয়, গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হলেও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বৈষম্যের চিত্র উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর দুই লাখ মানুষ শ্রম বাজারে ঢুকছে, বিপরীতে চাকরি তৈরি হচ্ছে ১ লাখ ৩০ হাজার। সেক্ষেত্রে প্রতিবছর আট লাখ মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। প্রবৃদ্ধির সুবিধা সমানভাবে বিতরণ না হওয়ায় বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে।
তবে অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, মানুষের আয় বাড়ায় তারা বিকল্পভাবে এসব সেবা নিচ্ছেন। এম এ মান্নান বলেন, গরীব পিতার মত দৈনন্দিন বাজারের রাজনীতি করি। মূল সমস্যা দারিদ্র্য। এটি হয়েছে অবিচার থেকে। দারিদ্র-ক্ষুধা সবার আগে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কাজ করতে গেলে পেছনে ক্ষুধার নেকড়ে বাঘ আমাদের তাড়া করে। এই তাড়াহুড়া করতে গিয়ে অনেক কাজ করতে হয়। এজন্য কিছু ভ‚লভ্রান্তি হচ্ছে।
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাচ্ছে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে। আমরাও চাই ন্যাযতা সমতা প্রতিষ্ঠিত হক বৈষম্য দূর হোক।
পরিকল্পনা মন্ত্রী আরও বলেন, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক করেছি। সেখানে ৩০-৩৫ রকম ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। কিছু দুর্নীতি হচ্ছে না তা নয়। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি নেবো। মানুষের চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে এটি ঠিক আছে। কারণ মানুষের আয় বেড়েছে। তাই তারা সরকারি হাসাপাতালে না গিয়ে ভালো চিকিৎসার জন্য অন্য জায়গায় যাচ্ছে। উন্নত দেশেও তাই। ব্যয় বেড়েছে এটি আমি স্বীকার করছি।
কোচিং সম্পর্কে তিনি বলেন, আমেরিকার মত দেশেও কোচিং শিক্ষা আছে। সেখানে আমার নাত-নাতনীরা পড়ে। তবে তাদের কাঠামো অনেক গোছালো। এখন গ্রামের মানুষে বিদেশে কাজ করে আয় করছে। তাদের আয় তারা খরচ করবে আমি ঠেকাবো কিভাবে। সন্তানকে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর আগ্রহ থেকে তারা ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছেন।
রেহমান সোবহান বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমছে। শিক্ষা বাড়ছে কিন্তু গুণগত শিক্ষা কমছে। এটা নিশ্চিত করে অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম নির্দেশক। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। এটি দূর করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর পিতার চিকিৎসা হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। এখন অনেকেই তাদের স্বজন চিকিৎসা করান অ্যাপোলো, স্কয়ার অথবা বিদেশে। কিন্তু গরীব মানুষ সেখানে যেতে পারেন না। সবার জন্য সমান স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষার হার বাড়লেও গুণগতমান বাড়ছে না। সিলেবাসের দুর্বলতার কারণে শিক্ষা জীবন শেষেও অনেকে ভালো করে ইংরেজি লিখতে পারেন না। অপ্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক থাকলেও নৈতিক শিক্ষার সুযোগ কম। শিক্ষ্যবাবস্থা কোচিং বাণিজ্য বা শ্যাডো শিক্ষা চালু হয়েছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। সবার শিক্ষা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। ঝড়ে পড়া বিশেষ করে ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও সহিংসতা বন্ধ করা গেলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গত কমপক্ষে ২ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব।
তিনি বলেন, ভারত শিক্ষাআইন তৈরি করেছে। এখানে করত হবে। এখনই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করে প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্লাসরুমের বাইরে কোচিং, প্রাইভেট টিউটরের পড়ালেখ বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা জরুরী।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশে উন্নয়ন হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নকে নির্বাচনী ইশতেহারে রাখা হয়েছে। ইশতেহার তৈরি করা হয় রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে। এখানে কিছু ত্রুটি থাকলে গেলো গেলো সব গেলো রব উঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে বিনিয়োগ করেছে আগের কোন সরকার এটি করেনি। সারাবিশ্বে উন্নয়নের জন্য আমরা প্রশংসিত। শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ জনবল তৈরি না হলে এই উন্নয়ন কিভাবে হলো?
তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিকদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। তবে সবকিছু রাজনীতিকরণ ঠিক হবে না। আগে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সরকারের থাকাকালে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও উন্নয়নের রাজনীতি করি। কথায় কথায় শিক্ষকরা আন্দোলন করেন। আমরা সবার কথা শুনতে চায়। কিন্তু শোনার মত সময় দিতে হবে। আমাদের পরিকল্পনা সকলকে সাথে নিয়ে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলেন, উন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আমরা যা বলি তা বিশ্বাস করি না। গ্রাম হবে শহর এটি বলা হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতভাবে কিভাবে করা হবে তার নির্দেশনা নেই। শিক্ষায় ব্যবস্থায় শুধু পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা নিজের নাম ও জেলার নাম সঠিকভাবে লিখতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবছর ৩৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। কিন্তু এতে শিক্ষা হ্েছ না বিকল্প গাইড কেনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, উন্নয়নের জন্য সুশাসন প্রয়োজন। সুশানের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস। জামিনযোগ্য মামলা নিষ্পত্তি না করে তাই হাইকোর্টে পাঠিয়ে মামলার জোট তৈরি করা হচ্ছে। আইনি বহির্র্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধে নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিলেও আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে এখনও এটি হচ্ছে।
তিনি বলেন, চিকিৎসকরা সরকারি টাকায় লেখাপড়া করে মানুষকে সেবা করতে চাননা। তারা বৃহস্পতিবার কর্মস্থল ত্যাগ করে পরের সপ্তাহের সোমবার আবার আসেন। জেলা অফিসের অন্য কর্মকর্তারা কর্মস্থলে থাকলেও তাদের স্ত্রী সন্তান ঢাকায় থাকেন। চিকিৎসকরা ওএসডি হলে খুশি হন আইনের মধ্য থেকে প্রাইভেট প্রাকটিস করান।
বক্তারা আরও বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নজর দেয়া দরকার। প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থা চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও তা ব্যবহারে স্বচ্ছতা নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা’র আধুনিকীকরণ না হলে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার দিকটি সামনে আনা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন