বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

জামায়াত থেকে আমাকে বহিস্কার করা হয়েছে অনলাইন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ২:২১ পিএম

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে দলটির ঢাকা মহানগরীর নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুকে। ফেসবুকের ব্যক্তিগত টাইমলাইনে দেয়া এক স্ট্যাটাসে শিবিরের এই সাবেক সভাপতি নিজেই এ কথা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মঞ্জু তার দীর্ঘ স্ট্যাটাসে দলে তার ভূমিকা, বহিস্কারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদান, নেতৃত্বে আসা এবং সংগঠনটির কার্যপরিচালনায় আবেগময় স্মৃতিচারণ করেছেন। এছাড়া স্ট্যাটাসে তিনি শিবির থেকে জামায়াত যোগদানের পর তার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। সর্বোপরি, তিনি দীর্ঘদিনের চলার সাথীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।

নিচে তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো--
গতকাল ১৫ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার, আনুমানিক রাত সাড়ে সাতটার দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত আমীর জনাব মকবুল আহমদের পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য আমাকে জানান যে আমার দলীয় সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে।
বেশ কয়েক বছর যাবত সংগঠনের কিছু বিষয়ে আমি দ্বিমত করে আসছিলাম। মৌখিক ও লিখিতভাবে বৈঠকসমূহে আমি প্রায়ই আমার দ্বিমত ও পরামর্শের কথা সম্মানিত দায়িত্বশীলদের জানিয়েছি।

আভ্যন্তরীণ ফোরামের পাশাপাশি আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ্যেও আমি আমার ভিন্নমত প্রকাশ করে এসেছি।

আমি যেহেতু সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করি এবং প্রকৃতিগত কারণে আমাকে নানা ধরনের আড্ডা, ঘরোয়া আলোচনা, সেমিনার এ অংশ নিতে হয়। সেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন-পরিবর্তন প্রসঙ্গে আমি অনেক জায়গায় খোলামেলা মত প্রকাশ করে থাকি। এসব আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে মিসর, মালোয়েশিয়া, তুরস্ক, তিউনিশিয়ার ইসলামী ধারার রাজনীতির উত্থান পতন ও বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো উঠে আসে। জামায়াতে রাজনৈতিক সংস্কারের যৌক্তিকতা, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা প্রসঙ্গে আমার সুস্পষ্ট মত ছিল যে, জামায়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার এরূপ খোলামেলা মত নিয়ে জামায়াতের সম্মানিত নেতৃবৃন্দের মাঝে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী হয়।

বছর কয়েক আগে শিবিরের সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল শিশির মুহাম্মদ মনিরের মোবাইল ফোন হ্যাক করে পুলিশ তুরস্কের গুলেন মুভমেন্ট সংক্রান্ত একটি মতামত জাতীয় মেসেজ পায়। যার ভিত্তিতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য তার বাসায় অভিযান চালায়। শিবিরের সাবেক সভাপতি জাহিদুর রহমান ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের কৌশলী আসাদ উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন সংবাদপত্রে এ নিয়ে একটি বানোয়াট রিপোর্ট ছাপা হয়। রিপোর্টে গুলেন মুভমেন্টের আদলে বাংলাদেশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রকারী ও পরিকল্পপনাকারী হিসেবে আমিসহ ১১ জনের একটি কল্পিত বৈঠকের বর্ণনা করা হয়। এর ভিত্তিতে আমাদের সকলের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রবিরোধী (সেডিশন) মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। তখন আমি গ্রেপ্তার ও পুলিশি নির্যাতন এড়ানোর জন্য আত্মগোপনে চলে যাই। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আমি জানতে পারি যে, সংগঠনের উর্ধতন দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলা ও অধস্তন শাখাগুলোতে আমিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে একটি মৌখিক সার্কুলার জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আমি গুলেন মুভমেন্টের আদলে একটি ভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি, অতএব আমার কথাবার্তা ও কার্যকলাপে জনশক্তি যাতে বিভ্রান্ত না হয়। তারা যাতে আমাকে এড়িয়ে চলে।

আমি জামায়াতের একজন সদস্য অথচ আমার কাছ থেকে কিছু জানতে না চেয়ে, আমাকে জবাবদিহির আওতায় না এনে বা আমি যদি দোষ করে থাকি সে বিষয়ে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে আমার বিরুদ্ধে সার্কূলার জারি করায় আমি এর প্রতিকার চেয়ে আমীর বরাবর আবেদন জানাই। তথ্য প্রমাণসহ আমার স্পষ্ট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের সম্মানিত আমীর, সেক্রেটারী জেনারেল, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী জেনারেল, মহানগরী আমীরসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে আমাকে নিয়ে বসেন। তারা আমাকে জানান যে, বিষয়টা নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে আমি যেরকম সার্কুলারের কথা শুনেছি বিষয়টা তা নয়। তারা আমাকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা বা ঘরোয়া সেমিনারে কিংবা ফেসবুকে আমি পরোক্ষ পন্থায় যে ধরনের খোলামেলা মত প্রকাশ করি তা শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্র বিরোধী। আমি লিখিতভাবে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করি ও তাদের অভিযোগ খন্ডণ করি। বিনয়ের সঙ্গে জানাই যে, আমি সংগঠনের আভ্যন্তরীন নানা অনিয়ম ও সংস্কার প্রসঙ্গে সংগঠনের ফোরামে আমার সুস্পষ্ট মত-দ্বিমত উল্লেখ করি। কিন্তু জনসম্মুখে আমার সকল মত পরোক্ষ। তাতে শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্রের কোন লঙ্ঘন হয় না। তাছাড়া আমি সংগঠনের পদস্থ কোন দায়িত্বশীলও নই।

তারা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি আয়োজিত ‘চলমান রাজনীতি ও আগামীদিনের বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে আমার উপস্থাপিত একটি প্রবন্ধ সেখানে প্রমান হিসেবে হাজির করেন। যাতে আমি বলেছি, বাংলাদেশে সেকুলার, গণতন্ত্রী ও ইসলামী সব রাজনৈতিক দল ব্যর্থ হতে চলেছে। তৃতীয় শক্তি নামে যারা এসেছে তাদের প্রতিও জনগণের কোন আস্থা নেই। ফলে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের উন্মেষ অপরিহার্য যারা মানবাধিকার, সুশাসন ও ন্যায়ভিত্তিক আধুনিক বাংলাদেশ উপহার দিতে পারে। যারা হবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধে অনুপ্রাণিত কিন্তু ধর্মীয় দল নয়। যে দল হবে গণমুখী ও আপাত: উদারনৈতিক। এই প্রবন্ধে ইসলামী রাজনৈতিক দল ব্যর্থ হতে চলেছে মর্মে আমি যে, বিশ্লেষণ দিয়েছি সে ব্যপারে তারা আপত্তি তোলেন।

জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হয়ে একটি প্রকাশ্য সভায় ইসলামী দল ব্যার্থ হতে চলেছে এরকম মত দিতে পারি কিনা তারা সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি যে, এখানে আমি সামগ্রিকভাবে ইসলামী দলগুলোর কথা বলেছি, জামায়াতের নাম সুস্পষ্টভাবে বলিনি। তাছাড়া এটা একটা ঘরোয়া সেমিনার এবং এতে রাষ্ট্র ও রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি বক্তব্য দিয়েছি। জামায়াতের নেতা বা কর্মী হিসেবে মত প্রকাশ করিনি। আমি শুধু জামায়াতের সদস্য নই, রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিকও বটে। আমি যখন জাতীয় রাজনীতির কথা বলবো তখন সব মত পথ ও মতাদর্শের রাজনৈতিক কথাই বলতে হবে। আমি প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বিএনপির সমলোচনা করতে পারবো, কিন্তু নিজেদের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাব তা কীভাবে সম্ভব। আমিতো ইসলামী রাজনীতির গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে অনেক ইতিবাচক কথা বলেছি। কিন্তু আত্মসমলোচনামূলক বিষয়গুলো এড়িয়ে গেলে আমার মতটাতো একপেশে হিসেবে গণ্য হবে। অতএব আমি মনে করি এ জাতীয় মতপ্রকাশে কোন সমস্যা নেই।ৎ

যাই হোক, নেতৃবৃন্দ আমার সব কথা শোনার পর স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, জামায়াতের একজন সদস্য হিসেবে এরকম মত প্রকাশ করার সুযোগ নেই। এটা শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কাজ। তারা আমাকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করি এবং আমার অবস্থানে অটল থাকি।

আমি ভেবেছিলাম এই স্পর্ধা ও মতামতের পর নেতৃবৃন্দ আমার ওপর চরমভাবে অসন্তুষ্ট হবেন এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা স্বরুপ আমার সদস্যপদ বাতিল করবেন। কিন্তু তারা আমার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল, উদার ও দরদী আচরণ করেন। তারা আমাকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিশ্বস্ত কাজে সংযুক্তও করেন। সদ্য সমাপ্ত ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ নিয়ে আমার দ্বিমত ছিল। তারপরও নির্বাচনের পূর্বে আমি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জাতীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়, সংলাপ, বৈঠকসহ একটি নির্বাচনী আসনে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেছি।

নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আমি কিছু স্বাধীন মত প্রকাশ করি। যাতে আমি সরকারের নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি ও বিরোধী জোট এবং দলগুলোর সমলোচনা করি। রাজনৈতিক দলের নেতাদের দায় স্বীকার করে পদত্যাগের আহবান জানাই। শুধু তাই নয়, আমি নিজের দায় থেকেও অক্ষমতা অপারগতার জন্য ক্ষমা চাই।

সম্প্রতি গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি’২০১৯ তারিখে আমি ফেসবুকে ‘তরুণ ও তরুণোর্ধদের নতুন রাজনীতি’ নামে একটি স্ট্যটাস দিই। যাতে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাবনাময় তরুণদের তাদের দলমতের গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সংগঠিত করার আহবান জানাই। এ আহবানে অনেকেই উৎসাহ বোধ করেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন দলীয়, নির্দলীয়, আমার পরিচিত বন্ধু স্বজনদের কৌতুহ তৈরী হয়। ফেসবুকে নামে বেনামে বিভিন্ন আইডি থেকে আমি জামায়াত ভেঙ্গে নতুন দল করছি বলে প্রচারণা চলতে থাকে।

গত কয়েক সপ্তায় আমি ব্যক্তিগত বা পেশাগত কাজে যেখানেই গিয়েছি আমার বন্ধু স্বজনদের অনেকেই এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়ে কথা বলেন। কেউ কেউ তাদের নিজস্ব বন্ধু সার্কেলে আমাকে দাওয়াত দেন। আমি সিলেট ও ঢাকার উত্তরায় এ রকম দুটি সার্কেলে যোগদান করি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলি। সেসব আলোচনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, ঐক্যফ্রন্ট সকল বিষয়েই আলোচনা হয়। আমি আমার মত ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করি। আমি জানতে পারি যে, ফেসবুকের নানা প্রচারণা ও আমার এসব মত প্রকাশে জামায়াতের দায়িত্বশীলগণ পূণরায় অসন্তোষ বোধ করছেন এবং আমার গতিবিধি চলাচল মনিটরিং করছেন। তারা আবারও অধস্তন শাখা ও জেলাসমূহে আমার বিরুদ্ধে মৌখিক সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন।

গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি জামায়াতের একজন নির্বাহী পরিষদ সদস্যের নেতৃত্বে ৩ জন সম্মানিত দায়িত্বশীল আমার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তারা আবারও আমার বিরুদ্ধে গঠণতন্ত্র লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিনয়ের সঙ্গে আমি তাদের জানাই যে, আমি জামায়াতের একজন নগণ্য সদস্য এবং দেশের নাগরিক। স্বাধীন মত প্রকাশ আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাষ্ট্রীয় অধিকার। আমার মত প্রকাশে জামায়াতের গঠণতন্ত্র বা শৃঙ্খলার কোন লঙ্ঘন হয় না বলে আমি মনে করি। আমি যা করি তা স্বচ্ছ ও প্রকাশ্য। এখানে ষড়যন্ত্র বা গোপনীয়তার কিছু নেই। আমি তাদের মাধ্যমে জামায়াতের আমীর বরাবর একটি লিখিত বক্তব্য ও ব্যখ্যা প্রদান করি। আমার বিরুদ্ধে জামায়াত ভেঙ্গে নতুন দল গঠণের যে অপপ্রচার তার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানাই। তারা অসন্তুষ্টচিত্তে আমার আবেদন গ্রহণ করেন এবং জামায়াতের আমীরের নিকট তা উপস্থাপণের আশ্বাস দেন।

আমার আবেদনের বিষয়ে কোন তদন্ত না করে গতকাল রাতে আমাকে টেলিফোনে জানানো হয় আমার সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। মনে ভীষণ ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করলেও আমি সন্তুষ্টচিত্তে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি।

১৯৮৮ সালে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগদানের মাধ্যমে আমি ইসলামী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। যাদের দাওয়াতে আমি এই আন্দোলনের সন্ধান পাই আমার বিবেচনায় তারা তৎকালীন সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৯টি খ্যাতনামা ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম স্বশরীরে পর্যবেক্ষণের সুযোগ আমার হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এগুলোর চাইতে ইসলামী ছাত্রশিবির সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। আমার শিবিরে যোগদান ছিল আমার পরিবারের সঙ্গে একটা বিদ্রোহ। শিবিরের কর্মী হওয়ার অপরাধে আমাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও গৃহবিতাড়িত হতে হয়েছে। সেই থেকে সংগঠনই আমার পরিবার।

৮৮ থেকে ২০০৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি শিবিরে ছিলাম। এই ১৫ বছরের সংগ্রামী জীবন আমার শ্রেষ্ঠ সময়। আমার জ্ঞান, দৃষ্টি ও সাহসের বিকাশ এই সংগঠনেই হয়েছে। আমি সত্য বলতে, ন্যায়ের পক্ষে থাকতে, নিঃসঙ্কোচে মতপ্রকাশ করতে এবং জেল জুলুম ও গুলি বোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ করতে শিখেছি এই আন্দোলনে এসে। আমার কাছে শিবিরের অনুষ্ঠান গুলোতে সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল ‘সাধারণ প্রশ্নোত্তর’। যা খুশি তা প্রশ্ন করা যেতো। আহ্ কী অপরিসীম স্বাধীনতা। কী অদ্ভুত পরিচ্ছন্নতা, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা! আমি এখনো মনেকরি ‘চির উন্নত মম শির আমার প্রাণের ছাত্রশিবির’।

সত্যি কথা বলতে, ২০০৪ সালে জামায়াতে যোগদানের পর আমি কিছুটা থমকে যাই। জামায়াত বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন ও প্রচলিত পূঁতি গন্ধময় রাজনীতির সঙ্গে সমন্বয় করে পথ চলার এক চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী তাদের কর্মসূচি ও কর্মনীতিতে গতিশীলতা নেই। আমি মনে করি প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইসলামী রাজনীতির পথে পা বাড়াতে জামায়াত প্রস্তুতির আগে ময়দানে নেমে পড়েছে। ফলে সময় আসার আগেই তারা কঠিন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে। যে বাঁধা তারা মোকাবিলা করেছে তা অবিস্মরণীয়।

রাসূল (স.) এর আন্দোলন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে যখন ওপেন হয় তা আর আন্ডারগ্রাউন্ডে ফিরে যায়নি। তা বিজয় পর্যন্ত প্রলম্বিত হয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াত একাধিকবার ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে আবার কয়েকবার আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়েছে। জামায়াতের কারণে এখানে ইসলাম সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজে জামায়াতের লোক মানেই সৎ, আদর্শবান, বিবেকবান, ভাল মানুষ। এই স্বীকৃতি বিশাল একটা অর্জন।

জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় বেশ কিছু দায়িত্বশীল ও উল্লেখযোগ্য সাবেক শিবির সভাপতিদের উপস্থিতিতে ২০০৭ সালে মীর কাসেম আলীর ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে জামায়াতের জন্য যে সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছিল তা ছিল একটি অসাধারণ কৌশলপত্র। যদি তখন থেকে তার বাস্তবায়ন শুরু হতো তাহলে বাংলাদেশেও আজ তুরস্ক বা মালোয়েশিয়ার মত ইসলাম ও ন্যায়পরায়ন শাসনবান্ধব সরকার ক্ষমতায় আসীন হতো বলে আমার বিশ্বাস। পরবর্তীতে মু. কামারুজ্জামান আরও প্রাগম্যটিক ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেসব কোনটাই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। জামায়াতে ভেতরকার নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি বা আলোচনা সম্পর্কে বাইরের কারও জানার সুযোগ নেই। এমনকি সর্বোচ্চমানের সদস্যরাও তা জানতে পারে না। এসব আলোচনা বাইরে এলে তা হয় গঠণতন্ত্র ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী। তাহলে তো জামায়াত কেবল পরিবেশ পরিস্থিতিতে বাধ্য হওয়া ছাড়া কোন পরিবর্তন করবে না।

যেমন আছে তেমনই থাকবে। সাধারণ মানুষের চিন্তা, সাধারণ সদস্য বা কর্মীর চিন্তার সঙ্গে দলের নীতি নির্ধারকদের সংযোগ কীভাবে ঘটবে তাহলে?

আমি সামান্য কিছু আলোচনাকে নিজ দায়িত্বে ওপেন করেছি। দেশের শীর্ষস্থানীয় চিন্তক ও বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে জামায়াতের ভাল দিক দূর্বলতার দিক নিয়ে খোলাখুলি মতবিনিময় করেছি। জামায়াতকে নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে জামায়াতের কী কী বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন তারা তা বলেছে। আমি গুরুত্বপূর্ণ লোকদের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের সাক্ষাত ও মতবিনিময়ের সংযোজক হিসেবে কাজ করেছি। হয়তো এজন্য তাদের দৃষ্টিতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে। সংগঠনের অনেক ক্ষতি হয়েছে, সেজন্য তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
তবুও আমার প্রিয় দায়িত্বশীলদের কাছে আমি আজ ঋণী। মেনে নিচ্ছি তাদের বিবেচনায় তারা সঠিক। আমার আবেগ বোধ শক্তি সবই ভুল। তাই আমার আজ কোন আফসোস নেই। তারা আজ আমাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আমার ৩০ বছরের সাংগঠনিক জীবন শেষ। আমি এখন থেকে ইচ্ছেমত আমার কথা লিখতে পারব, বলতে পারব। রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে আমার স্মৃতি-অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারব। আমি যে স্বপ্ন দেখি তার জন্য এখন নি:শঙ্কচিত্তে কাজ করবো। যার জন্য আমাকে শত শত হাজার হাজার ভাই বোনেরা ভালবাসেন, উৎসাহ দেন, দেশের আনাচে কানাচে দূর দুরান্ত থেকে ফোন করেন, ডাকেন তাদের কাছে ছুটে যাব- কাজ করবো।

আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু এই বিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি যে, এই আন্দোলন আবার ঘুরে দাঁড়াবে। এই সংগঠন কামারুজ্জান, মীর কাসেম আলী ও ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাকদের প্রস্তাব একদিন গ্রহণ করবে। শহীদ নিজামী ভাই নেই, মুজাহিদ ভাই, কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, মোল্লা ভাইসহ শত শত শহীদের রক্ত একদিন কথা বলবে।

বিদায় হে প্রিয় কাফেলার সাথীরা।
যারা আমাকে ভালবাসেন তারা দোয়া করবেন। যারা ঘৃণা করেন তারা ক্ষমা করে দেবেন। বিদায় বেলায় সেই স্মৃতি বিজড়িত গানটি হৃদয়ে বাজছে-
আমি আর নেই সেই মিছিলে,, ভাবতেই বন্ধু বুক ভেঙ্গে যায়....।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন