শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

নামাযের অংশসমূহের গুরুত্ব ও ফযিলত

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

রোযা, হজ্ব, যাকাতসহ ইসলামের অন্যান্য সব ইবাদত পৃথিবীর জমিনে ফরয হয়েছে। আর নামায ফরয হয়েছে আসমানের ওপর। শুধু তাই নয়, নামায আরশের পাশে স্বয়ং রাব্বুল আলামীনের উপস্থিতিতে ফরয হয়েছে। এজন্য নামাযের প্রতি যে ধরণের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে এ ধরণের গুরুত্বের কথার উল্লেখ নেই। তেমনি কুরআন-হাদীসে নামাযের কথা যেভাবে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, অন্যান্য ইবাদাতের বেলায় এমনটি বলা হয়নি।

তাকবীরে তাহরীমার গরুত্ব ও ফযীলত: নামাযে আল্লাহু আকবার বলা পৃথিবী এবং পৃথিবীর সকল বস্তু থেকে উত্তম। ২. প্রত্যেক জিনিসের একটা মূল মর্ম থাকে, ঈমানের মূলমর্ম হচ্ছে নামায আর নামাযের মূলমর্ম হচ্ছে তাকবীরে তাহরীমা। ৩. যখন নামাযী আল্লাহু আকবার বলে, তখন আসমান-যমীনের সব কিছুই তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যায়। ৪. হাদীস শরীফে আছে, তাকবীরে তাহরীমা বা ইমামের সাথে সাথে তাকবীর বলা হাজারো উট সদকা করার চেয়ে উত্তম। অর্থাৎ তার সওয়াব এক হাজার উট আল্লাহর রাস্তায় সদকা করার চেয়ে বেশি হয়।

কেরাতের গরুত্ব ও ফযীলত:
১. হযরত আলী রা. বলেন, যে ব্যক্তি কোরআন শরীফের যে কোন একটি হরফ পড়ে বা শ্রবণ করে, সে দশটি সওয়াব পায়। তার দশটি গুনাহ মাফ হয়ে যায়। জান্নাতে তার মর্যাদা দশ ধাপ এগিয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি নামাযে বসাবস্থায় কুরআন পড়ে, প্রতিটি হরফের বদলে সে ৫০টি করে সওয়াব, ৫০টি করে গুনাহ মাফ এবং জান্নাতে ৫০ ধাপ করে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। যে ব্যক্তি নামাযের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় কুরআন পড়ে, সে প্রতি হরফের পরিবর্তে একশ একশ করে সওয়াব লাভ করে, একশটি করে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এবং জান্নাতে তার মর্যাদা একশ ধাপ করে এগিয়ে যায়।

২. যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইমামের সূরা ফাতিহা শ্রবণ করে সে ঐ ব্যক্তির মত যে শুরু থেকে জিহাদে শরীক হয়ে একেবারে শত্রæ দেশ জয় করে এসেছে। তথা সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জিহাদ করার সওয়াব পাবে। আর যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহার শেষের দিকে এসে শরীক হয়। সে ঐ ব্যক্তির মত যে জিহাদের অংশ গ্রহণ করেনি কিন্তু বিজয়ের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টনের সময়ে এসে উপস্থিত হল। পার্থক্যটা নিচের ঘটনা থেকে স্পষ্ট আকারে ফুটে উঠবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা কে একটি বাহিনীর সাথে জিহাদে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। বাহিনীর সবাই জিহাদে চলে গেলেন, কিন্তু তিনি এই ভয়ে জিহাদে যাননি, যে হয়তো আমি শহীদ হয়ে যাব আর কখনো রাসূলের পিছনে জুমা পড়ার সুযোগ পাব না। অর্থাৎ শুধু রাসূলের পিছনে জুমার নামায পড়ার আশায় জিহাদে যাননি। জুমার পর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি জানতে পারলেন, তখন জিহাদে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন- তিনি ধারণাটাকে দ্বিতীয়ববার ব্যক্ত করলেন এবং বললেন, আমি এখনই যাব। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আব্দুল্লাহ! বাহিনীর অন্যান্য সদস্য এবং তোমার মাঝে পাঁচ শত বছরের পার্থক্য হয়ে গেল। অর্থাৎ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তোমার এবং তাদের মাঝে এত বড় পার্থক্য সৃষ্টি হল। (মিশকাত)

কিয়াম বা নামাযে দাঁড়িয়ে থাকার ফযীলত:
১. বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত নামাযে দাঁড়িয়ে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার মাথার ওপর সওয়াবের বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে।
২. যখন বান্দা নামাযের জন্য দাঁড়ায়, তখন আসমানের সব দরজা তার জন্য খুলে দেওয়া হয়। তার এবং আল্লাহর মাঝে যত রূহানী পর্দা আছে সব সরিয়ে ফেলা হয়।
৩. নামাযের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ালে মৃত্যু যন্ত্রণা এবং কঠোরতা দূরিভূত হয়ে যায়।
৪. নামাযের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সহজে পুলসিরাত পাড়ি দেওয়ার বড় একটা উপায়।
রুকুর গরুত্ব ও ফযীলত:
১. বান্দা যখন রুকু করে, তখন নিজের শরীরের ওজন পরিমাণ স্বর্ণ সদকাহ করার সওয়াব পায়।
২. বান্দা যখন রুকুর তাসবীহ বলে, তখন সমস্ত আসমানী কিতাব তেলাওয়াত করার সওয়াব পায়।
৩. বান্দা যখন রুকু থেকে উঠে, তখন তাকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। (শরহে আরবায়িনা নববিয়্যাহ)

সিজদার গরুত্ব ও ফযীলত:
১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সিজদা করার সময় বান্দা আল্লাহর যতটা নিকটবর্তী হয়, এতটা নৈকট্য অন্য কোন ইবাদতে অর্জিত হয় না। সুতরাং তোমরা সিজদার মধ্যে বেশি বেশি দোয়া কর। (মুসলিম)
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যদি তোমরা জান্নাতে আমার সাথে থাকতে চাও, তাহলে বেশি পরিমাণে সিজদা কর। (মুসলিম শরীফ)
৩. আল্লাহর কাছে বান্দার সবচেয়ে প্রিয় অবস্থা হলো, সে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে এবং তার চেহারা আল্লাহর সামনে মাটিতে পড়ে থাকবে। (তারগীব)
৪. মানুষ যখন সিজদা করে, তখন শয়তান কেঁদে কেঁদে সেখান থেকে পালিয়ে যায় এবং বলে আফসোস! মানুষের ওপর সিজদা করার হুকুম হল আর অমনি তারা সিজদা করে জান্নাত কিনে নিল। অথচ আমার ওপর যখন সিজদা করার হুকুম হয়েছিল, আমি তা অমান্য করে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে গেলাম।
৫. যখন নামাযী সিজদা করে, তখন সে সমস্ত জ্বীনজাতি এবং মানবজাতির সংখ্যার সমপরিমাণ সওয়াব পায়, আর যখন সিজদার তাসবীহ বলে, তখন একটা দাস মুক্ত করার সওয়াব পায়। (শরহে আরবায়িনা নববিয়্যাহ)
৬. মাদান বিন তালহা রা. বলেন, আমার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোলাম হযরত চাওবান রা. এর সাক্ষাত হলে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে এমন একটা আমলের কথা বলুন যেটা করলে আমি কোন কষ্ট ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। আমি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেও কোন উত্তর দিলেন না। আমি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, এ সম্পর্কে আমি রাসূল সা. কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বেশি পরিমাণ সিজদা করতে থাক। কেননা প্রত্যেক সিজদার বিনিময়ে আল্লাহ একটি করে মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং একটি করে গুনাহ মাফ করে দেন। (মুুসলিম শরীফ)

তাশাহুদের গরুত্ব ও ফযীলত:
যখন নামাযী তাশাহুদ পড়ার জন্য বসে, তখন সে ধৈর্যধারণকারীদের সওয়াব পায়। অর্থাৎ হযরত আইয়ূব আ. হযরত ইয়াকুব আ. হযরত ইয়াহইয়া আ. প্রমুখের মত বড় বড় ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ব্যক্তিত্বদের অনুরূপ সওয়াব অর্জন করে। এটা আল্লাহরই ধর্ম। তিনি যাকে যতটুকু চান সওয়াব দিতে পারেন। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১০৫)

দুরূদ শরীফের গরুত্ব ও ফযীলত:
দরূদ শরীফ মানে হচ্ছে আল্লাহর দরবারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য এমন রহমতের দোয়া করা যা উভয় জাহানোর জন্য কল্যাণকর হয়। নিম্মে কিঞ্চিত আলোচনা করা হল।
উলামায়ে কেরাম লিখেন, জীবনে একবার দরূদ শরীফ পড়া ফরয। যে রকমভাবে পুরো জীবনে একবার নবুয়তের সাক্ষ্য প্রদান করা ফরয।
২. কাজী আবু বকর বলেন, আল্লাহ তায়ালা মুমিন বান্দার ওপর রাসূলের ওপর দুরূদ পড়াকে ফরয করেছেন। তবে তার জন্য কোন সময় নির্দিষ্ট করেননি। পবিত্র কুরআনে বাণী- হে ঈমানদারগণ! তোমরা নবীর ওপর দরূদ এবং সালাম প্রেরণ কর। (সূরা আহযাব, আয়াত: ৫৬)
৩. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, নামাযের শেষ বৈঠকে দুরুদ শরীফ পড়া ফরয।
৪. ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, শেষ বৈঠকে দুরূদ শরীফ পড়া সুন্নত। কোন মজলিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম কয়েকবার উচ্চারিত হলে একবার দুরূদ পড়া ওয়াজিব। না পড়লে গুনাহগার হবে। তবে প্রতিবার দরূদ পাঠ করা মুস্তাহাব এবং অনেকে সওয়াব অর্জিত হয়।
৫. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দশবার রহম করবেন, তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং দশধাপ মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন। (নাসায়ী শরীফ)
৬. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কেয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটে থাকবে, যে আমার ওপর সর্বাধিক দরূদ প্রেরণ করবে বা আমার প্রতি সর্বাধিক দুরূদ প্রেরণকারী ব্যক্তিই কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করবে। (তিরমিযী শরীফ)
৭. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ এমন কতিপয় ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন, যাদের কাজ হল তারা পৃথিবীতে বিচরণ করবে এবং আমার প্রতি উম্মতের পক্ষ থেকে দুরূদ-সালাম পাঠিয়ে দিবে। (নাসায়ী শরীফ)
৮. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করে, তার জন্য আমার সুপারিশ অনিবার্য হয়ে পড়ে। (মুসনাদে আহমদ)
৯. হযরত উমর রা. বলেন, দোয়া আসমান এবং জমীনের মাঝখানে থেমে থাকে, একদম ওপরে ওঠে না। যতক্ষণ না তোমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর দরূদ পাঠ কর। (তিরমিযী শরীফ)
সালাম ফিরানোর গরুত্ব ও ফযীলত: নামাযী যখন নামায থেকে ফারেগ হতে সালাম ফেরায়। তখন তার বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাতের আটটি দরজার সবকটি খুলে দেন। যাতে নামাযী নিজ ইচ্ছামত প্রবেশ করার অধিকার লাভ করে। (মাজালিসে সুন্নিয়া) আল্লহ তায়ালা সকলকে শরিয়তের আলোকে নামায পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন