(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
রাসূলে পাক (সা:) যে পরিপূর্ণ জীবন বিধান দিয়ে গেছেন তার নাম হলো ইসলাম। লক্ষ্য করলে দেয়া যায়, আরবী ইসলাম শব্দটিতে পাঁচটি বর্ণই আছে। যথা- আলিফ, ছিন, লাম, আলিফ এবং মীম।
ইসলামের জন্য প্রধান যে শর্ত তা হলো ঈমান। ঈমান ছাড়া ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করা যায় না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আরবী শব্দটিতেও পাঁচটি বর্ণ আছে। যথা-আলিফ, ইয়া, মীম আলিফ এবং নুন। ঈমানের যথার্থতা নিরূপিত হয় তাছদীক বা সত্যতার স্বীকৃতি ও আমাল বা কর্মানুষ্ঠানের দ্বারা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আরবী তাছদীক শব্দে পাঁচটি বর্ণই আছে। যথা-তা, ছোয়াদ, দাল, ইয়া এবং ক্কাফ। অপরদিকে আমাল শব্দেও পাঁচটি বর্ণই আছে। যেমন-আলিফ, আইন মীম, আলিফ এবং লাম।
প্রতিটি বস্তুরই যেমন একটি ভিত্তি বা বুনিয়াদ থাকে, তেমনি ইসলামের বুনিয়াদও পাঁচটি জিনিসের উপরই প্রতিষ্ঠিত। যথা-ঈমান, সালাত, রোজা, যাকাত এবং হজ্জ।
সালাতের একান্ত নিবিড়তম মুহূর্তে মহান আল্লাহ পাকের যে প্রশংসা করা হয় তা দু’টি ভাগে বিভক্ত। যথা-তাসবীহ ও তাহমীদ। লক্ষ্য করলে দেখা যায় আরবী তাসবীহ শব্দে পাঁচটি বর্ণ আছে। যথা-তা, সিন, বা, ইয়া এবং হা। অপরদিকে তাহমীদ শব্দেও পাঁচটি বর্ণই আছে। যেমন-তা হা, মীম, ইয়া এবং দাল। সালাত উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ফরজ ইবাদত। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আরবী ইবাদত শব্দেও পাঁচটি বর্ণই আছে। যথা-আইন, বা, আলিফ, দাল এবং তা।
একান্ত অপরিহার্য সালাতকে কায়েম করতে হলে বান্দাহর অন্তরে আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহর মহব্বত থাকা দরকার। এই মহব্বতই বান্দাহকে পূর্ণ আন্তরিকতা ও গভীর মনোনিবেশের স্তরে উন্নীত করতে সক্ষম। হিসেব করলে দেখা যায়, আরবী ‘মুহাব্বাত’ শব্দটিতেও পাঁচটি বর্ণই আছে। যথা-মীম, হা, বা, বা এবং তা’।
সালাত কায়েম করতে গিয়ে বান্দাহ যখন কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়ায় তখন তার মাঝে দু’টি রূপ পরিদৃষ্ট হয়। একটি হলো, দৈহিক রূপ অপরটি হলো আন্তরিক রূপ। দৈহিক রূপে পাঁচটি বস্তুর তার সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে। যেমন-আগুন, বাতাস, মাটি, পানি ও এর দ্বারা গঠিত দেহাবয়ব। অপরদিকে আভ্যন্তরীণ পাঁচটি বস্তুুর অতীব সূ² শক্তিও তাকে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যেমন- ক্কলব, রূহ, ছির, খফি এবং আখফা। সুতরাং এখানেও পাঁচ সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ততাই লক্ষ্য করা যায়।
সালাত কায়েমকারী সালাতের বিভিন্ন অবস্থা ও অনুষ্ঠানাদি সুষ্ঠুভাবে কায়েম করতে গিয়ে সচেতনতার সাথে অগ্রসর হন। এই সচেতনতার পথে যে সকল ইন্দ্রিয় তাকে বিভিন্নভাবে উপযোগী অবস্থানে অধিষ্ঠিত করতে যৌথভাবে এগিয়ে আসে, এদের সংখ্যা পাঁচ।
যেমন-চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক এই ইন্দ্রিয়গুলোর সক্রিয় সহযোগিতা না হলে বস্তুুজগত হতে যাত্র শুরু করে বস্তুহীনতার অসীম সমুদ্রে, সালাতের মাধ্যমে অবগাহন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। পরিশেষে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, পূর্ণ সচেতনতা, দেহ-মনের একাত্মতা, নির্মল মুহাব্বত, তাসবীহ ও তাহমীদ সমৃদ্ধ ইবাদত ইবাদত এবং ইসলামের আলোকোজ্জ্বল পথে রাসূলে পাক (সা:)-এর প্রদর্শিত কর্মানুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে যে সালাত কায়েম করা হয় তাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দীদার লাভের প্রকৃত পাথেয়।
নামাজ আসলে কি?
নামাজ আসলে কি? এর উত্তরে বলা যায়, নামাজ হচ্ছে সৃষ্টমানুষের অন্তর, জবান এবং হাত-পা দ্বারা স্বীয় স্রষ্টার সামনে বন্দেগী ও আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যম। সে করুণাময় ও দয়ালু মনিবের স্মরণ। তাঁর দেয়া অগণিত নেয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন। মূল ও অবিনশ্বর সৌন্দর্যের প্রশংসা এবং তাঁর একাকীত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত স্বীকৃতি। নামাজ আসলে হচ্ছে প্রেমাস্পদের কাছে তৃষিত আকুতি। স্বীয় করুণানিধানের সন্নিধানে দেহ ও মন সম্ভূত বন্দেগী। তা হচ্ছে, আমাদের আভ্যন্তরীণ অনুভূতির একান্ত কামনা। এ হচ্ছে আমাদের অন্তরের সহজাত কামনার অভিব্যক্তি। এ হচ্ছে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি মাঝে গভীর সম্পর্ক স্থাপন ও সংরক্ষণের একান্ত মাধ্যম। এ হচ্ছে অশান্ত চিত্তের প্রবণ। ব্যথিত চিত্তের উপশম এবং নিরাশ চিত্তের আশার আলো। নামাজ প্রকৃতই সহজাত প্রকৃতির ধ্বনি। অনুভূতি ও উপলব্ধিপ্রিয় অন্তরের এ হচ্ছে, আভ্যন্তরীণ প্রভনঞ্জন। বস্তুতু: জিন্দেগীর সার ও অস্তিত্বের মমকথা নামাজের মাঝেই নিহিত রয়েছে।
কোন অদৃশ্য শক্তির সামনে মস্তক অবনত করা এবং তাঁরই প্রকাশে আরজী ও ফরিয়াদ পেশ করা, এমনকি বিপদের দিনে তাঁরই কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভের আবেদন করা মানুষের সহজাত স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। মনে হয় মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় এমনকি উৎস বা ছাঁচ রয়েছে, যা অজানাভাবেই অঙ্গুলীর স্পর্শ ও ছোঁয়াচ হতে মুক্ত ও পবিত্র। আল কুরআনের ঘোষণা ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই’ দ্বারা এরই আভ্যন্তরীণ সহজাত ধ্বনির প্রত্যুত্তর দান করা হয়েছে। আল- কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষের এই সহজাত স্বাভাবিক অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে এবং জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তোমাদের উপর যখন বিপদ আপতিত হয়, যখন সমুদ্রে তুফান উঠে এবং তোমাদের জাহাজ সমুদ্রে আটকা পড়ে, তখন আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যাকে তোমরা আহ্বান কর?
মোটকথা মানুষেল কপাল নিজেই একটি সেজদাস্থল তালাশ করে। যার সামনে সে অবনত হয় এবং মনের গোপন আরজী পেশ করে। সে নিজের কামনা-বাসনা তাঁর দরবারে উপস্থাপন করে। বস্তুুত : এবাদত হচ্ছে, অন্তরের এই সহজাত স্বভাবের জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তর। এই কামনা যদি না থাকে, তাহলে মানুষের অন্তরের উদাসীনতা ও বিদিশার কোন চিজিৎসা মোটেই সম্ভব নয়। বন ও অরণ্যের জীবনযাত্রার মাঝেও এবাদতের কিছু না কিছু রুসুম ও রেওয়াজ দেখতে পাওয়া যায়, যা তাদের সহজাত স্বভাবের আহ্বানকে পরিপূর্ণ সান্ত¦না দেয়ার কাজ করে। সুতরাং ঐশী জীবন-দর্শনও এ থেকে খালি থাকবে, এমনটি হতেই পারেনা।
সুতরাং দুনিয়ার প্রত্যেকটি আসমানী ধর্মেই আল্লাহকে স্মরণ করার হুকুম এবং তাঁর স্মরণে পালনযোগ্য কতিপয় রীতি-পদ্ধতি আছে। ইসলামে হামদ ও তাসবীহ পাঠের নিয়ম আছে। ইহুদীদের মাঝে ‘মজমুর,’ খৃস্টানদের মাঝে দোয়া, পার্সীদের মাঝে ‘জমজমা’ এবং হিন্দুদের মাঝে ভজনের রীতি আছে। দিনে এবং রাতে এই অপরিহার্য কাজ পালন করার জন্য সকল সম্প্রদায়ের মাঝেই সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এতে স্থির বিশ্বাস রাখা উচিত যে, নামাজ ও ধর্মীয় চেতনার দিক হতে এসকল নিয়ম-নীতির অধীন। যে নীতি সম্পর্কে দুনিয়ার সকল মাযহাবই একমত। কুরআনুল কারীমের শিক্ষা অনুসারে জানা যায় যে, দুনিয়াতে এমন কোন পয়গাম্বর আগমন করেননি যিনি স্বীয় উম্মতকে নামাজের তালীম দেননি বা এরজন্য তাকিদ করেননি। বিশেষ করে মিল্লাতে ইব্রাহীমিতে এই বৈশিষ্ট্যটি প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) যখন স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে মক্কার বিয়ান ভূ-খন্ডে আবাদ করলেন, তখন এই উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন, “হে আল্লাহ! সে যেন নামাজ কায়েম করতে পারে।” (সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৬)
এক্ষেত্রে স্মর্তত্য যে, আল-কুরআনের সমর্থন যাবুর ও তৌরাত হতেও পাওয়া যায়। জানা যায় যে, ইহুদীদের পুরনো সহীফাগুলোতের নামাজের জন্য প্রচলিত শব্দ “আল্লাহর নাম লওয়া” ছিল। সুতরাং তৌরাত এবং যাবুরে নামাজের জন্য সেই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) ‘বাইতে ঈল’ (বাইতুল্লাহ)-এর পাশে একটি ‘কুরবানগাহ’ নির্মাণ করেছিলেন এবং আল্লাহ নাম স্মরণ করেছিলেন। (পয়দায়েশ : ১২-৪) হযরত ইসহাক (আ:) আল্লাহর নাম স্মরণ করেছিলেন। (পয়দায়েশ : ২৬-২৫) হযরত দাউদ (আ:) ও আল্লাহর নাম স্মরণ করে ছিলেন। (যাবুর : ১১৭-১২০) এই ব্যবহারিক দিকটি আল-কুরআনেও ব্যক্ত হয়েছে, “এবং তিনি স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করলেন এবং নামাজ আদায় করলেন।” (সূরা আ’লা) আল-কুরআনে সমার্থবোধক আয়াত আরও অনেক আছে। ইহুদীদের প্রাচীন সহীফাসমূহ যেমন-‘সফরে দানিয়াল’ এবং খৃস্টানদের সকল সহীফার মাঝে নামাজের জন্য দোয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যা আরবী ‘সালাত’ শব্দটির সমার্থবোধক। এজন্য ইঞ্জিলের উর্দু তরজমাগুলোতে ‘দোয়া’ শব্দটির তরজমা ‘নামাজ’ শব্দ দ্বারা করা হয়েছে। (মথি ১৭-২১ এবং মথি ২৩-২৪)
অনুরূপভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-ও স্বীয় সন্তান-সন্ততির জন্য দোয়া করেছেন-“হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এবং আমার বংশের লোকদেরকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী বানিয়ে দিন।” হযরত ইসমাইল (আ:) সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করা হয়েছে, “তিনি স্বীয় পরিবার-পরিজনদেরকে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিতেন।” (সূরা মারয়াম : রুকু-৪) হযরত শুয়াইব (আ:)-কে তাঁর স্ববংশীয় লোকেরা গালি দিয়ে বলতো, “তবে কি তোমার নামাজ আমাদেরকে এই হুকুম দিচ্ছে যে, আমাদের বাপ-দাদারা যেগুলোর পূজা করত, আমরা সেগুলো ছেড়ে দেই?” (সূরা হুদ : রুকু-৮-হযরত লুত, হযরত ইসহাক, হযরত ইয়াকুব (আ:) এবং তাদের বংশের পয়গাম্বরদের ব্যাপারে আল-কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, “এবং আমি তাদেরকে নেক কাজের এবং নামাজ কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছিলাম।” (সূরা আম্বিয়া : রুকু-৫) হযরত লোকমান (আ:) স্বীয় পুত্রকে নসীহত করে বলেছিলেন, “হে আমার পুত্র! তুমি নামাজ কায়েম করবে।” (সূরা লুকমান : রুকু-২) হযরত মূসা (আ:)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, “আমার স্মরণে নামাজ কায়েম কর” অন্যত্র হযরত মূসা (আ:), হযরত হারুন (আ:) এবং বনী ইসরাঈলকে হুকুম করা হয়েছে, “নামাজ কায়েম কর।” (সূরা ইউনুস : রুকু-৯) বনী ইসরাঈলের সাথে ওয়াদা করা হয়েছিল যে, “যদি তোমরা নামাজ কায়েম কর তাহলে আমি তোমাদের সাথে থাকব।: (সূলা মায়েদাহ : রুকু-৩) হযরত যাকারিয়া (আ:) সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তিনি মিহরাবে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেছিলেন।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-৪) হযরত ঈসা (আ:) বলেছেন, “আল্লাহ পাক আমাকে নামাজের হুকুম প্রদান করেছেন।” (সূরা মারয়াম : রুকু-২)
উপরোক্ত আয়াতসমূহ ছাড়াও আল-কুরআনের মাধ্যমে একথা প্রতিপন্ন হয় যে, “ইসলামের আমলেও আরবের কোন কোন ইহুদী ও খৃস্টান নামাজ পাঠ করত।” “আহলে কিতাবের মাঝে কিছু লোক যারা দাঁড়িযে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-১১) হাদীস শরীফেও ইহুদী এবং খৃস্টানদের নামাজের কথা বলা হয়েছে, যেমন রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “যখন নামাজ পড়বে তখন লুঙ্গি পর ও চাদর গায়ে দাও, ইহুদীদের মত খালি গায়ে থেক না।” “তোমরা ইহুদীদের মত শুধু কাঁধের উপর হতে চাদর লটকে দিয়ো না, বরং চাদর জড়িয়ে নামাজে ইহুদীদের মত ঝুঁকে পড়ো না।” “তোমরা ইহুদীদের বিপরীতে নামাযে জুতা এবং মোজা ব্যবহার কর।” “আমার উম্মতে ঐ সময় পর্যন্ত দ্বীনের কিছু না কিছু নমুনা বাকী থাকবে, যতক্ষণ না তারা ইহুদীদের মত মাগরিবের নামাজে তারকা উদয় হওয়ার এবং খৃস্টানদের মত ফজরের নামাযে তারকা পুঞ্জ অস্ত যাওয়ার জন্য এন্তেজার করবে।” (এই হাদীসগুলো কানজুল উম্মাল চতুর্থ খন্ডের বিভিন্ন স্থান হতে চয়ন করা হয়েছে) এই উদ্ধৃতিগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আরবের ইহুদী ও নাসারাদের কিছু লোক এমনও ছিল যারা নামাজ আদায় করত।
আরবের যে সকল লোক নিজেদেরকে হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর অনুসারী বলে মনে করত, তাঁদের মাঝে এমনও ছিল যারা ইবাদতের নির্দিষ্ট তরীকা সম্পর্কে ওয়াকেফ হাল ছিল না। যায়েদ বিন আমরের ঘটনায় উল্লেখ আছে যে, তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি জানিনা কেমন করে তোমার ইবাদত করব।” একথা বলে তিনি উভয় হস্ত উত্তোলন করতেন এবং এর উপর সেজদাহ করতেন।” (ইবনে হিশাম : যায়েদ বিন আমর বিন নুফায়েল প্রসঙ্গ) কিন্তু এদের মাঝে দু’একজন এমনও ছিলেন যে, যারা কোন না কোনভাবে নামাজ আদায় করতেন। সুতরাং হযরত আবুজর গিফারী (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে মোলাকাত করা ও ইসলাম গ্রহণ করার তিন বছর পূর্বে নামাজ আদায় করতেন? সুতরাং হযরত ...**আবুজর গিফারী (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:) এর সাথে মোলাকাত করা ও ইসলাম গ্রহণ করা তিন বছর পূর্বে নামাজ আদায় করতেন। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করল যে, তখন আপনি কোন দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন তিনি বললেন, “সেদিকেই মুখ করতাম।” (সহীহ মুসলিম : ফাযায়েলে আবু জর)। আরবের একজন অন্ধকার যুগের কবি ‘জাররানুল ইওয়াদ’ বলেছে, “এবং এই আরোহীরা রাতের শেষ অংশকে পেয়েছে, ঐ সময়ের পরে যখন ইবাদত গুজার হানিফী সম্প্রদায় নামাজ আদায় শেষ করে।” এই কবিতার দ্বারা বুঝা যায় যে, তৎকালীন আরবের হানিফী মাযহাবের অনুসারীরা রাতের শেষাংশে নামাজ আদায় করতো। ইহুদীদের বৃহত্তর দল নামাজের কথা বিস্মৃত হয়ে পড়েছিল। তাদের নামাজ ছিল কতিপয় রুসুম ও রেওয়াজের সমষ্টিমাত্র। তারা নামাজ হতে অধিক গুরুত্ব দিত কুরবানী ও নজরানার প্রতি। তাদের মাঝে এখলাস ও আল্লাহর আনুগত্যের নাম-গন্ধও ছিল না। খৃস্টানরা আল্লাহর নামাজের সাথে সাথে মানুষের জন্যও নামাজ পড়া শুরু করেছিল। তারা হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত মারয়াম (আ:) ছাড়া অগণিত দেবতা ও শহীদদের ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়েছিল। দেখুন, ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : একাদশ সংস্করণ ইবাদত শব্দ।
দ্বীনে ইব্রাহীমির দাবীদার ও অনুসারীগণ নিজেদের চিন্তা ও ধারণা মোতাবেক কিছু কিছু আরকান আদায় করতো। মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আবির্ভাবের পূর্বে নামাজের নির্দিষ্ট ও তৌহিদভিত্তিক হাকীকত সাধারণত : পৃথিবী হতে মুছে গিয়েছিল। এর আকার-আকৃতি এতটুকু বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, আজো তাদের সহীফাগুলোর মাঝে এর মৌলিক নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় না। না তাদের আরকানের সন্ধান পাওয়া যায়, না একথা বুঝা যায় যে, ইলহামী সহীফার ধারক-বাহকগণ এই ফরযকে কেমন করে আদায় করতো এবং তারা প্রভাব বিস্তারকারী কোন কোন দোয়াগুলো পাঠ করতো এবং এগুলো আদায়ের জন্য কোন কোন সময় নির্দিষ্ট ছিল। তবে যা কিছু তাদের মাঝে অবশিষ্ট ছিল, তা মূলত : কতিপয় রুসুম ও রেওয়াজপ্রসূত কর্মকান্ড ও পরবর্তীকালের ধর্মবেত্তাদের প্রদর্শিত আচার অনুষ্ঠান মাত্র। এগুলোকেই তারা ধর্মীয় ফরিজয়ত বলে আমল করতেছিল। সেজদাহ নামাজের প্রাণ এবং আল্লাহর আনুগত্যেল চূড়ান্ত মঞ্জিল, তা’ ইহুদী ও নাসারাগণ কষ্টদায়ক পীড়া মনে করে ছেড়ে দিয়েছিল।
একইভাবে নামাজের জাহেরী আকারও তারা পরিবর্তন করে ফেলেছিল। আল-কুরআনে তাদের অবস্থার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। “তারপর অযোগ্য উত্তরপুরুষগণ একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়, তারা এই তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, আমাদেরকে ক্ষমা করা হবে; কিন্তুু এর অনুরূপ সামগ্রী তাদের নিকট আসলে তাও তারা গ্রহণ করে, কিতাবের অঙ্গীকার কি তাদের নিকট হতে লওয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর সম্বন্ধে সত্য ছাড়া বলবে না? এবং তারাতো এতে যা আছে তা অধ্যয়নও করে, যারা তাকাওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেয়, তোমরা কি তা অনুধাবন কর না? যারা কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে ও সালাত কায়েম করে আমি তাদের মত সৎকর্মশীলদের শ্রমফল নষ্ট করি না।” (সূরা আরাফ : রুকু-২১) সূরা মারয়ামে সকল সত্যবাদী আম্বিয়াদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ পাক ঘোষণা করছেন, “তাদের পরে তাদের উত্তারাধিকারিগণ এমন হয়ে গেল যে, যারা নামাজকে বরবাদ করে দিল এবং নিজেদের খাহেশাতের পায়রবী করল।” (সূরা মারয়াম : রুকু-৪) (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন